গণ পরিষদে। প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা এবং মাওবাদী নেতা প্রচণ্ড। কাঠমান্ডু, ২৫ জানুয়ারি ২০১৫। ছবি: রয়টার্স
রাজনীতির এক পর্ব থেকে পর্বান্তরে যেতে কত সময় লাগা উচিত, সে বিষয়ে রাজনীতিশাস্ত্রীরা কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত দেননি। তা সত্ত্বেও গত মাসের ২২ তারিখে যখন নেপালের নতুন সংবিধান রচনার পূর্বনির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও, শাসনতন্ত্রের প্রাথমিক খসড়া দূরে থাক, রূপরেখা নিয়েও প্রধান দলগুলি সহমত হতে পারল না, তখন স্বভাবতই গেল-গেল রব উঠেছে।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কখনও কখনও অংশ নিয়ে এবং সেই লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে নেপালের বহু রাজনৈতিক নেতা গণতন্ত্রের দাবিতে পথে নেমেছিলেন, সেই গত শতকের চল্লিশের দশকে। পঞ্চাশের দশকে দীর্ঘ স্বৈরতান্ত্রিক রাণাশাহি শেষ হলেও রাজতন্ত্র অটুট থাকে, বস্তুত নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে কিছুটা সুদৃঢ়ও হয়। নেপালি কংগ্রেস দল বা তার অন্যতম মুখ্য নেতা বিশ্বেশ্বরপ্রসাদ কৈরালা এবং রাজা ত্রিভুবনের মধ্যে দূরত্ব কমতে থাকে। অচিরে কৈরালা দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রীও হন।
গণতন্ত্রের পথে নেপালের এই প্রথম পদক্ষেপ প্রকৃত অর্থে সফল হয়নি। ১৯৫৫ সালে ত্রিভুবনের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র মহেন্দ্র রাজসিংহাসনে আসীন হওয়া থেকে গণতন্ত্রের পথ আরও দুর্গম হয়। ১৯৬০-এ রাজা মহেন্দ্র কৈরালাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে জেলে আটক করায় নেপালের গণতন্ত্রীকরণ থমকে যায়। পরের তিন দশকে রাজা বদল হলেও নেপালকে দলহীন ‘পঞ্চায়েতি গণতন্ত্র’ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল।
১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় তীব্র জন-আন্দোলন নেপালে ফের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশা জাগিয়ে তোলে। ওই আন্দোলনের শেষে শুরু হয় বহুদলীয় গণতন্ত্র নিয়ে নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা। পরের ১৫ বছর এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও, ইতিমধ্যে দেশের রাজপ্রাসাদ ২০০১ সালে যেমন রক্তাক্ত হয়েছে, সপরিবার রাজা বীরেন্দ্র নিহত হয়েছেন, অন্তত ১৬ থেকে ১৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। গৃহহীন হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।
২০০৬-এ প্রায় সার্বিক এক শান্তি সমঝোতার পরে ২৩৯ বছরের দীর্ঘ রাজতন্ত্রের ইতি ঘটিয়ে বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্রটি ধর্মনিরপেক্ষতার পথে পা বাড়িয়েছিল। শান্তিপথের সন্ধানেই ২০০৮-এর মে মাসে সাংবিধানিক গণ পরিষদের প্রথম নির্বাচন হয়। অনেককে অবাক করে সর্বোচ্চ আসন পায় একদা সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা মাওবাদীরা। নেপালি কংগ্রেস ও নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি (ইউনিফায়েড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট) যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান পেলেও, কোনও দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।
দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে নেপালে যে অন্তর্বর্তী সংবিধান তৈরি হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই সংঘটিত হয় ওই নির্বাচন। আশা ছিল, চার বছরের মধ্যেই নবনির্বাচিত সাংবিধানিক গণ পরিষদ দেশকে প্রথম গণতান্ত্রিক সংবিধান উপহার দেবে। আশার পূরণ হয়নি। অতঃপর প্রায় বছর দেড়েক অরাজকতার পরে ২০১৩-র নভেম্বরে পুনরায় নির্বাচনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে দ্বিতীয় সাংবিধানিক গণ পরিষদ।
এ বারের ভোটে কিন্তু রাজনীতির অঙ্কের কিছু হেরফের ঘটে। মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি চলে যায় তৃতীয় স্থানে। নেপালি কংগ্রেস উঠে আসে শীর্ষস্থানে। কমিউনিস্ট পার্টি (ইমালে) পায় দ্বিতীয় স্থান। কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি (ইমালে)-র জোট প্রশাসনের সাময়িক হাল ধরে। মাওবাদী ও মধেশী দলগুলি মিলে গড়ে ওঠে বিরোধী পক্ষ। ক্রমশ মাওবাদী নেতা পুষ্পকমল দহাল বা প্রচণ্ড-র নেতৃত্বে তৈরি হয় ত্রিশদলীয় এক জোটও।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি দেশের নাগরিকদের কথা দিয়েছিল, ২২ জানুয়ারির মধ্যে সংবিধানের প্রথম খসড়া প্রস্তুত হয়ে যাবে। হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে প্রস্তাবিত সংবিধানটি রচিত হবে, এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
দেশের অন্তর্বর্তী শাসনতন্ত্রের ৭০ নম্বর ধারায় বলা ছিল, নতুন সংবিধানের রূপরেখা তৈরির ক্ষেত্রে গণ পরিষদের সদস্যদের সহমত হওয়া কাম্য; ঐকমত্য না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতেও নতুন সংবিধান অনুমোদিত হতে পারে, তবে কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন জরুরি।
এখন ক্ষমতাসীন নেপালি কংগ্রেস ও কমউনিস্ট পার্টি (ইমালে) জোটের গণ পরিষদে দুই-তৃতীয়াংশ আসন আছে। দু’দলই তাই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধান অনুমোদনের পক্ষে। কিন্তু মাওবাদী ও মধেশী দলগুলির একাংশ সহমত ছাড়া এগোতে নারাজ।
মতের গরমিল নানা প্রশ্নে। দেশের রাষ্ট্রপতির হাতেই মূল ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে না সংসদীয় শাসনব্যবস্থা হবে, ভোটের পদ্ধতি ফার্স্ট-পাস্ট দ্য পোস্ট, না সমানুপাতিক, না কি আজকের নেপালের মতো দুইয়ের মিশ্রণ, যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থা হবে কি, সাংবিধানিক আদালত কি থাকবে— বিতর্ক এই সব প্রসঙ্গে। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিরোধ বোধ হয় যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সীমানা নির্ধারণকে কেন্দ্র করে: নতুন অঙ্গরাজ্যগুলি কি জাতিসত্তাভিত্তিক হবে, না অন্য কোনও উপায়ে নির্মিত হবে?
মাওবাদী ও মধেশী দলগুলি এর মধ্যে প্রথম মতের শরিক। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের দাবিও তাদেরই। শাসক কংগ্রেস ও কমিউনিস্টরা ভিন্ন মত। বিরোধী দলগুলির একাংশ মনে করে, অন্য কোনও ভাবে রাজ্যের সীমানা স্থির হলে দেশের প্রায় ৪৫ শতাংশ তথাকথিত উচ্চবর্ণের নেপালিভাষীর হাতেই আগের মতো ক্ষমতা কুক্ষিগত হবে। প্রসঙ্গত, নেপালকে মোটের উপর তিনটি জাতিগত অঞ্চলে ভাগ করা যেতে পারে। ভারত সংলগ্ন দক্ষিণের তরাই অঞ্চলে বা সমতলে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ বাস করেন। তাঁরা নেপালি ছাড়াও হিন্দি, মৈথিলি ও ভোজপুরি ভাষা ব্যবহার করেন।
বিহার, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড বা হিমাচল প্রদেশের অধিবাসীদের সঙ্গে এঁদের জীবনযাত্রায় বিস্তর মিল। নেপালের মধ্যাঞ্চল মূলত পাহাড়ি এলাকা। দেশের অধিকাংশ এলাকাই এই মধ্যাঞ্চলের অন্তর্গত, রাজনৈতিক প্রভাব এ যাবৎ পাহাড়িদেরই বেশি। অন্য দিকে, পার্বত্য উত্তরাঞ্চলের মানুষজনের সঙ্গে চিনের নিয়ন্ত্রাণাধীন তিব্বতের মানুষের মিল অনেক। ধর্মগত ও ভাষাগত সাদৃশ্যও রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে তরাই অঞ্চলকে ঘিরে পৃথক মধেশ রাজ্য গঠনের জোরদার দাবি উঠেছে। অন্য দিকে, অরুণ নদীর পূর্ব দিকের নয়টি জেলাকে নিয়ে আলাদা লিম্বু রাজ্যের দাবিতেও সরব অনেকে।
শাসক পক্ষের বক্তব্য, এমন দাবি মানা হলে নেপালের ঐক্য বিনষ্ট হবে। ঐক্যের প্রসঙ্গে পুনরায় রাজতন্ত্রের, এমনকী হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে সওয়ালও শুরু করেছে দু’একটি দল। উল্লেখ্য, কেউ কেউ আধুনিক নেপালের রূপকার ও শাহ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা পৃথ্বীনারায়ণ শাহের জন্মদিন ১১ জানুয়ারি ‘জাতীয় সংহতি দিবস’ পালনের দাবিও করেছেন।
সহমত হতে পারলে খুব ভাল। কিন্তু না পারলে? শবরীর প্রতীক্ষা? নয়াদিল্লি সহমতেরই পক্ষে। তা নিয়ে কাঠমান্ডুর শাসক পক্ষের অনেকে বেশ বিচলিতও। ২২ জানুয়ারির সময়সীমা পার হওয়ায় নিশ্চয়ই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি। কিন্তু অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ উদ্বেগজনক। নেপালের মানুষের পক্ষেও, ভারতেরও। সাতাশ বছর বাদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেপাল সফরে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী সে দেশে সাড়া জাগিয়েছিলেন বটে, কিন্তু এখন সংবিধান নিয়ে দিল্লির খবরদারি নেপালে অনেকের না-পসন্দ। এ বছর চিনের শীর্ষ নেতৃত্বের নেপাল সফরের সম্ভাবনাও ভারতকে উদ্বেগে রাখবে।
থমকে থাকা সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নেপালের আর্থিক বিকাশের হারকেও নিম্নগামী করেছে। বর্তমানে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ২২ শতাংশ— বছরে ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার— আসে অনাবাসী নেপালিদের মাধ্যমে। অনুপাতটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সংবিধানের প্রশ্নে সহমতে পৌঁছতে না পারলে ভবিষ্যতে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা, তা গণতন্ত্রকেও বিপন্ন করতে পারে। সংবিধান বা দেশের মৌলিক আইন রচিত হতে আরও দেরি হলেও সমূহ বিপদ। নেপাল তাই এখন এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক