সম্ভাবনার জন্ম। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বাম নেতাদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০ মে, ২০১১। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
কিছু দিন আগে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, ভবিষ্যতে বামপন্থীদের সঙ্গে ঐক্য সম্ভব। এর উত্তরে বামপন্থী নেতৃবৃন্দ এক সুরে বলেছেন, ঐক্য হবে বামপন্থীদের নিয়ে। তৃণমূলের সঙ্গে একতা সম্ভব নয়। সে নিয়ে ভাবার প্রয়োজনও নেই। অন্যদের নিয়ে একসঙ্গে ভাবার এমন কোনও ক্ষণ এখন আসবে বা আসা সম্ভব হবে বলে তাঁরা মনে করেন না।
পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং অন্যতম বামপন্থী নেতা আর এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, তৃণমূল হিংস্র, দৌরাত্ম্যকারী দল। তাদের মূল্যবোধ নেই। তারা কি কোনও রাজনৈতিক দল যে তাদের সঙ্গে ঐক্য সম্ভব? ‘ওদের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হবে’, এই হল ঐক্যের সম্ভাবনা নিয়ে তাঁর প্রত্যুক্তি। অন্য দিকে, প্রধানতম বামপন্থী দলের মহাসচিবের বক্তব্য, বামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধ হোন, সংহত হোন। ঐক্যের পরিধি এটাই।
নিজের চিন্তাপদ্ধতির এবং গঠনপদ্ধতির কঠোরতাকে শিথিল বা নমনীয় না করে কি অন্যদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়া যায়? একসঙ্গে ভাবা সহজে আসে না, অন্য দশটা চিন্তাপদ্ধতির মতোই তাকে শিখতে হয়। একসঙ্গে ভাবা আবার এক অর্থে মানুষের স্বাভাবিক মননপদ্ধতি। শিল্পীরাও একসঙ্গে ভাবেন, মহাকাব্য একসঙ্গে লেখা হয়। একই লেখা রচনার মধ্যে লেখক এবং সম্ভাব্য পাঠককুলের চিন্তা-বিনিময় হতে থাকে। আমরা একসঙ্গে ভাবি, কিন্তু চিন্তার গহনে চিন্তাকারী হিসেবে আমরা একা। সংক্ষেপে বলা চলে, আমরা একেবারে একা ভাবি না, আমরা একসঙ্গে ভাবি, একাও ভাবি। আমাদের চিন্তাভাবনায় যে বহির্জগতের ছাপ পড়বে, তাকে ঠেকাবে কে? একসঙ্গে ভাবার অর্থ চিন্তার স্বকীয়তার বিসর্জন নয়। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নিজস্ব দলের বা নিজের চিন্তার বিশিষ্টতা বজায় রাখতে গিয়ে যে পবিত্রতার কল্পনা করেছেন, ওতে শুধু উন্নাসিকতা প্রকাশ পায়। একসঙ্গে ভাবা নিয়ে স্বচ্ছ দৃষ্টির কোনও পরিচয় তাঁর মন্তব্য বহন করে না।
একসঙ্গে ভাবার কিছু প্রাথমিক শর্ত নিশ্চয়ই থাকে। বাজারে, দলে, ঘরে, অফিসে, সান্ধ্য বৈঠকে, সভায়, সমিতিতে আমরা যে আলাপচারিতায় প্রবৃত্ত হই, তারও কিছু ন্যূনতম ভিত্তি থাকে। সেই ভিত্তি আমাদের সংলাপে, আলাপচারিতায় প্রবৃত্ত করে। সেই আলাপচারিতার মধ্যে যেমন পুরনো ধ্যানধারণা বা সত্যের পুনরুচ্চারণ থাকে, তেমনই মতের সংঘাত থাকে, অমিল থাকে, নতুন ধ্যানধারণা এবং সত্যের হাতছানি থাকে। এই আলাপচারিতা একসঙ্গে ভাবার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। সিপিআই(এম) এবং তৃণমূলের রাজনৈতিক ভিত্তিতে কি সেই রকম ন্যূনতম রাজনৈতিক মিল নেই? এই দুই রাজনৈতিক শক্তি খুচরো ব্যবসায় বহুজাতিক পুঁজির বিরোধিতা করে। এই দুই শক্তি সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরোধিতা করে। দু’জনেই কংগ্রেসের শাসনের মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি এবং বৃহত্ পুঁজির প্রসারের নীতির বিরোধিতা করেছে। এই দুই শক্তিই রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা চায়। দুইয়েরই সামাজিক ভিত্তি হল অসংখ্য ক্ষুদ্র উত্পাদককুল। এরা দু’জনেই পথ খুঁজে চলেছে, প্রত্যন্তবাসী হয়ে এই রাজ্য শিল্পায়নের কোন পথ অবলম্বন করবে?
অবস্থানগত মিল থাকলেও ভোট, সরকার, ক্ষমতা এবং জনসম্পদ ও অর্থসম্পদ এই চারের বাধ্যবাধকতা কী ভাবে একই সামাজিক ভিত্তিতে অবস্থিত দুই শক্তিকে আলাদা রাখতে পারে, তার এক আশ্চর্য উদাহরণ তৃণমূলের সঙ্গে ঐক্যের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে বামপন্থী নেতৃবৃন্দের তীব্র প্রতিক্রিয়া। সন্দেহ হয়, ঐক্যের কথা কোন স্বার্থে আঘাত করছে? নমনীয়তার অভাব এবং সংলাপে অনীহা কোন অবক্ষয়কে লুকিয়ে রেখেছে?
রাজ্যপাট চালানোর ক্ষেত্রে, যুদ্ধ না শান্তি কোন নীতি কখন নেওয়া প্রয়োজন, বিভেদ সত্ত্বেও সংলাপ চালানো যায় কি না, এ নিয়ে মহাভারতে নানা আগ্রহোদ্দীপক ব্যাখ্যা আছে। ধৃতরাষ্ট্রদূত সঞ্জয়ের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের অন্যতম উক্তি ছিল: অনেক দূর দেখেছি, আরও দেখতে রাজি ছিলাম। কিন্তু অধর্মের পথ থেকে তোমরা সরলে না, তাই যুদ্ধ অনিবার্য। অন্য দিকে, যুদ্ধ শেষে যখন হাজার হাজার শব চার পাশে পড়ে আছে, যুধিষ্ঠির শোকে মুহ্যমান, তখন শরশয্যায় শায়িত ভীষ্ম পাণ্ডবদের যুদ্ধের পরিণাম বিষয় কোনও শিক্ষা দিলেন না। বরং মারা যাবার আগে জয়ী পাণ্ডবদের বললেন, রাজ্যপাটে মন দাও, সুশাসনের জটিলতা আয়ত্ত করো। রাজনীতি, ধর্মাচরণ এখন এইটাই। মহাভারতে যুদ্ধ এবং শান্তি আবেগ বা ধর্মের প্রতীক নয়, বিচক্ষণতার প্রতীক। আজকের ভাষায়, ওই বিচার হল কাজের ব্যাপার। প্র্যাকটিকাল জিনিস। ওতে আবেগ না মেশানোই ভাল।
যুদ্ধ, শান্তি, মিত্রতা, কলহ এ সব নিয়ে মহাভারতের প্রাজ্ঞতা আমাদের দেশের স্বদেশি বিপ্লবী এবং চিন্তানায়করা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তাঁদের পত্রিকার পাতায় স্বদেশি চিন্তায় নানা ক্ষেত্রে এই বিচক্ষণতার রেশ পাওয়া যায়।
বিচক্ষণতা থেকে আসে আলাপচারিতা। এই প্রাজ্ঞ মনোভাব যে, দেখাই যাক না কথা বলে কোনও মতৈক্য পাওয়া যায় কি না, বৃহত্তর স্বার্থে একসঙ্গে ভাবার কোনও ন্যূনতম ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় কি না। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহে বিদেশি সৈন্যশক্তি দ্বারা অবরুদ্ধ দিল্লি শহরে ওয়াহাবি বিদ্রোহীরা হিন্দু শহরবাসীদের উদ্দেশ্যে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিল। বলেছিল, অধর্মের বিরুদ্ধে এক হওয়া যাক, যদিও হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। গাঁধী এবং জিন্নাহ্ ১৯১৬-য় লখনউ চুক্তি করেছিলেন। কারান্তরালে, বন্দিশিবিরে কমিউনিস্ট এবং স্বদেশি বিপ্লবীরা নানা আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। নাগা বিপ্লবী নেতা মুইভা সতেরো বছর ধরে ভারত সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন শান্তি এবং স্বীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করতে। কথাবার্তার দরজা বন্ধ করা রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেয় না।
নয়া উদারনীতিবাদী যুগে একসঙ্গে ভাবার প্রয়োজন আরও বেশি। আমরা দরিদ্র দেশের মানুষ হিসেবে যে-সব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি, তার কিছু হয়তো পুরনো, কিন্তু বেশ কিছু সমস্যাই অভিনব এবং দুরূহ। বাজার অর্থনীতির যুক্তি সমাজের সমস্ত দিক গ্রাস করছে, শুধু তা-ই নয়, আমাদের জনসাধারণের অংশ ভাবতে শুরু করেছে, বাজার অর্থনীতির যোগ্য হয়ে ওঠা ছাড়া দেশ-জাতির সামনে অন্য বিকল্প নেই। রাষ্ট্র অপদার্থ, সরকার অকর্মণ্য, সরকারি পরিষেবা অর্থহীন। এমন অবস্থায় জনসাধারণ ও নানা রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সংলাপ থেকে সরে গিয়ে বামপন্থীদের কী লাভ হবে?
গণপরিসর যেখানে ক্রমঃসংকুচিত, সেখানে টেলিভিশনের বাগ্বিতণ্ডায় আলাপচারিতাকে সীমাবদ্ধ করে আমরা জনপরিসরের সীমা প্রসারিত করব কী করে? আমাদের নিজস্ব আচার-আচরণে যে শক্তিকেন্দ্রিক সংস্কৃতির বিরোধিতা করি, সেই শক্তিকেন্দ্রিক সংস্কৃতিরই কি প্রতিফলন আমাদের আচরণে ঘটে না? গণপরিসরের ক্রমঃসংকুচিত হওয়ার প্রবণতার উত্তর হতে পারে একসঙ্গে ভাবার সংস্কৃতির প্রসার।
আমাদের চোখের আড়ালে, বামপন্থীদের দলকেন্দ্রিক ও দলসর্বস্ব চিন্তারীতির বাইরে, মানুষ নিজস্ব রীতিতে সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ‘আঞ্চলিক’ অথবা ‘আন্তর্জাতিক’ এই সাবেকি পার্থক্য অতিক্রম করে আলাপচারিতা নতুন রূপ নিচ্ছে। দল, সরকার, আন্দোলন, সাধারণ কল্যাণ এবং স্বশাসন বা স্বনিয়ন্ত্রণ এই সব ধারণাতে অনেক পরিবর্তন আসছে। স্বকীয়তা নবরূপ পাচ্ছে স্বাতন্ত্র্যে নয়, বরং একসঙ্গে ভাবার মধ্যে দিয়ে। মহাচিন নানা প্রতিকূলতা এবং পশ্চাত্পদতার মধ্য দিয়ে যে ভাবে এই নতুন চিন্তা ও কর্মরীতি আয়ত্ত করছে, তা থেকে শেখার আছে।
এর অর্থ এই নয় যে, বামপন্থীরা মতাদর্শগত সমালোচনার অধিকার ত্যাগ করবেন, তাঁদের নিজস্ব সামাজিক ভিত্তি বিসর্জন দেবেন। কিন্তু একসঙ্গে ভাবা এবং নিজস্ব ঢঙে ভাবা এর যুগ্ম কৌশল রপ্ত না করলে এই নতুন যুগের চ্যালেঞ্জের সামনে প্রচলিত বামপন্থীরা হারিয়ে যাবেন। সরকারি ক্ষমতায় আসা এবং সরকারি ক্ষমতা হারানোর অন্তহীন আবর্তে তাঁরা মিলিয়ে যাবেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত