শূন্যস্থান। মদন মিত্রের গ্রেফতারির প্রতিবাদে তৃণমূল কংগ্রেসের ধর্নামঞ্চ। কলকাতা, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪। ছবি: সনত্কুমার সিংহ।
সে এক সুসময় ছিল, যখন সাদাকে কাদার থেকে আলাদা করা যেত। যখন ন্যায়-অন্যায়, শোষক-শোষিত, দীন ও হীনের মধ্যে লক্ষ্মণরেখাটি সুস্পষ্ট ও প্রায় দুরতিক্রম্য ছিল। নীতি ও দুর্নীতি বিষয়েও তা-ই। ফলে, সমাজের জাগ্রত, বিবেকবান, চিন্তাশীল অংশ যখন ‘অন্যায়ের’ প্রতিবাদে পথে নামতেন, তখন তার পদক্ষেপটি ছিল দ্বিধাহীন, নৈতিক, প্রেরণা-সঞ্চারী।
সমাজের এই বিবেকী আলোকিত অংশ, যাকে ইদানীং ‘নাগরিক সমাজ’ বলে, ঔপনিবেশিক বাংলায় প্রথম সংগঠিত ভাবে পথে নামে ১৬ অক্টোবর ১৯০৫, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে। স্বদেশপ্রেমের গান গেয়ে সবার হাতে রাখি বেঁধে বাঙালির ঐক্য ধরে রাখতে ব্রতী হয়েছিলেন যে সব জ্যোতিষ্ক, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের অন্যতম। এই নাগরিক সমাজের শ্রেণি/বর্ণ/সম্প্রদায়গত পরিচয়, অবস্থান, শক্তি ও দুর্বলতার বিষয়গুলি বেশ কিছু দিন ধরেই নানা তির্যক তাত্ত্বিক প্রশ্নের মুখোমুখি, যার সবটাই হয়তো ফেলে দেওয়ার নয়। তবুও দেশে দেশে ক্ষমতাদম্ভীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের ভূমিকা যে সমাজকে জাগিয়ে তোলে, তাতেও সন্দেহ নেই। পরম শক্তিমানও তা সব সময় অবজ্ঞা করতে পারেন না। ১৯৬৮ সালের মে মাসে, প্যারিসে ক্রমপ্রসরমাণ সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে জাঁ পল সার্ত্রে আইন অমান্য করে গ্রেফতার হলে তদানীন্তন ফ্রান্সের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা শার্ল দ্য গল, সার্ত্রের বিবেকী ভূমিকাকে কার্যত আঠারো শতকের ফরাসি জ্ঞানদীপ্তির নায়ক ভলতেয়ারের সঙ্গে তুলনা করে, তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দিয়ে বলেছিলেন, আমরা ভলতেয়ারকে গ্রেফতার করতে পারি না!
ঔপনিবেশিক বাংলায় এই প্রশ্নবান নাগরিক সমাজ নানা ভাবে ব্রিটিশ শাসনের যৌক্তিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে গেছে, স্বাধীনতার পরেও দেশীয় শাসকদের সামনে অস্বস্তিকর প্রশ্ন রাখতে পিছপা হয়নি। স্বাধীনতার শেষের দিকে অবশ্য রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি সাম্যের প্রশ্নেও নাগরিক সমাজ বিশেষ ভাবে আলোড়িত হয়েছে। সেই সময় শাসক কংগ্রেসের বিপরীতে বামপন্থীরাই প্রধান পক্ষ। ফলে, অন্তত বাংলায় প্রশ্নশীলদের বড় অংশই বামপন্থী নীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। ১৯৪৩-এর ভয়াবহ মন্বন্তরের পর, স্বাধীনতার প্রাক্কালে, দুই বাংলাতেই বামপন্থীরা ভূমিহীন ভাগচাষিদের পক্ষে প্রবল ‘তেভাগা’ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। যার পিছনে ছিল এই বিশ্বাস: লাঙ্গল যার, জমি তার। এই বিশ্বাসে ভর করে, ১৯৫৯ ও ১৯৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলন ও দু’দুটো যুক্তফ্রন্ট সরকারের পরীক্ষানিরীক্ষা পেরিয়ে, মধ্য ’৭০-এর জরুরি অবস্থার পর যখন ‘সরকারপন্থী’ বামপন্থীরা ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট গড়ল, তখন তারা যে দ্রুত কংগ্রেস আমলের ফাইলবন্দি ‘অপারেশন বর্গা’ চালু করে হুলুস্থুল ফেলে দিল, তার পিছনেও বামপন্থী নাগরিক সমাজের পূর্ণ নৈতিক সমর্থন ছিল।
এর পরও বহু দিন পর্যন্ত নানা প্রশ্নে সরকারি বামপন্থা ও বাংলার নাগরিক সমাজের মধ্যে তালমিল মন্দ ছিল না, দু’একটা হোঁচট খাওয়া, গরমিলও ঘটেছে কখনও-সখনও। কিন্তু ছন্দপতন হল ২০০৬-এর পর, সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম কাণ্ডকে কেন্দ্র করে। এই সময় জমি বিষয়ে বামফ্রন্ট সরকার যখন তেভাগা থেকে চলে আসা সাবেক দৃষ্টিভঙ্গির খোলস ছেড়ে বেরিয়ে বলপ্রয়োগ করতেও পিছপা হল না, তখন নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ বিসমিল্লায় গলদ ঠাওরালেন। এরই ফলস্বরূপ ১৪ নভেম্বর ২০০৭-এ কলকাতায় মহামিছিল। তদানীন্তন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যে মিছিলে যোগ দিতে পারেননি। সাম্প্রতিক কালে এ রাজ্যের নাগরিক সমাজের কাছে সে এক পরম মুহূর্ত! মাত্র ছ’সাত বছর পার হয়ে ২০১৪-১৫-র সন্ধিক্ষণে, সে দিনের নৈতিক প্রতিবাদীরা এখন কেবল ছিন্নভিন্নই নন, এমন এক জটিল, দুর্বোধ্য সময়ের মুখোমুখি, সাদা-কালো/ন্যায়-অন্যায়ে সেখানে এমন মেশামিশি যে, যূথবদ্ধ ভাবে নৈতিক দিশা দেখবার কথা ছেড়েই দিলাম, ভাল করে তাঁরা এই নিয়ত পাল্টে যাওয়া কালের পাঠোদ্ধারও করে উঠতে পারছেন না।
নাগরিক সমাজের একটা অস্বস্তির কারণ চিরন্তন: তার আবেদনের ধরন মূলত নৈতিক। কিন্তু তাকে মূলধন হিসেবে কব্জা করে কোনও না কোনও রাজনৈতিক দল, যেমন এ রাজ্যে সাড়ে তিন দশকের বাম শাসনকে প্রতিস্থাপন করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। নাগরিক সমাজের সদস্যদের মধ্যে নতুন সরকারে যোগ দেওয়া নিয়ে মতভেদ তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল নতুন শাসক দলের সঙ্গে সাংস্কৃতিক দূরত্বও। নতুন শাসকের অপরিশীলিত উচ্চারণ থেকে বিদ্যাগত জ্ঞানগম্যির সঙ্গে নৈকট্য তো ছিলই না, এর পাশাপাশি পূর্বতন শাসনের দমবন্ধ করা শৃঙ্খলার বদলে মাঠে-ময়দানের নিত্য ও প্রকাশ্য কাজিয়া/নৈরাজ্যেও শিক্ষিত নাগরিক সমাজের খুব একটা স্বস্তি বোধ করার কথা নয়। অনেকে আবার এই সব প্রবণতাকে তাত্ত্বিক ভাবে ‘নিম্নবর্গের শাসন’ বা ‘উপমধ্যশ্রেণির উত্থান’ বলে ব্যাখ্যা দিতে চাইবেন। কিন্তু এরই মধ্যে বাদ সাধল অন্য ব্যাপার। শাসক দলের একটা অংশ ক্রমশ জড়িয়ে পড়তে লাগল (যদিও শাসক পক্ষের মতে, তাদের ‘জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে’) এক অভূতপূর্ব আর্থিক কেলেঙ্কারিতে, যে অর্থ বেআইনি ভাবে সংগ্রহ করেছে ভুঁইফোঁড় সংস্থা— চটজলদি মুনাফার লোভ দেখিয়ে, মুখ্যত অর্ধশিক্ষিত সাধারণ মানুষের কাছ থেকে, যা থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি, সিবিআইয়ের দাপাদাপি এবং ফলস্বরূপ শাসক দলের বেশ কিছু নেতা-এমপি, এমনকী এক মন্ত্রীও কারা-অন্তরালে। ভারতের অন্যান্য জায়গায় এ সব অনেকটা গা-সওয়া হলেও বাংলায় তা এতাবত্ অশ্রুতপূর্ব। তাই ছোটবেলা থেকে অতুলপ্রসাদী গানের চেতাবনি ‘হতে পারি দীন তবু নহি মোরা হীন’ শুনতে শুনতে বেড়ে ওঠা সাধারণ বাঙালির মনে সরকারের ন্যায্যতা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ দানা বাঁধাই স্বাভাবিক, নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনে, ‘পরিবর্তনের’ পক্ষে নামা নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশের ক’জনের পক্ষেই বা এর বিপরীত ভাবাটা সম্ভব?
যদি সময়টা সরল হত, তবে ‘দীন’ ও ‘হীন’-এর মধ্যে দ্বন্দ্বসমাসের নিরূপণটাও সোজা হত। কিন্তু অঙ্কটা এত সোজা রইল না, বর্তমান শাসকদের জনপ্রিয়তা তথা ন্যায্যতায় খামতি দেখা দিলে বিরোধী ক্ষয়িষ্ণু বামদের পক্ষে তা পূরণ করা সম্ভব হল না, সেই ফোকর দিয়ে উত্থান ঘটতে লাগল রাজ্যে এক অপরীক্ষিত শক্তির, নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি-র। মোদীর আগ্রাসী প্রচার ‘আচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতি, কর্পোরেট-বান্ধব ভাবমূর্তি ও মিডিয়ায় অষ্টপ্রহর তাঁর গুণবন্দনা ও কংগ্রেসের ক্ষীয়মাণ জনপ্রিয়তায় ভারতের এক-তৃতীয়াংশ যেমন মজল, এ রাজ্যে দু’ধরনের মানুষ— শহুরে মানুষ বামফ্রন্টের পর তৃণমূলেও হতাশ হয়ে আর গ্রামে তৃণমূলবিরোধীরা (মুখ্যত পূর্বতন বাম সমর্থকরা) মূলত টিকে থাকার প্রশ্নে— বিজেপি’কে অবলম্বন করতে লাগল। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও বঙ্গীয় নাগরিক সমাজ কী করে? চরিত্রগত ভাবে ‘বামমনস্ক’ হওয়ায় মোদীর কর্পোরেট-বান্ধব কর্মসূচি, প্রচলিত প্রথা ভেঙে পছন্দের শিল্পপতিকে বিপুল ব্যাঙ্ক-ঋণ পেতে সহায়তা, কিংবা বিমা বা জমি-বিল সংসদে পাশ না হওয়ায় যে ভাবে অর্ডিন্যান্স করা হল জমির নতুন অর্ডিন্যান্স কৃষিকাজে যুক্ত মানুষদের এতটাই বিরোধী যে, শাসক এনডিএ-র মধ্যেই তা নিয়ে তীব্র মতভেদ প্রকট হয়েছে তা বাংলার নাগরিক সমাজ সমর্থন করবে কী করে? যদি মেনে নেওয়াও যায়, এ সব কিছুই দেশে নব্য উদারবাদী উন্নয়নের প্রাক্শর্ত, এ সব প্রশ্ন আপাতত শিকেয় তুলে রাখতে হবে, এমনকী ২০০২-এর গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ‘রাজধর্ম’ পালন না করার ইতিহাসও ভুলে যেতে হবে, তবুও এখনও মোদী চাইলেও তাঁর পুরনো রাজনীতির ট্র্যাডিশন কি তাঁকে ছাড়বে? সাধ্বী নিরঞ্জনার কুকথার হুংকার, ‘ঘর-ওয়াপসি’/‘বেটি বাঁচাও-বহু লাও’-এর কার্যক্রম যে ইতিমধ্যেই মোদীর সাধের উন্নয়নের পথকে কণ্টাকাকীর্ণ করবে, তা স্বয়ং মোদী ছাড়া ভাল কে জানেন! এই অবস্থায় তৃণমূলে হতাশ, বিরক্ত নাগরিক সমাজ কী ভাবে বিজেপি’কে নৈতিক বিকল্প ভাববে?
এক দুর্বোধ্য সময়ের মুখোমুখি বাংলার নাগরিক সমাজ। তৃণমূলের প্রতি তার আস্থা তলানিতে ঠেকেছে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের স্মৃতি এখনও টাটকা, তাই আগের মতো সরকারি বামপন্থার পক্ষপুটে আশ্রয় নেওয়া অধিকাংশের পক্ষেই এখনই সম্ভব নয়, কংগ্রেসের কোনও আশা নেই, আর সদ্যোত্থিত বিজেপি সম্পর্কেও থেকে যাচ্ছে একগুচ্ছ অস্বস্তিকর প্রশ্ন। কী ভাবে সামাজিক নৈতিকতার বাহকরা এই দ্বন্দ্ব পার হন এবং বাকিদের পথনির্দেশ দেন, সে দিকেই ২০১৫ চেয়ে থাকবে।
শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক