একে একে ১৩২টি স্কুলপড়ুয়া শিশুর মৃতদেহ পেশোয়ারে সমাধিস্থ হইতেছে। সকলেই স্কুলের ইউনিফর্ম পরিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়াছিল, ইউনিফর্মের সাদা জামা রক্তে লাল হইয়া যায়। তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান নামক সংগঠনের বীরপুঙ্গবরা এই নিরস্ত্র শিশুদের স্কুলে ঢুকিয়া নির্বিচারে হত্যা করিয়াছে স্রেফ পাক সেনাবাহিনীর উপর প্রতিশোধ লইতে। শিশুরা সকলেই ছিল সৈনিকদের সন্তান, সৈনিক স্কুলেই পড়িতে যাইত। যেহেতু তালিবান জঙ্গিরা পাক বাহিনীর সামরিক অভিযানে নিজ পরিবার-স্বজনদের হারাইতেছে, তাই সেই স্বজন-হারানোর বেদনা সেনাবাহিনীকে ‘ফিরাইয়া দিতেই’ নাকি এই শিশুমেধ। কোনও বিশেষণই এই ঘাতকদের বর্বরতা ও নৃশংসতা বর্ণনা করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। স্বভাবতই সমগ্র পাকিস্তানে শোকের ছায়া নামিয়াছে। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পত্রপাঠ অকুস্থলে গিয়াছেন এবং তিন দিনের জাতীয় শোক পালনের ঘোষণা করিয়াছেন। নিহত শিশুদের ‘নিজের সন্তান’ আখ্যা দিয়া শরিফের বক্তব্য, তাহাদের মৃত্যু তাঁহার নিজেরও সমূহ ক্ষতি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও এই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দার পাশাপাশি শোকার্তদের পরিজনদের সমবেদনা জ্ঞাপন করিয়াছেন।
তবে এই হত্যাকাণ্ডটি যে জরুরি প্রশ্ন তুলিয়া দিয়াছে, তাহা হইল, পাক সরকার অতঃপর জেহাদি সন্ত্রাস মোকাবিলায় কী পথ অবলম্বন করিবে? উত্তর ওয়াজিরিস্তানে ঘাঁটি গাড়া পাক তালিবানের বিরুদ্ধে গত জুন মাস হইতে ‘জর্ব-এ-অজব’ নাম দিয়া যে সমরাভিযান চলিয়াছে, তাহাতে এ যাবত্ প্রায় ১৬০০ তালিবান যোদ্ধা নিহত। পেশোয়ারের সৈনিক স্কুলে এই জেহাদি ফিদাইন হামলার পর সেই অভিযান কি আরও জোরালো করা হইবে, না কি জেহাদি হুমকির মুখে পাক সরকার গুটাইয়া যাইবে? নওয়াজ শরিফ যতই আস্ফালন করুন, এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী যে পাক জেনারেলরাই, সে বিষয়ে কাহারও সংশয় নাই। প্রশ্ন হইল, তাঁহারা কি এই জেহাদি প্রত্যাঘাতের সামনে রক্ষণাত্মক হইয়া পড়িবেন, না তালিবানকে নিশ্চিহ্ন করিতে আরও কঠোর তত্পরতা দেখাইবেন। মনে রাখা ভাল, এই ঘৃণ্য অপকর্মের নিন্দা করার সময়েও তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের নেতা, ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়ক হইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ইমরান খান তালিবানের নাম করেন নাই। তাঁহার দলই জেহাদি-উপদ্রুত খাইবার পাখতুনখোয়া এবং পেশোয়ার প্রদেশ শাসন করে। শুধু তাহাই নহে, লস্কর-ই-তইবার সংগঠক হাফিজ মহম্মদ সইদ এই সে দিনই জামাত-উদ-দাওয়া ও ফালাহ্-এ-ইনসানিয়াত নামক সেবামূলক সংগঠনের আড়ালে করাচিতে সুবিশাল ভারত-বিরোধী সমাবেশ সংগঠিত করিয়া সেখান হইতে ভারত-বিরোধী জঙ্গি স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহের যে কর্মকাণ্ড চালান, পাক সরকার সে দিকে কেবল চোখ বুজিয়া থাকে নাই, অবাধে জনসমাগম ঘটাইতে সাহায্যও করিয়াছে।
এক দিকে নিজেরা তালিবান ও আল-কায়দার নির্বিচার জঙ্গি সন্ত্রাসে জর্জরিত, অন্য দিকে সেই জঙ্গি জেহাদিদেরই ভারত কিংবা আফগানিস্তানে ছায়া-লড়াইয়ে প্রশিক্ষিত করিয়া তোলা পাকিস্তান স্পষ্টতই মনস্থির করিতে অপারগ। আর তাহার এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের সুযোগেই জঙ্গিরা সর্বত্র বাড়িতেছে। নওয়াজ শরিফ ও তাঁহার জেনারেলদের দ্রুত মনস্থির করিতে হইবে। হয় তাঁহারা জেহাদি সন্ত্রাসকে সমূলে পাক ভূখণ্ড হইতে উত্খাত করিয়া একটি আধুনিক, সহনীয়, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিবেন, নতুবা জঙ্গিদের সহিত কৌশলগত আপস করিয়া ভারত ও আফগানিস্তানের নবনির্মাণ প্রকল্পে অন্তর্ঘাত করিতে তাহাদের ব্যবহার করিবেন। যদি শেষোক্ত পথটিই ইসলামাবাদ বাছিয়া লয়, তবে পেশোয়ারে নিহত ১৩২টি শিশুর রক্তের ঋণ আর শোধ হইবে না, নওয়াজ শরিফ ও তাঁহার জেনারেলদের মাথাতেই অভিশাপের মতো বর্ষিত হইতে থাকিবে।