আঁতাঁত। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সইদ, জম্মু, ১ মার্চ। ছবি: পিটিআই।
আট সপ্তাহের নাটক শেষ। জম্মু-কাশ্মীরে পিডিপি ও বিজেপির একত্র সরকার অবশেষে ক্ষমতাসীন। পিডিপি এবং বিজেপির দুই ‘পি’ অর্থাৎ পার্টির অভিন্ন নূ্যনতম কার্যসূচিটিও আপাতত প্রস্তুত। আশা করা যাক, আগামী ছয় বছরের জন্য সেটা যথেষ্ট কার্যকর বলে প্রমাণিত হবে। বিজেপি স্বভাবতই বেশি খুশি। খুশি বললে কম হবে। প্রসন্ন। সন্তুষ্ট। ভারতের একমাত্র মুসলিমপ্রধান প্রদেশটিতে তাদের নির্বাচনের ফল এ বার নেহাত ‘আশানুরূপ’ নয়, ‘আশা’র থেকে অনেকটাই বেশি। ২০০২ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভায় বিজেপি-র বিধায়ক ছিলেন মাত্র এক জন। ২০০৮ সালে ১১। ২০১৪ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫। নির্বাচনী প্রচারের সময় ‘মিশন চুয়াল্লিশ’-এর যে ঝোড়ো আবেগ ওঠানো হয়েছিল, ৪৪ পেলেই গোটা রাজ্যের একক ক্ষমতাশালী দল হওয়ার যে সম্ভাবনা রাজ্য জুড়ে ঘোষিত হয়েছিল, সেই আশার আবেগে ভেসে ভেসেই হাতে এসেছে ২৫টি আসন। জম্মু ও কাশ্মীরের মতো রাজ্যে প্রশাসনের কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হওয়া অবশ্যই বিজেপির কাছে সুখস্বপ্ন সত্যি হওয়ার শামিল।
কিন্তু বিপদ অপেক্ষা করে আছে খুশির বাঁকটি ঘুরলেই। মনে রাখতে হবে, যে উপায়ে ২০১৪-র মে মাসে বিজেপি-র দিল্লি জয়, জম্মু ও কাশ্মীরেও তাদের জয়ের গেরুয়া নিশানাটি উড়েছে প্রায় সেই একই পথেই। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মাধ্যমেই কার্যসিদ্ধি ঘটল। এও ঠিক, কাশ্মীরের বিজেপি-র প্রবেশ যে একেবারে রুদ্ধ হল, সে-ও এই মেরুকরণেরই ফল। কোনও কালেই কাশ্মীর উপত্যকায় বিজেপি-র খুঁটির জোর ছিল না। কিন্তু যে পরিমাণ পরিশ্রম করে এ বার তারা নির্বাচনী প্রচার করেছিল, তাতে ৩৪টি বিধানসভা নির্বাচনী কেন্দ্রের মধ্যে ৩৩টিতেই যে শেষ পর্যন্ত তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হবে, এতটাও কিন্তু ভাবা যায়নি। অবশ্য অর্থক্রীড়ার ভূমিকাও তো একেবারে অনুল্লেখযোগ্য নয়। তাই, শোপিয়ান আর হজরতবালে বিজেপি প্রার্থীরা যে যথাক্রমে ৩০০০ আর ২৫০০-এর বেশি ভোট পেলেন, সে-ই বা কম কী। এই ভোটও কিন্তু আবার কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বাদ দিয়েই পাওয়া গেল, কেননা পণ্ডিতরা এ বার বিজেপি-সমর্থনের ছাপ এড়ানোর কৌশল হিসেবে ভোট বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। উপত্যকায় অবশ্য শেষ পর্যন্ত কোনও দলই বড় জনসমর্থন জোগাড় করতে পারেনি। এই বিভক্ত ও অনির্দিষ্ট ফলের জন্য বিজেপি কতখানি দায়ী, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে মনে রাখতে হবে, কেবল বিজেপি-বিরোধিতার হিসেব দিয়ে কাশ্মীর উপত্যকার ভোটের অঙ্ক বোধহয় মেলানো যাবে না। নয়তো ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে করমর্দন করেও কি সাজ্জাদ লোন কুপওয়াড়ায় দুটি আসন জিতে তাঁর পিপলস কনফারেন্স-এর জন্য প্রথম নির্বাচনী সাফল্য অর্জন করতে পারতেন?
এ বার যখন পিডিপি-র মুফতি মহম্মদ সইদ বিজেপি-র সঙ্গে ‘অশুভ আঁতাঁত’টি বানিয়েই ফেলেছেন, দেখা যাক তাঁর কার্যসূচিতে তিনি স্থির থাকতে পারেন না কি গেরুয়া-প্রবাহে হারিয়ে যান। কাশ্মীরে তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়ে আপাতত ক্ষোভের বন্যা, মুফতি ভালই জানেন। সোশ্যাল মিডিয়া ও সংবাদপত্রে কী কাণ্ড চলছে, সে বিষয়েও তিনি অবহিত। উপত্যকার কয়েকটি স্থানীয় সংবাদপত্র রীতিমত ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে মুফতি ও মুফতির দলকে। কেবল শত্রুরাই সমালোচনা করছে না। তাঁর বন্ধুভাবাপন্ন যাঁরা, তাঁরাও প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে বারংবার বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, যে দল ‘ঘর ওয়পসি’র মতো অভাবনীয় সব কাণ্ড ঘটাতে পারে, তাদের জম্মু ও কাশ্মীরের মতো প্রদেশে প্রশাসনে আসার সুযোগ করে দেওয়া কিন্তু অতীব বিপজ্জনক হতে পারে।
মুফতি অবশ্য এ সবই অগ্রাহ্য করতে মনস্থ করেছেন। এই পুরো আট সপ্তাহ জুড়ে তিনি সংশয়বাদী ও বিরুদ্ধবাদীদের ক্ষোভ উগরানোর বিস্তর সুযোগ দিয়েছেন। বোঝানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন যে কিছুতেই তিনি অকারণ সমঝোতা করবেন না, প্রয়োজনে ক্ষমতার বাইরে থাকতেই মনস্থ করবেন। কাশ্মীরের উন্নয়নের প্রশ্নে যদিও খানিকটা অদ্ভুত ভাবে তিনি নীরব থেকেছেন, কিন্তু এই দীর্ঘ স্নায়ুর খেলার কেন্দ্রে সমানেই প্রচ্ছন্ন থেকেছে জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য কেন্দ্রের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ছাড়ের প্রশ্নটি, দেশের আর কোনও রাজ্যের শরিক সরকার তৈরি করার ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন কোনওদিন উঠতই না। পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন আলাপ-আলোচনার অবকাশ তৈরির দাবি, ৩৭০ ধারা বিষয়ে আর না এগোনোর দাবি, আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট (আফস্পা) প্রত্যাহারের দাবি, বিদ্যুৎ-প্রকল্প পুনর্বিবেচনার দাবি, প্রতিটিকেই তিনি এ বারের রাজনৈতিক দড়ি-টানাটানির মধ্যে অন্তর্গত করে নিয়েছেন বেশ দক্ষ ভাবে। ফলত, দুই বিরুদ্ধভাবাপন্ন দলের ‘অভিন্ন কার্যসূচি’র মধ্যে কে বেশি ছেড়েছে, কে কম, সেটা তাই এ বার ভাল করে খুঁটিয়ে দেখা দরকার।
আর এস এস-এর চাপ উপেক্ষা করে এই দাবিগুলি মেনে নেওয়া হয়তো শেষ পর্যন্ত বিজেপি-র কাছে অবাস্তব না-ও হতে পারে। তাদেরও তো কাশ্মীরে মোটের উপর একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে হবে। ভোটের আগে ‘পশ্চিম পাকিস্তান উদ্বাস্তু বসতি’ বিষয়ে বহু শব্দ বিজেপি খরচ করে ফেলেছে। এর পর যদি ভোটারদের মধ্যে একটা ন্যূনতম আস্থা তৈরি করা না যায়, তা হলে মুশকিল। সুতরাং, যুক্তি বলছে, মুফতির দাবি-দাওয়া নিয়ে নরম হওয়া ছাড়া বিজেপি-র সামনেও অন্য পথ নেই।
এত কিছুর পরও বাজিটা অবশ্য ধরতে হবে মুফতির উপরই, বিজেপি-র উপর নয়। তিনি কোন পথে চলবেন, কী ভাবে চলবেন, সেটাই দেখার। অনেকে বলছেন, ভারতীয় সাংবাদিকদের দেওয়া লম্বা লম্বা সাক্ষাৎকারে মুফতি সম্প্রতি যে ভাবে জম্মুতে দলকে চাঙ্গা করার কথা বলেছেন, ভোটের ফলাফলে দৃশ্যত বিভাজিত প্রদেশের দুই অংশ জম্মু ও কাশ্মীরকে নতুন করে একত্রীকরণের কথা বলেছেন, আঞ্চলিক একতার আদর্শ শোনাচ্ছেন, তাতে মনে হয় এ ভাবেই নিজের সমর্থন-ভিত্তিটির পুনর্বিন্যাস চাইছেন তিনি। কাশ্মীর উপত্যকার বাইরে ক্ষমতার বিস্তার চাইছেন।
এখন, মুফতির যে সব দাবি, তার পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লিকে কি সত্যিই বিশ্বাস করা যায়? পরবর্তী ছয় বছরের জন্য ভরসা রাখা যায়? এটাও জটিল প্রশ্ন। একটা কথা পরিষ্কার। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে কিন্তু কেন্দ্রাসীন দল কী ভাবছে, সেটাই শেষ কথা, প্রাদেশিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বিশেষ ধর্তব্যের মধ্যে নয়। গত ৬৭ বছরে কাশ্মীর বিষয়ে এই একটা বিষয়ে দিল্লির নীতি-নির্ধারকদের কোনও হেলদোল দেখা যায়নি, বর্ণদলনির্বিশেষে সকলেই এক পথে চলেছেন। সুতরাং যে আশ্বাসই আপাতত মিলুক না কেন, মুফতিও জানেন, না আঁচানো পর্যন্ত আশ্বাসে বিশ্বাস নেই। তাঁর জম্মু-বিষয়ক ভাবনাচিন্তাকেও খানিকটা এই প্রেক্ষিতে দেখা দরকার। অতীতেও কাশ্মীরি তথা মুসলিম নেতারা জম্মুর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতেন। গুলাম নবি আজাদ মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জম্মুর হিন্দুদের মন পাওয়ার জন্য মনে করিয়ে দিতেন, তিনি জম্মুরই লোক, সেখানকার ছেলে হিসেবেই তিনি রাজ্যের প্রধান আসনটিতে বলতে পেরেছেন। জম্মুর উন্নয়নের জন্য অনেক কিছু করেছিলেন তিনি। তবু নির্বাচনে শেষরক্ষা করতে পারেননি। জাতীয় নির্বাচনে যখন উধমপুর থেকে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন তো বটেই, কিন্তু প্রাদেশিক নির্বাচনে চন্দ্রভাগা উপত্যকা থেকে দাঁড়িয়েও তাঁর মুখরক্ষা হয়নি। ১৯৯৬ সালে ফারুক আবদুল্লা ক্ষমতায় এসেও সেই একই পথ ধরেছিলেন। এবং তাঁর হালও যথেষ্ট করুণ হয়েছিল। শেখ মহম্মদ আবদুল্লার নামে তাওয়াই সেতুর নামকরণ করার সময় জম্মুতে এমন গোলযোগ উপস্থিত হয়েছিল যে তাঁর সরকারকে কারফিউ জারি করে সেতুর উদ্বোধন করতে হয়!
এই সব থেকে মুফতির দু-একটা জিনিস শেখার আছে। রাজনীতিক হিসেবে তিনি দড় হতে পারেন, কিন্তু নিজেকে ‘হৃদয়ের দিক থেকে ভারতীয়’ (তাঁরই কথায়) হিসেবে প্রমাণ করাটা একটু কঠিন হয়ে যেতে পারে, বিশেষত জম্মুতে। শেষ পর্যন্ত ছোট ছোট কাজও কিন্তু জম্মুর বিরোধিতায় আটকে যেতে পারে। মুফতির নিশ্চয়ই মনে আছে কী ভাবে কংগ্রেস মন্ত্রীরা তাঁর আগের তিন বছরের শাসনকালকে (২০০৩-৫) দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছিল! তাই কেবল জম্মু বিষয়ে উদ্বেগ ও আন্তরিকতা দেখিয়েই যদি তিনি ভাবেন যে গোটা রাজ্যে নিজের আসনটিকে শক্তপোক্ত রাখতে পারবেন, চালে বিরাট ভুল হয়ে যাবে! বরং মোদী তথা কেন্দ্রকে বুঝিয়েসুঝিয়ে দাবিগুলো তিনি আদায় করতে পারেন কি না, না কি সেই আবার তাঁকে দিল্লির ক্রীড়নকে পরিণত হতে হয়: এর উপরই আগামী কয়েক বছরের কাশ্মীর-ভাগ্য নির্ভর করছে।