কাদের জন্য? ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র প্রকাশ অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদী।
গরিব মানুষকে অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে সময় লেগেছিল দশ বছর। মাত্র ছ’মাসে ফের তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া গেল পুরনো জায়গায়। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সবচেয়ে বড় সাফল্য অর্থনীতির আলোচনার মুখ ঘুরিয়ে দেওয়াটাই।
মানুষকে ‘সক্ষম’ করে তোলার জন্য যে প্রাথমিক জিনিসগুলোর প্রয়োজন, সম্ভবত সনিয়া গাঁধী এবং তাঁর ‘ঝোলাওয়ালা’ পরামর্শদাতাদের চাপেই সেগুলোর ওপর গরিব মানুষের অধিকার স্বীকার করে নিয়েছিল ইউপিএ। শিক্ষার অধিকার, খাদ্যের অধিকার, কাজের অধিকার। এখানে অধিকার শব্দটার ওপর জোর দেওয়া জরুরি। রাষ্ট্র দয়া করে সস্তায় খাবার দেবে, সেটা এক কথা, আর রাষ্ট্রের কাছে খাবার দাবি করার অধিকার মানুষের থাকবে, সেটা আর এক। এই অধিকারগুলো আসলে দেশের সমৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের হিস্যার স্বীকৃতি। যারা বাজারে যোগ দিতে পারে না সামর্থ্যের অভাবে, বাজারের লাভের একটা, অবশ্য যত্সামান্য, অংশ তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পথ।
ইউপিএ সেই পথগুলো খুলেছিল। তাতে আরও একটা কাজ হয়েছিল— অর্থনীতি সংক্রান্ত আলোচনাগুলো হচ্ছিল মূলত এই সর্বজনীন উন্নয়নের চৌহদ্দিতে। সবাই যে সমর্থন করছিলেন, তা নয়— জগদীশ ভগবতী সাক্ষী দেবেন। কিন্তু তাঁরাও বাধ্য হচ্ছিলেন গরিব মানুষের উন্নতির প্রশ্নটাকে কেন্দ্রে রেখেই আলোচনা করতে। ভর্তুকির পথে গরিবের ভাল হয়, না কি বাজারের পথে, না কি দুইয়ের মাঝখানে নতুন কোনও রাস্তা আছে, তর্ক হচ্ছিল। গরিবের কাছে সস্তায় চাল-গম পৌঁছে দেওয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পন্থা কী, খোঁজ চলছিল।
মোদী ম্যাজিকে এই আলোচনাটা হঠাত্ উবে গেছে। তিনি ক্ষমতায় আসার পর খাদ্যের অধিকার নিয়ে গোটা তিনেক বাক্যও ব্যয় করেননি। শিক্ষার অধিকার বিস্মৃতপ্রায়। ১০০ দিনের কাজের অধিকারের ডানা কতখানি ছাঁটা হবে, সেই হিসেবনিকেশ চলছে। আর, আলোচনার মুখ ঘুরে গিয়েছে সংস্কারের দিকে। মানে, কোন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কতখানি বেচে দেওয়া যায়, বিমা আর খুচরো ব্যবসায় বিদেশি পুঁজির জন্য দরজা কত শতাংশ ফাঁক হবে— এই সব প্রশ্নে। প্রশ্নগুলো একেবারেই অচেনা নয়। ইউপিএ-র জন্মের বহু আগে অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, পালানিয়াপ্পন চিদম্বরম বা বিলগ্নিকরণ মন্ত্রী অরুণ শৌরিদের আমলে এই প্রশ্নগুলোই থাকত আলোচনার কেন্দ্রে। নরেন্দ্র মোদী ভারতকে সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম সারির বিনিয়োগকারীরা রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর তাঁর উদ্দেশে বলছেন, এখনও মন ভরেনি। আরও জোর কদমে সংস্কারের দিকে হাঁটুন। এই চিত্রনাট্যে গরিবের পার্শ্বচরিত্রের ভূমিকাও জোটে না। সংস্কারের বিজয়রথের চাকায় সমৃদ্ধির যে ধুলো উড়বে, ‘ট্রিকল ডাউন এফেক্ট’ নামক বাতিল আর্থিক তত্ত্বের ঘুলঘুলি দিয়েই নাকি তাদের কাছে সেই সমৃদ্ধির খানিক পৌঁছোবে। চমত্কার! ধরা যাক দু’একটা বিদেশি বিনিয়োগ এ বার।
ইউপিএ-র আমলে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে গরিব মানুষের অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল বটে, কিন্তু সেটা হয়েছিল সনিয়া গাঁধীসহ কংগ্রেসের বড়কর্তাদের হৃদয় গরিবের প্রতি করুণায় দ্রব হয়ে থাকত বলে নয়। এখনও, উদার অর্থনীতির উদ্বোধনের দু’যুগ পরেও, ভারত মূলত গরিব মানুষেরই দেশ। ভোট-পার্বণে তাদের গুরুত্ব অসীম। কাজ, খাদ্য বা শিক্ষার অধিকারের বিনিময়ে কংগ্রেস তাদের ভোটের প্রত্যাশায় ছিল। তাতে অন্যায় নেই। যে কাজে সত্যিই গরিবের উপকার, নিছক ভোটের আশাতেও সেটা করা ভাল কাজ। প্রশ্ন হল, বিজেপির কি এই ভোট দরকার নেই? দেশের সত্তর শতাংশ ভোটারকে বাদ দিলে তাদের চলবে? যদি না-ই চলে, কীসের ভরসায় চলেছেন নরেন্দ্র মোদী?
এই প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর, স্বভাবতই, পাওয়া মুশকিল। তবে অনুমান করা সম্ভব। সেই অনুমানের প্রথম ধাপ গত লোকসভা নির্বাচন অথবা সাম্প্রতিক কিছু বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল। লোকসভায় কংগ্রেসের ৪৪টা আসন, অথবা বিহারে নীতীশ কুমারের ধরাশায়ী হওয়া, অথবা রাজস্থানে অশোক গহলৌতের পরাজয় একটা কথা স্পষ্ট করে দেয় শুধু গরিব মানুষের উন্নয়নের ব্যবস্থা করে ভোটের বৈতরণী পার করা মুশকিল। হয়তো এই প্রাপ্তিগুলোকে মানুষ তাদের স্বাভাবিক পাওনা হিসেবে দেখে বলেই। বা হয়তো অন্য কোনও কারণে। কিন্তু, ভোটের জন্য যে গরিবের উন্নয়নের চেষ্টার প্রয়োজন নেই, কথাটা দেশের গরিব মানুষই ব্যালট বাক্স বাজিয়ে ঘোষণা করে দিয়েছেন। কাজেই, অর্থনীতির খাসমহলে অন্যদের ঠাঁই করে দিতে নরেন্দ্র মোদীর খুব বেশি ভাবনার প্রয়োজন হয়নি।
তা হলে ভোট আসবে কোন পথে? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানেই তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় অনেকটা এগিয়ে আছে বিজেপি-সংঘ যুগলবন্দি। আসলে যে গরিব পরিচয়টাই একমাত্র নয়, তাদের মধ্যেও হিন্দু-মুসলমান আছে, দলিত-উচ্চবর্ণ আছে, হতদরিদ্র-উচ্চাকাঙ্ক্ষী আছে, সিপিএম-তৃণমূল আছে— এই হিসেবগুলো এক বারের জন্যও গুলিয়ে যেতে দেয়নি তারা। কার মন কোন মন্ত্রে জয় করা যাবে, আর কাকে ভয় দেখানো যাবে কোন জুজুতে, সেই ছক যে কাটা আছে নিখুঁত ভাবে, সেটা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
যাঁরা ছাপান্ন ইঞ্চির ছাতির উন্নয়নক্ষমতায় বিশ্বাসী, তাঁদের জন্য ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র স্লোগান আছে। মার্কিন বিগ ফার্মার পায়ে গরিবের স্বার্থ সঁপে দিয়েও যদি বিদেশি বিনিয়োগ ঢোকে দেশে, উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের সমস্যা নেই। তাঁদের মনপসন্দ গ্লোবাল ভারতের জন্য ডেডিকেটেড ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডর আছে, স্মার্ট সিটি আছে, বুলেট ট্রেন আছে। সবই খাতায়কলমে, তুবও।
কিন্তু, সেই ইন্ডিয়ার মোড়কের নীচে সযত্নে সনাতন হিন্দু ভারতকেও রেখেছেন মোদী। শাইনিং ইন্ডিয়ায় যাঁদের অধিকার নেই, তাঁদের জন্য ধর্ম আছে, জাত আছে, রাজনৈতিক বিরোধ আছে। ভোটের স্বার্থেই। সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি, যাঁর সাম্প্রতিক সর্বভারতীয় খ্যাতির একমাত্র কারণ তাঁর ‘রামজাদে’ ভাষণ, সেই স্বার্থের প্রতীক। ২০১২ সালে প্রথম বিধায়ক হয়েছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে প্রথম বার সাংসদ। পাঁচ মাসের মাথায় তাঁকে মন্ত্রী করতে হল কেন? শুধু হিন্দুত্ববাদে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। সাধ্বী জাতে নিষাদ, উত্তর প্রদেশের অন্ত্যজতম শ্রেণির প্রতিনিধি। মুলায়ম সিংহ এবং মায়াবতীর বাইরে নিম্নবর্গের যে ভোটব্যাঙ্ক, তার কাছে সাধ্বীর হিন্দুত্বের শীর্ষমহলে উত্তরণ এবং মন্ত্রিত্ব অর্জনের বার্তাটি অমোঘ। উচ্চবর্গের হিন্দুত্বের মঞ্চে তাদের পা রাখার ছাড়পত্র। বিহারের গিরিরাজ সিংহ আবার উচ্চবর্ণ ভূমিহার। তাঁকেও মন্ত্রী করেছেন মোদী, নির্বাচনের সময় সুতীব্র মুসলমান বিরোধী ভাষণের অতীত সত্ত্বেও। অথবা বলা ভাল, ঠিক সেই কারণেই। ঠিক যেমন ধর্ষণের অভিযোগে জেল খাটা সাক্ষী মহারাজ, অথবা কল্পিত লাভ জেহাদের প্রবক্তা যোগী আদিত্যনাথ লোকসভায় শাসক দলের বেঞ্চ আলো করে বিরাজ করেন।
এত দিনে স্পষ্ট, আগরায় যে জনগোষ্ঠীর ‘ঘর ওয়াপসি’ হল, অন্তত ভারত তাদের ‘ঘর’ নয়। তবুও রাজনৈতিক নাটকটি হল, সেটাও ভোটব্যাঙ্কের কাছে স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্যই— এত দিনে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার সুবন্দোবস্ত হয়েছে। এ দিক ও দিকের খুচরো দাঙ্গা, সন্ত্রাসেরও শিকড় সেই বার্তাতেই। অথবা, পশ্চিমবঙ্গ আর অসম ঘুরে হিন্দু শরণার্থীর সঙ্গে মুসলমান অনুপ্রবেশকারীর পার্থক্যনির্ণয়েরও। সরকারি স্কুলের ওপর সংস্কৃত ভাষা চাপিয়ে দেওয়ায়, গণেশকেই প্লাস্টিক সার্জারির প্রথম উদাহরণ হিসেবে ঘোষণা করায়, ভগবদ্গীতাকে জাতীয় গ্রন্থের মর্যাদা দেওয়ার বাসনায়, গাঁধীর যাবতীয় পরধর্মসহিষ্ণুতাকে ঢেকে রেখে তাঁকে নিছক স্বচ্ছতার প্রতীক বানিয়ে ফেলায়— গোটা দেশের মানচিত্রের ওপর খাকি হাফপ্যান্টের কুচকাওয়াজ চলছে। মোদী বনাম সংঘের দ্বৈরথ নয়, বরং মোদী ও সংঘের নিখুঁত পারস্পরিকতায়। মনের গহনে চোরা সাম্প্রদায়িকতা নিয়েও যাদের নেহরুতান্ত্রিক ভারতকে মেনে নিতে হয়েছিল, তাদের ভোট নিয়ে ভাবতে হবে কি আর?
কিন্তু, সেই হিন্দুত্ববাদই বিজেপির একমাত্র অস্ত্র নয়। পশ্চিমবঙ্গের উদাহরণটি দেখুন। শুধু হিন্দুত্ববাদের সাম্প্রদায়িকতা দিয়েই যে এই রাজ্যের অনেকখানি দখল করে নেওয়া সম্ভব, বিজেপি ইতিমধ্যেই প্রমাণ করে দিয়েছে। কলকাতার রাজপথে ‘আমরা সবাই হিন্দু’ লেখা পোস্টার পড়ছে, অমিত শাহের জনসভায় লোক উপচে পড়ছে, মোহন ভাগবত্ আসছেন এই শহরে সভা করতে— সবই তো হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের বোধহীন মুসলিম-তোষণ তাদের জায়গা করে দিয়েছে, সেই ফাঁক গলে বিজেপিও সাম্প্রদায়িক তাস খেলে চলেছে বেমালুম। তবুও, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রধান অস্ত্র হিন্দুত্ববাদ নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই। তাতে হিন্দুত্ববাদের ফোড়ন আছে বিলক্ষণ, কিন্তু মূল মশলা পশ্চিমবঙ্গের প্রচলিত আমরা-ওরা’র রাজনৈতিক তরজা। কাশ্মীরে যেমন ৩৭০ ধারা বিলুপ্তির দাবির বদলে উন্নয়নের ঢাক পিটিয়ে এসেছেন নরেন্দ্র মোদী, উপত্যকার মুসলমান ভোটে ভাগ বসানোর বাসনায়, পশ্চিমবঙ্গেও তেমন হিন্দুত্ববাদী খণ্ডজাতীয়তার চেয়ে অনেক চড়া সুরে বাজছে তৃণমূল বিরোধিতার রাজনীতি।
কিন্তু, ভারতীয় রাজনীতি সাক্ষী, নেতারা ভাবেন এক, আর জল গড়ায় সম্পূর্ণ ভিন দিকে। নরেন্দ্র মোদীরা যে তাস বিছিয়ে বসেছেন, তার অনেকগুলোরই পরস্পরবিরোধী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। নিরঞ্জন জ্যোতিদের জায়গা করে দিতে গিয়ে যদি অর্থনীতি ধাক্কা খায়, দ্রুত কর্মসংস্থান না বাড়ে, ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতিতে ভরসা কমবে না তো? হিন্দুত্বের ছাতার তলায় উচ্চ আর নিম্নবর্ণের পুরনো সংঘাত ফিরবে না তো নতুন চেহারায়? অথবা, নরম মুসলমান-তাস খেলতে গিয়ে সংঘের সঙ্গে মনান্তর হবে কি বিজেপি-র?
প্রশ্নগুলো থাকছে। উত্তর খুঁজতে হবে যাঁকে, সেই নরেন্দ্র মোদী এখনও অবধি দারুণ দক্ষ ম্যানেজার হিসেবেই নিজেকে চেনাতে পেরেছেন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা হিসেবে নয়। এই প্রশ্নপত্রের সামনে পড়লে কত নম্বর উঠবে তাঁর পরীক্ষার খাতায়, সেটাই আগামী কয়েক বছর ভারতীয় রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করবে।