প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া ছাত্রছাত্রীরা কেবল যাদবপুরেই জয়ী হয় নাই। জয় পাইয়াছে মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রীরাও। দুই দিন আগে হাইকোর্টের রায়ে বিদ্রোহী এমডি পরীক্ষার্থীদের জয় ঘটিল। ইতিপূর্বে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দুইটি নির্দেশিকা বলিয়াছিল, এমডি প্রবেশিকা পরীক্ষায় এ রাজ্যের কোটায় অন্য রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা বসিতে পারিবেন না, প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে দেখাইতে হইবে যে তাঁহারা আইনত পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। এই নির্দেশিকার বিরুদ্ধে প্রায় তিন শত জন পরীক্ষার্থী মামলা করেন, এবং সম্প্রতি হাইকোর্টের বিচারক দীপঙ্কর দত্ত স্পষ্টভাষণে এই নির্দেশিকাটিকে অন্যায্য বলিয়া দেন। তাঁহার যুক্তি সহজ। পরীক্ষায় কে বসিতে পারিবেন, এবং পারিবেন না, তাহা নির্ধারণের একটি মৌলিক মানদণ্ড আছে: মেধা। সুপ্রিম কোর্টই আগে এই নীতিকে প্রাধান্য দিবার ঘোষণা করিয়াছে। সুতরাং রাজ্য হাইকোর্টের কাজ একাধারে স্পষ্ট ও সরল: সুপ্রিম কোর্টের নীতিটিকে তুলিয়া ধরা। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ যে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর নিজের খেয়ালবশত পাল্টাইয়া দিতে পারেন না, এই সহজ বক্তব্যটি প্রতিষ্ঠা করা।
রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর যে যুক্তিগুলি সাজাইয়াছে, তাহাতে গোড়াতেই গলদ। কে কোন রাজ্যের বাসিন্দা, তাহা দিয়া নিশ্চয়ই কে কোন রাজ্যে শিক্ষালাভ কিংবা কর্মসুযোগ লাভ করিতে চান, তাহা নির্ধারণ করা যায় না। রাজ্যের স্বার্থ দেখিতে গিয়া গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিটি লঙ্ঘন করা যায় না। রাজ্য সরকারের পক্ষে আইনজীবী তর্ক তুলিয়াছেন, ভিন্ রাজ্যের বাসিন্দারা যদি পশ্চিমবঙ্গের অর্থে পড়িয়া-শুনিয়া, যোগ্যতা অর্জন করিয়া অন্য রাজ্যে চলিয়া যান, এ রাজ্যের অর্থের অপচয় ঘটে। তিনি নিশ্চয়ই মনে রাখেন নাই যে, এ রাজ্যের কোনও বাসিন্দাও পরীক্ষা-পাশের পর অন্য রাজ্যে চলিয়া যাইতে পারেন, তাঁহাকে আটকাইবার এক্তিয়ার সরকারের নাই! যুক্তরাষ্ট্রীয়তা, রাজ্যের স্বার্থ, ইত্যাদি কোনও ধুয়া দিয়াই যুক্তিহীনতাকে যুক্তি বলিয়া প্রতিষ্ঠা করা যায় না। যে সমস্যার দিকে তিনি সম্ভবত ইঙ্গিত করিতেছেন, তাহা মেধা-নিষ্ক্রমণের সমস্যা, এ রাজ্যের শিক্ষার প্রতি স্তরে ও প্রতি ক্ষেত্রে সে সমস্যা আজ বহু বত্সরের সংকটময় বাস্তব। ভ্রান্ত যুক্তি, বেআইনি নির্দেশিকা দিয়া তাহার সংশোধন সম্ভব নয়। বৃহত্তর অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন দ্বারাই একমাত্র এ রাজ্যকে কর্মোপযোগী ও আকর্ষণীয় বাসভূমি করিয়া তোলা সম্ভব।
এই সামান্য কথাটি রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারাও বিলক্ষণ জানেন। তবু তাঁহাদের এই ধরনের শর্টকাট নির্দেশিকার আশ্রয় লইতে হয়। উহা সহজে সিদ্ধিলাভের পথ: শিক্ষাজগতের সিদ্ধি নহে, রাজনীতি জগতের সিদ্ধি। প্রথমাবধি রাজ্যের বর্তমান সরকার একটি দিকে মনোনিবেশ করিয়াছে: যথাসম্ভব দ্রুত জনরঞ্জনের ব্যবস্থা। কীসে জনসমর্থন বাড়িবার সম্ভাবনা, সেটুকুই, তদপেক্ষা এক পা বা এক হাতও বেশি নয়। মুশকিল হইল, মেধা কিংবা উচ্চশিক্ষার জগত্টি যেহেতু জনসমর্থন বাড়াইবার উপযুক্ত নহে, কেবলই ফাঁক-ফোকরের সন্ধান করিতে হয়। তৃণমূল সরকার এ ক্ষেত্রে পূর্বসূরি বাম সরকারের তন্নিষ্ঠ ঐতিহ্যবাহী। মেডিক্যাল কলেজগুলিতেও অন্যান্য শিক্ষাক্ষেত্রের মতোই এই জন্য মান ও মেধার স্থান ক্রমশ বিলীয়মান। অন্তত একটি ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশ সেই অমোঘ গতিপথে বাধা তৈরি করিল।