প্রবন্ধ ২

না, আরব-ইহুদি বিরোধ ‘ঐতিহাসিক’ নয়

প্যালেস্তাইনে মুসলিম-ইহুদি সংঘাতের সূত্রপাত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে। কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে বরং দেখি, ইহুদিরা সেখানে মুসলিমদের পাশাপাশি দিব্যি বাস করেছেন, কখনও বা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেনও। নাজেস আফরোজকল্পনা করা যাক, একটি সমগ্র জাতিগোষ্ঠীর তিন থেকে চার লক্ষ মানুষকে একটি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। এই ঘিরে ফেলা বসতির বাসিন্দাদের গতিবিধির ওপর রয়েছে সব ধরনের বিধিনিষেধ। তারা এলাকা ছেড়ে যেতে পারে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share:

ধ্বংসের পরে। গাজা, ২৭ অগস্ট। ছবি: এএফপি।

কল্পনা করা যাক, একটি সমগ্র জাতিগোষ্ঠীর তিন থেকে চার লক্ষ মানুষকে একটি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। এই ঘিরে ফেলা বসতির বাসিন্দাদের গতিবিধির ওপর রয়েছে সব ধরনের বিধিনিষেধ। তারা এলাকা ছেড়ে যেতে পারে না। যে রাষ্ট্রশক্তি এই এলাকা দখল করেছে, তার সেনানীরা ইচ্ছেমত এখানকার মানুষকে ধরপাকড় করতে পারে, মাসের পর মাস তাদের জেলে রেখে দিতে পারে, তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে পারে বা ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিতে পারে। এই অত্যাচার এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছয় যখন ওই অবরুদ্ধ জনগোষ্ঠীর নারী এবং পুরুষ মিলে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন সামান্য কিছু রাইফেল, মলোটভ ককটেল আর কিছু হাতবোমা নিয়ে। পরিণতি অনুমান করা কঠিন নয়। শক্তিশালী অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত দখলকারী সেনাবাহিনী অবরুদ্ধ এলাকায় ঢুকে প্রতিরোধ চূর্ণ করে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালায়। নিহতদের বেশির ভাগই নিরস্ত্র মানুষ। শিশু, বৃদ্ধ আর মহিলা।

Advertisement

না, গত দু’মাস ধরে ইজরায়েলের নির্বিচার বোমাবর্ষণে যে ভাবে গাজায় দু’হাজারের ওপর নিরীহ মানুষের প্রাণ গেছে, এটা তার বর্ণনা নয়। ১৯৪৩-এ হিটলারের নাত্‌সি সেনা পোল্যান্ড দখল করার পরে সেখানকার ইহুদিদের ওপর যে অকথ্য অত্যাচার শুরু হয় তার কথাই আমি বলছি, আর ভাবছি সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে ইহুদিদের সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাহিনি। হিটলারের পোল্যান্ড দখলের পরে প্রায় প্রতিটি শহরে ইহুদিদের জন্য ‘গেটো’ তৈরি করা হয় পাঁচিল বা কাঁটাতার দিয়ে। সেই অবরুদ্ধ বস্তির ভিতর অত্যাচারিত ইহুদিরা এক সময় প্রতিরোধ গড়তে হাতে অস্ত্র নিতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। রাজধানী ওয়ারশতে বৃহত্তম গেটোয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি সব থেকে বেশি সময় ধরে লড়াই করেছে, প্রাণ দিয়েছে। নাত্‌সিদের চোখে এরা ছিল সন্ত্রাসবাদী।

সেই সাহসী প্রতিরোধকারীদের পরবর্তী প্রজন্ম ইহুদিদের রাষ্ট্র আজ প্রায় একই ভাবে গাজাতে একটি সশস্ত্র প্রতিরোধ চুরমার করতে নির্বিচার বোমাবর্ষণ বা সেনা অভিযান চালাচ্ছে। গাজায় নিহত শিশুদের মর্মান্তিক ছবি আজ বিশ্বের সামনে এসেছে, প্রায় গোটা পৃথিবী জুড়ে অধিকাংশ সরকার আর সাধারণ মানুষ এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দায় মুখর করছেন, তা বন্ধ করার দাবিতে সরব। হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফিরে আসা বহু অশীতিপর মানুষ ইজরায়েলের এই সামরিক অভিযানকে হিটলারের জমানার সঙ্গে তুলনা করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু ইজরায়েল রাষ্ট্র বা তার প্রধান সমর্থক মার্কিন সরকারের ভ্রুক্ষেপ নেই। তাদের এক বুলি: ইসলামি সন্ত্রাসবাদী প্যালেস্তিনীয় গোষ্ঠী হামাসের রকেট থেকে ইজরায়েলকে রক্ষা করতে এই সামরিক অভিযান জরুরি। বিপুল ধ্বংসের পরে আপাতত হয়তো মিশরের মধ্যস্থতায় একটা যুদ্ধবিরতি হতে পারে, কিন্তু তার ফলে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি আসবে, এমন আশা কেউ করছেন না।

Advertisement

গাজার ঘটনাবলিতে আবেগতাড়িত প্রতিক্রিয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এই আবেগ গোটা বিতর্কটাকে ইহুদি বনাম আরব মুসলিমের চিরকালের দন্দ্ব হিসেবে খাড়া করছে। সেটা খুব বড় ভুল। তিন হাজার বছরের ইতিহাসের খানিক চর্চা করলে দেখব, প্যালেস্তাইনে আরব মুসলিম আর ইহুদিদের ভিতর সংঘাতের ইতিহাস মোটেই চিরকালের নয়। বরং তা অতি সাম্প্রতিক ঘটনা।

এই সংঘাতের সূত্রপাত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে, তুরস্ককে পরাজিত করে যখন ইউরোপীয় শক্তিগুলি, বিশেষত ব্রিটেন পশ্চিম এশিয়ায় দখল নেয়। ১৯১৭ সালে প্যালেস্তাইনে পৃথক ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব তুলে তারা সেখানকার তত্‌কালীন সংখ্যাগুরু আরব মুসলিম আর সংখ্যালঘু আরব ইহুদিদের ভিতর বিভেদ তৈরি করে। এই প্রস্তাব আর ১৯২০-র দশকের মাঝামাঝি ইউরোপ থেকে প্যালেস্তাইনে বড় সংখ্যায় ইহুদি অভিবাসন এই দুই সম্প্রদায়ের ভিতর বিভেদকে প্রকট করে তোলে। এর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে জার্মানির হাতে ভয়াবহ ভাবে অত্যাচারিত ইহুদি জাতিগোষ্ঠী সেই পৃথক রাষ্ট্র গঠন করার উদ্দেশ্যে অস্ত্র ধরে যখন সফল হয়ে ওঠে, তখন থেকেই আরব মুসলিম আর ইহুদিদের ভিতর বিভেদ এক দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে পরিণত হয়।

এর আগে প্যালেস্তাইনবাসী মুসলিম আর ইহুদিদের সংঘাতের তেমন কোনও ইতিহাস মেলে না। বরং একাদশ শতাব্দী থেকে ইউরোপের খ্রিস্টান শাসকরা যখন তাঁদের পুণ্য নগরী জেরুসালেমকে মুসলিমদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য তিনশো বছরের ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড শুরু করেন, তখন মুসলিমদের পাশাপাশি প্যালেস্তাইনের ইহুদিরা ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে প্রবল লড়াই করেছে। ইহুদিদের প্রতিরোধে ইউরোপীয়রা বেশ কিছু শহরে পরাজিত হয়। ১০৯৯ সালে ইউরোপীয় যোদ্ধারা যখন প্রথম বার জেরুসালেমের দখল নেয়, সেই যুদ্ধেও নগর রক্ষার জন্য মুসলিম আর ইহুদিরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিরোধ গড়েছে। ইউরোপীয়রা ফরাসিদের নেতৃত্বে জেরুসালেমে ঢুকে এক অবর্ণনীয় হত্যাকাণ্ড চালায়। মুসলিমদের রক্তে নগর ভাসে আর ইহুদিরা শেষ আশ্রয় হিসেবে নগরের এক সিনাগগে আশ্রয় নেন। সেই সিনাগগে আগুন ধরিয়ে ইউরোপীয়রা ওই ইহুদিদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারে।

সেই সময় থেকে পশ্চিম এশিয়া আর ইউরোপের ইতিহাস চর্চা করলে দেখা যাবে, ইহুদিদের ওপর বহু শত বছর ধরে যে সব অত্যাচার হয়েছে তাতে আরব মুসলিমদের কোনও ভূমিকা নেই। বরং সেই ক্রুসেড থেকে ১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত ইহুদি নিপীড়নের হোতা হল রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠান আর ইউরোপীয় শাসককুল। অথচ এই মুহূর্তে প্যালেস্তাইন বিতর্কটি অতি সুচারু রূপে মুসলিম-ইহুদি সংঘাতের মোড়কে পরিবেশন করা হচ্ছে এবং সেটি এই বিতর্কের সারবস্তুতে পরিণত হয়েছে। জাতিসত্তার দ্বন্দ্বকে ধর্মীয় সংঘাতের আধারে দেখাতে উদ্গ্রীব ইজরায়েল। হামাসের মতো একটি কট্টর ইসলামপন্থী দলের নেতৃত্বে ইজরায়েলে রকেট হানার পিছনে শুধুই ধর্মীয় আক্রোশ কাজ করছে এই গল্পটি বারে বারে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।

এই প্রসঙ্গে হামাসের উত্থান নিয়ে কিছু বলা দরকার। ১৯৪৮ সালে নিজ ভূমি থেকে উত্‌খাত হওয়ার পর থেকে ইয়াসের আরাফতের অধীনে পি এল ও এবং অন্য যে সব দল বা সংগঠন প্যালেস্তিনীয়দের অধিকার নিয়ে আন্দোলন ও প্রচার শুরু করে, সেগুলি সব ক’টি ছিল বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনীতির অনুসারী। সেই সব সংগঠনে প্যালেস্তিনীয় মুসলিম ছাড়াও প্যালেস্তিনীয় খ্রিস্টানরা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। তাদের প্রচার বা আন্দোলনে কোথাও কখনও বলা হয়নি যে তারা শুধু মুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। কিন্তু ইজরায়েলের আগ্রাসী ও আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ায় এবং আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলি থেকে কোনও সমর্থন না পাওয়ার ফলে এই সংগঠনগুলি ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এর পরিণতিতে তারা বৃহত্তর প্যালেস্তিনীয় জনগণের সমর্থনও হারাতে শুরু করে। আর তাতে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয় সেখানে ১৯৮৭ সাল থেকে কট্টর ইসলামী ভাবাদর্শে দীক্ষিত হামাস একটি বড় শক্তি হয়ে উঠে আসতে থাকে। তাদের জঙ্গি মনোভাব গাজার জনগণকে এতটাই প্রভাবিত করে যে ২০০৬ সালে প্যালেস্তিনীয় সংসদের নির্বাচনে তারা হামাসকে জয়ী করায়। তাই হামাসের উত্থানের পিছনে ইজরায়েলের আগ্রাসন ও প্যালেস্তিনীয় সমস্যা সমাধানে পশ্চিমী দেশগুলির ব্যর্থতার একটা বড় ভূমিকা আছে।

আর ইতিহাসের নির্মম পরিহাস, তিন হাজার বছর ধরে যে অত্যাচারিত ইহুদি জনগোষ্ঠী বারে বারে প্রতিরোধের রাস্তা দেখিয়ে এসেছেন, তাঁরাই আজ অত্যাচারীর ভূমিকা নিয়েছেন আর তাঁদের থেকেই শিক্ষা নেওয়া প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন। মিশরের ফারাওদের অত্যাচার থেকে মোজেস যখন ইহুদিদের মুক্তির পথ দেখান, সেটা ছিল তাঁদের প্রথম প্রতিরোধ। তার পরে বাইবেলের গল্পে ইহুদিদের ভাবী রাজা ডেভিড দানবাকৃতি গোলিয়াথের মুখোমুখি হয়ে একটি পাথর ছুড়ে তাকে কাবু করেন। ক্রুসেডের সময়ও তাঁদের প্রতিরোধ ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও নাত্‌সিদের বিরুদ্ধে ইহুদিরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পিছপা হননি। কিন্তু আজকের ইজরায়েল, ডেভিড নয়, গোলিয়াথের উত্তরসূরি। কিশোর প্যালেস্তিনীয়রা ইট-পাথরের টুকরো নিয়ে ইজরায়েলি ট্যাঙ্কের মোকাবিলা করছে। হয়তো হামাসের মতো একটি ভুল নেতৃত্বের অধীনে তাদের প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে কিন্তু তার দায় তো তাদের নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement