ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিকে কি বিদায় জানাবেন মোদী

বেড়াল যদি বলে মাছ খাব না, কাশী যাব, তা হলে বিশ্বাস করা শক্ত। তবু আশায় বাঁচে চাষা। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর নয় মাস অতিবাহিত। এখন তাঁকে ঠিক করতে হবে, তিনি দেশশাসন ও সক্ষম প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করবেন, না কি সক্ষম প্রশাসনের পাশাপাশি কী ভাবে বিজেপি ভোটে জিততে পারে, সেই বাধ্যবাধকতা মাথায় রেখে কাজ করে চলবেন!

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৫ ০০:০১
Share:

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর নয় মাস অতিবাহিত। এখন তাঁকে ঠিক করতে হবে, তিনি দেশশাসন ও সক্ষম প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করবেন, না কি সক্ষম প্রশাসনের পাশাপাশি কী ভাবে বিজেপি ভোটে জিততে পারে, সেই বাধ্যবাধকতা মাথায় রেখে কাজ করে চলবেন!

Advertisement

আপাত ভাবে ব্যাপারটা খুব নিরীহ মনে হলেও, আসলে ততটা নয়। আগামী নভেম্বরে বিহারে নির্বাচন। তার পরেই এসে যাবে পশ্চিমবঙ্গের ভোট। পাশাপাশি অন্য কয়েকটি রাজ্যেও ভোট রয়েছে। ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে খুব ভাল ফল করেছে। কাশ্মীরেও পিডিপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে একটা সরকার গড়েছে তারা। তা সেই সরকার নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন! কিন্তু, দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরীবালের উত্থান বিজেপির সমস্ত অঙ্ক বদলে দিয়েছে। অমিত শাহের নেতৃত্বে যে মেরুকরণের রাজনীতির উপর নির্ভর করে বিজেপি ভাল ফল পেতে চেয়েছিল, সেই রণকৌশল নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

গত লোকসভা নির্বাচনে এই ধর্মীয় মেরুকরণের কৌশল উত্তরপ্রদেশে ভাল ফল এনে দিয়েছিল। ৮০টির মধ্যে ৭১টি আসন পেয়েছিল বিজেপি। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের মূলধনই হিন্দুত্ব। এবং সেই হিন্দুত্বের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা যা-ই হোক না কেন, সেটা কিন্তু এক ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠবাদের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। সংখ্যালঘু তোষণ, মেকি ধর্মনিরপেক্ষতা এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন— এটাই বিজেপি-র অভিমুখ। এর ফলে উত্তরপ্রদেশে যখন হিন্দু জাঠ বনাম সংখ্যালঘুদের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয় এবং তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য প্রান্তে, তখন সেটা কিন্তু বিজেপি-র হাত শক্ত করে। দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের আগে একের পর এক গির্জায় হামলা, সাধ্বী নিরঞ্জনের ‘হারামজাদা’ উক্তি, হিন্দুদের চার সন্তান মন্তব্যকে বিশেষ একটা গুরুত্ব দেননি বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। তাঁরা মনে করেছিলেন, এই সব সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং দলীয় নেতাদের অন্তর্কলহ ধুয়েমুছে যাবে। এক দিকে মোদী-হাওয়া, অন্য দিকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কৌশল ভোটে ফায়দা এনে দেবে। কিন্তু, বাস্তবে তা হয়নি। ফলে, কেজরীবাল নামে একটি ‘ফেনোমেনন’-এর উত্থান হয়েছে। আর সেই কেজরীবাল আসলে আমজনতার প্রতিনিধি। ফলে, মোদী সরকার সম্পর্কে দিল্লিতে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে, সরকার যতটা ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজমের’ পক্ষে, ততটা আমজনতার পক্ষে নয়।

Advertisement

জম্মু-কাশ্মীরে সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে মুফতি মহম্মদ সঈদকে মুখ্যমন্ত্রী করে বিজেপি অবশ্য একটি ভিন্ন রণকৌশল নিয়েছে। সংবিধানের ৩৭০ ধারা থেকে শুরু করে কাশ্মীরের বিতর্কিত বিষয়গুলিকে আপাতত শিকেয় তুলে, রাজ্যপালের শাসন পাকাপোক্ত ভাবে কায়েম না করে সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করেছে বিজেপি। এই ঘটনা সঙ্ঘের কট্টরপন্থীদের ভাল লাগেনি। লাগতে পারে না। কারণ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সময় থেকে তাঁরা ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির কথা বলে আসছেন। কাজেই রণকৌশল যা-ই হোক না কেন, কট্টরপন্থীরা তা মেনে নিতে পারছেন না। তা সে আরএসএস থেকে বিজেপিতে আসা রাম মাধবের মতো নেতা যতই অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির দোহাই দিন না কেন। তা ছাড়া, ভোটের আগে জম্মুর হিন্দু ভোট, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ইস্যুগুলি নিয়ে মেরুকরণের রাজনীতি হয়েছে। ভোটের পর সেই অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ উল্টো পথে বিজেপি-র চলে যাওয়াটা অনেকেরই সংশয় বাড়িয়েছে।

যদিও প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত ভাবে নিজের মডেলেই কাশ্মীরে কাজ করার ব্যাপারে যথেষ্ট সক্রিয়। ভারতের বিদেশ সচিব পাকিস্তানে গিয়েছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে আবার একটি শান্তিপ্রক্রিয়া গড়ে তোলা হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে ভারতীয় বহুত্ববাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে অনেক বেশি মর্যাদা দিতে হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন, সংকীর্ণ রাজনীতিকে অগ্রাধিকার না দিয়ে গুরুত্ব দিতে হবে সক্ষম প্রশাসন গড়ে তোলার কাজে।

ভারতবর্ষ ঐতিহাসিক ভাবে এক বহুত্ববাদী রাষ্ট্র। অশোক থেকে আকবর— এ দেশে সব সময় দেখা গিয়েছে নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান। আসলে বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্য। কাজেই নতুন ভারত এবং সক্ষম প্রশাসন গড়ে তুলতে গেলে মোদীকেও গুরুত্ব দিতে হবে বহুত্ববাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে। তিনি সংখ্যালঘুদের দেওয়া টুপি পরলেন কি পরলেন না, সেটা বড় কথা নয়। প্রশাসনকে আমজনতার কাছে পৌঁছনোর জন্য তিনি সত্যিই সর্ব ধর্মসমন্বয় করছেন কি না, প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষকে আধুনিক ও শিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি দারিদ্রমুক্ত করার কাজে কতটা জোর দিচ্ছেন, এখন সেটাই দেখার।

বৃদ্ধি এবং বিকাশ, উন্নয়ন এবং শিল্পায়নের রথ যদি সত্যিই মোদীকে চালাতে হয়, তা হলে বিজেপি-র গতানুগতিক হিন্দুত্বের মেরুকরণের রাজনীতিকে বিদায় জানাতে হবে। অনেকেই সন্ধিগ্ধ। তাঁরা বলছেন, বেড়াল যদি বলে মাছ খাব না, কাশী যাব, তা হলে তা বিশ্বাস করা শক্ত। তবু আমি বলব, আশায় বাঁচে চাষা!

ছবি: পিটিআই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement