প্রবন্ধ

দুরবস্থার খবরটা সময়মত জানানো হলে হয়তো কিছু মৃত্যু আটকানো যেত

গত এক বছরে ডুয়ার্সের বন্ধ চা-বাগানগুলিতে একের পর এক অনাহারে মৃত্যুর খবর পেয়েছি আমরা। তা নিয়ে কিছু শোরগোলও হয়েছে। এই মৃত্যু হঠাৎ ঘটেনি। সময় মতো সচেতন হলে তা আটকানো যেত। কুণাল চট্টোপাধ্যায়ডুয়ার্সে বন্ধ চা-বাগানে অনাহারজনিত মৃত্যু আবার সংবাদ শিরোনামে। স্বভাবতই রাজ্যে শাসক দল আতান্তরে এবং মৃত্যুর কারণ অনাহার না অপুষ্টি, উঠে এসেছে সেই পরিচিত তর্ক। এই প্রসঙ্গে বলি, জাতীয় কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন ব্যাংক (নাবার্ড) ও ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)-এর উদ্যোগে আদিবাসী-দারিদ্রের ওপর কিছু দিন আগে একটি গবেষণা করা হয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share:

নিঃসহায়। রায়পুর চা-বাগান বন্ধ হওয়ার পরে। জুন ২০১৪। ছবি: সন্দীপ পাল।

ডুয়ার্সে বন্ধ চা-বাগানে অনাহারজনিত মৃত্যু আবার সংবাদ শিরোনামে। স্বভাবতই রাজ্যে শাসক দল আতান্তরে এবং মৃত্যুর কারণ অনাহার না অপুষ্টি, উঠে এসেছে সেই পরিচিত তর্ক। এই প্রসঙ্গে বলি, জাতীয় কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন ব্যাংক (নাবার্ড) ও ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)-এর উদ্যোগে আদিবাসী-দারিদ্রের ওপর কিছু দিন আগে একটি গবেষণা করা হয়েছে। এই গবেষণার জন্য দুমকা, কোরাপুট, পুরুলিয়া ও জলপাইগুড়ি, এই চার জেলার আদিবাসীদের মধ্যে যে অনুসন্ধানকার্য চালানো হয়, তাতে ডুয়ার্স অঞ্চলের মানুষজনের অবস্থার ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। গত এক বছরে সেখানকার বন্ধ চা-বাগানগুলিতে ৩৫ জনের মৃত্যু সেই গবেষণালব্ধ চিত্রকেই উন্মোচিত করে। সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি আলোচিত জিতবাহন মুন্ডা যার একটি প্রতীক। এই সরকারি ও ‘দরকারি’ কাজে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান দু’টির গবেষণালব্ধ তথ্য সময় থাকতে জনসমক্ষে এলে ডুয়ার্সে এই মৃত্যু-মিছিলের হয়তো লাগাম পরানো যেত। আমলাশোল, কাঁঠালগুড়ির পর রায়পাড়া চা-বাগান হয়তো সংবাদে আসত না।

Advertisement

এ রাজ্যে ঝালদা এক নম্বর ব্লকের অধীন পাঁড়ড়ি গ্রামটি একেবারে জঙ্গলের মধ্যে। দশ ঘর বীরহোরের বাস। গবেষণার গিনিপিগ হিসাবে নমুনায় ওঠা পরিবারগুলির কাছে প্রশ্নপত্র নিয়ে গেলে সমীক্ষাকারীকে তারা জানিয়েছিল, তাদের উত্তর দেওয়ার পয়সা নেই! খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগের বছর কোন দলের লোকেরা এমন সার্ভে করতে গিয়ে তাদের থেকে টাকা নেয়। যারা দড়ি বুনে আর সারা বছর ধরে বাবুদের গৃহপালিত পশু দেখভাল করে দিন গুজরান করে, ভাতের সঙ্গে ডাল যাদের কাছে বিলাসিতা, ইংরেজ শোষকরা তাদের থেকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা নিত কি না জানা নেই।

শহরের দারিদ্রের সঙ্গে গ্রামীণ দারিদ্রকে অভিন্ন ভাবে চিহ্নিত করা অর্থহীন। আবার, গ্রামীণ দরিদ্রদের মধ্যেও আদিবাসীদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। সেই কারণেই আদিবাসীদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। উন্নয়নের ফল এদের কাছে পৌঁছয়নি বললেই হয়। এ দেশে এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ে সমাজতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি দৃষ্টিকোণ থেকে যত গবেষণা হয়েছে, সে তুলনায় তাদের অর্থনীতি নিয়ে তেমন গবেষণা হয়নি বললেই চলে।

Advertisement

অরণ্যচারী এই মানুষগুলো একলব্যের সময় থেকেই অবহেলিত ও বঞ্চিত। সাম্প্রতিক কালে এদের মধ্যে সচেতনতা ও শিক্ষার প্রভাব কিছুটা পড়ায় এরা প্রতিবাদী হচ্ছে। গণতন্ত্রের সুবাদে মুক্ত গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংক্রান্ত সংগঠনগুলি কিংবা শংকর গুহ নিয়োগী বা বিনায়ক সেনদের উদ্যোগে রাষ্ট্রের কাছে এদের সমস্যার প্রাসঙ্গিকতা বেড়েছে। রাষ্ট্রের সামনে এরা দেখা দিচ্ছে ‘বৃহত্তম আশঙ্কা’ হয়ে। ১৬৫টা জেলা জুড়ে বিস্তৃত এই আশঙ্কা!

গ্রামীণ দারিদ্র নিরূপণে সরকারি স্তরে গবেষণা কম হয়নি। ১৯৯২, ১৯৯৭ ও ২০০২ সালে ভারত সরকারের গ্রাম উন্নয়ন দফতর থেকে সমীক্ষা চালানো হয়। পরবর্তী কালে ভারত সরকার এন সি সাকসেনার নেতৃত্বে সতেরো সদস্যের এক বিশেষজ্ঞ কমিটি বসায়। সব অনুসন্ধানেই দেশের আদিবাসী দারিদ্রের এক অভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, আশি শতাংশ আদিবাসীই এখানে নিষ্ঠুর দারিদ্রের শিকার। সাকসেনা কমিটি আরও জানাচ্ছে, এ দেশে পঞ্চাশ শতাংশ গ্রামীণ শিশু কম ওজনের ও পঁচাত্তর শতাংশ মহিলা রক্তাল্পতায় ভোগে।

২০০৮-১০ সময়কালে নাবার্ড ও আইএসআই-এর ১০০০টি পরিবারের ওপর সমীক্ষায় (২০১২) দেখা গেছে, জল, জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও শৌচব্যবস্থার ক্ষেত্রে আদিবাসী পরিবারগুলি প্রায় প্রাক্-স্বাধীনতার যুগে রয়ে গেছে। জ্বালানির প্রশ্নে অবস্থা ১৯৪৭-এর চেয়ে খারাপ। লক্ষণীয়, বিধবা ভাতা, অন্নপূর্ণা কর্মসূচি, এনআরইজিএ তথা একশো দিনের কাজ, জব কার্ড, বিপিএল— এই শব্দগুলির সঙ্গে আজ তারা কমবেশি পরিচিত হলেও উপকৃত নয়। এই সমীক্ষা থেকে যে তাৎপর্যপূর্ণ ছবিটি উঠে এসেছে, তা হল, কুড়ি বছর আগে সংবাদ শিরোনামে উঠে আসা কেবিকে অর্থাৎ কোরাপুট, বোলাঙ্গির কালাহান্ডির করাল দারিদ্র চিত্রের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। খাদ্যের গণবণ্টন ব্যবস্থায় লক্ষণীয় উন্নতি ঘটেছে ওড়িশায়। ফলে অনাহার অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় ওড়িশায় অনেক কম। উপরোক্ত সমীক্ষায় দেখা গেছে, কী অনাহারে, কী আর্থিক দারিদ্রের মাত্রায়, পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা প্রতিবেশী ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডের চেয়েও খারাপ। সঙ্গের সারণিটি আমাদের সেই সত্যই দেখিয়ে দেয়।

বড় ছবি

হিউ-এন-সাঙ থেকে আলবিরুনি, স্বামী বিবেকানন্দ থেকে এ এল ব্যাশাম, সকলেই ভারতবর্ষের এক অভ্যন্তরীণ জড়ত্বের কথা বলেছেন, যে জড়ত্বের ফলে বহু শতাব্দী ধরে বৈষম্য ও শোষণ থেকে গেছে অবিশ্বাস্য মাত্রায়। উইলিয়ম ডিগবি ১৯০১ সালে দরিদ্র ভারতবাসীর দুর্দশাগ্রস্ত জীবন যাপনের কথা বলেছেন। আদিবাসী জনজাতির জীবনযাপনের ছবি ভেরিয়ার এলুইনের লেখার ছত্রে ছত্রে পাই। ছবিটা একই থেকে গেছে, তা বলা যাবে না। কিন্তু ছবিটা খুব পালটেছে বললেও ভুল হবে। স্বাধীন ভারতে এ দেশে একটিও বড় আকারের দুর্ভিক্ষ হয়নি। কিন্তু অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের ভাষায় বললে, ‘...এক বিরাট সংখ্যক ভারতীয় নিত্য ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমোতে যায়।’ এ এক আশ্চর্য জড়ত্ব।

এ দেশে দরিদ্রদের এক বিরাট অংশ বনবাসী। অরণ্যের ভূমিকা স্বভাবতই এদের কাছে বিরাট। বস্তার জেলার ভূতপূর্ব কালেক্টর ও দেশের অন্যতম আদিবাসী বিশেষজ্ঞ বি ডি শর্মার মতে, এ দেশের বনবাসীদের তিন ধরনের আর্থিক ‘মহাজন’ থাকে, যারা তাদের দেখভাল করে। এগুলি হল জমি, জঙ্গল আর নদী। প্রতি তিন মাস এই প্রাকৃতিক সম্পদগুলি আদিবাসীদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রখর খরাতেও জমি পর্যাপ্ত কন্দমূল সরবরাহ করে। জঙ্গলের নিকটবর্তী মানুষজনের মাসিক আয় দূরতর একফসলি গ্রামের লোকেদের চেয়ে অনেকটাই বেশি। এই পরিস্থিতিতে অরণ্যের পরিসর ক্রমশ কমে আসাটা আদিবাসী জীবনে ভয়াবহ আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে আনছে।

আজ সারা দেশ জুড়ে বহু সমাজসেবী সংস্থা আদিবাসী উন্নয়নের কাজে ব্রতী। সরকারি উদ্যোগের তুলনায় এই সব সংস্থার সার্বিক সাফল্য অনেক বেশি। তাই সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন মহল থেকে এই সব সমাজসেবামূলক সংস্থাকে উন্নয়নমূলক কাজে বেশি করে যুক্ত করার কথা ভাবা দরকার।

শেষে একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। ১৯৭৭ সালে তদানীন্তন বস্তার জেলায় নারায়ণপুরের একটি বর্ণনা দিয়েছেন রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী স্বামী আত্মানন্দ তাঁর লেখায়। ওই বছর এপ্রিল মাসে নারায়ণপুরে এক সাপ্তাহিক হাটে অরণ্যচারী অবুঝমার বনবাসীদের ৫০ টাকার চিরৌঞ্জীর বিনিময়ে ৫০ পয়সার লবণ কিনতে দেখেন মহারাজ। লক্ষ করেন, তিনি ১০০ টাকার মদ খাইয়ে ১০ হাজার টাকার সেগুন গাছ কিনে নিতে। আদিবাসীরা সে দিন মহারাজের কাছে অনুরোধ করে বলেছিলেন, এমন ব্যবস্থা করুন যাতে আমাদের গ্রামে পুলিশ বা বন দফতরের লোক না আসে। আর যদি কিছু দিতে চান তো একটা দোকান করে দিন, যেখানে আমরা আমাদের দ্রব্য ন্যায্য দামে বেচতে ও কিনতে পারি। বর্তমানে ২০০ একর জমিতে নারায়ণপুর রামকৃষ্ণ মিশন জনজাতির জন্য অবৈতনিক বিদ্যালয়, ন্যায্য মূল্যের দোকান, বিরাট আধুনিক হাসপাতাল ও দশটিরও বেশি শাখা-কেন্দ্র চালাচ্ছে। তথাপি প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম। এখানেই সরকারি সহযোগিতা খুব বড় কাজ করতে পারে।

গাঁধী ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি-র অধ্যক্ষ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement