প্রবন্ধ ১

জম্মু ও কাশ্মীর: সম্ভব বনাম স্বাভাবিক

দর-কষাকষিতে বিজেপি’র পক্ষে আপস করা তুলনায় সহজ, সংবিধানের ৩৭০ ধারার মতো বিতর্কিত প্রশ্নগুলিকে তারা ইতিমধ্যেই এক পাশে সরিয়ে রেখেছে, কিন্তু পিডিপি’র পক্ষে আপস মানে নিজের রাজনৈতিক আদর্শ থেকে সরে আসা।জম্মু ও কাশ্মীরে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরে এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় সরকার গঠন এখনও বিশ বাঁও জলে। প্রধান দলগুলি পারস্পরিক দূরত্ব অতিক্রম করে এখনও ঠিক ভাবে আলোচনাই শুরু করতে পারেনি। পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং ভারতীয় জনতা পার্টি, উভয়েই এখনও ‘যাব কি যাব না’ ঠিক করতে পারছে না।

Advertisement

সুজাত বুখারি

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

প্রত্যাশায়। ভোটদানের চতুর্থ পর্ব। কাশ্মীর, ডিসেম্বর ২০১৪। ছবি: পিটিআই।

জম্মু ও কাশ্মীরে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরে এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় সরকার গঠন এখনও বিশ বাঁও জলে। প্রধান দলগুলি পারস্পরিক দূরত্ব অতিক্রম করে এখনও ঠিক ভাবে আলোচনাই শুরু করতে পারেনি। পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং ভারতীয় জনতা পার্টি, উভয়েই এখনও ‘যাব কি যাব না’ ঠিক করতে পারছে না।

Advertisement

বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভোট বয়কটের ডাক উপেক্ষা করে রাজ্যের ভোটদাতারা বিরাট সংখ্যায় নির্বাচনে যোগ দিয়েছিলেন, তাতে একটা ‘যথাযথ জনাদেশ’-এর প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। ফল বেরোলে দেখা গেল, জনাদেশের চরিত্র খুবই তাত্‌পর্যপূর্ণ। পিডিপি’র প্রত্যাশা এবং বুথফেরত সমীক্ষার অনুমান মেলেনি, এই দল ৩৫টি আসনে পৌঁছতে পারেনি, পারলে এখন তারা সুবিধেজনক অবস্থায় থাকত। মোট ৮৭ আসনের মধ্যে পিডিপি পেয়েছে সাকুল্যে ২৮টি, বিজেপি ২৫, ন্যাশনাল কনফারেন্স ১৫, কংগ্রেস ১২, অন্যরা মোট ৭। ৩৫টি আসনের কাছাকাছি পৌঁছলে পিডিপি অ-বিজেপি দলগুলির সহযোগিতায় সহজেই সরকার গড়তে পারত। এনসি সমর্থনের প্রস্তাব দিয়েছে, এবং সেটা মোটেই কথার কথা নয়। কংগ্রেসও নিঃশর্ত সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু যৌথ ভাবে হোক বা স্বতন্ত্র ভাবে, কংগ্রেস ও এনসি’র সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গড়ার ব্যাপারে পিডিপি’র দুটি বড় সমস্যা আছে।

প্রথমত, রাজ্যে এনসি এবং কংগ্রেস ক্ষমতাসীন ছিল, নাগরিকরা এই নির্বাচনে তাদের বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন, ফলে তাঁদের শরিক করে সরকার গড়লে সেটা হবে জনাদেশের পরিপন্থী, ভোটদাতাদের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনেরও প্রতিকূল। এ কথা অনস্বীকার্য যে, এপ্রিল মাসে লোকসভা নির্বাচনে এনসি যে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিল, তার তুলনায় বিধানসভা নির্বাচনে এই দলের ফল অনেক ভাল হয়েছে: কাশ্মীর উপত্যকায় বারোটি এবং জম্মুতে তিনটি আসনে জয়ী হয়েছে তারা। কিন্তু এটাও অস্বীকার করা চলে না যে, লোকসভা নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন এনসি’র বিরুদ্ধে জনমত রীতিমত প্রবল ছিল। তা ছাড়া, আবদুল্লা এবং মুফতি, দুই পরিবারেরই পারস্পরিক বিরাগ এতটাই তীব্র এবং তার পিছনে ‘আদর্শগত বিতৃষ্ণা’ এতটাই প্রবল যে, এনসি এবং পিডিপি কী ভাবে একসঙ্গে কাজ করবে সেটা ভাবা কঠিন। অন্য দিকে, কংগ্রেস কিছুটা ঘটনাচক্রে এবং অংশত প্রার্থীদের ব্যক্তিগত কৃতিত্বে ১২টি আসন পেয়ে গেছে, তা না হলে কংগ্রেসের নেতাদের অভূতপূর্ব দুর্নীতিতে রাজ্যের লোক অসম্ভব ক্ষুব্ধ, এবং সে ক্ষোভ নির্বাচনী মরসুমে মোটেই গোপন থাকেনি। যে দল কাশ্মীরে প্রতিপত্তি বিস্তারের জন্য বহু দিন ধরে বহু কাঠখড় পুড়িয়েছে, সেখানে মহারথী গুলাম নবি আজাদের নিজের এলাকায় দলের বিপর্যয়ই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কংগ্রেসের সম্পর্কে উপত্যকার মানুষের মনোভাব কেমন।

Advertisement

গুলাম নবি আজাদ কংগ্রেস, এনসি এবং পিডিপি’র যে মহাজোটের প্রস্তাব হাওয়া ভাসিয়েছেন, তার পথে আর একটা বড় বাধা হল জম্মুর নির্বাচনী ফল: সেই অঞ্চলের মানুষ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা বিজেপিকে চান। বস্তুত, কাশ্মীর উপত্যকার চেয়ে জম্মুর জনাদেশ অনেক বেশি স্পষ্ট। এই এলাকার বেশির ভাগ কেন্দ্রেই ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থীরা যে বিপুল ব্যবধানে জিতেছেন, সেটাই তাঁদের জনপ্রিয়তার প্রমাণ। কাশ্মীরে কিন্তু অনেক জায়গাতেই ভোটের ব্যবধান অনেক কম। শুধু আসনসংখ্যা নয়, জম্মুতে বিজেপির এই সাফল্য এবং বিপুল সাফল্যই তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আদর্শের ভিত্তিতে জোট খাড়া করে সরকার গঠনের নৈতিকতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। জম্মুর এই জনাদেশের পিছনে উপত্যকার প্রতি বিরূপ মনোভাবের একটা ভূমিকা নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু একটা গোটা অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিদের বাইরে রেখে সরকার তৈরি করা জম্মু ও কাশ্মীরের মতো একটা রাজ্যের পক্ষে স্বাস্থ্যকর না-ও হতে পারে। সম্প্রতি আবার কেউ কেউ পিডিপি, বিজেপি এবং কংগ্রেসকে নিয়ে অন্য এক মহাজোটের কথা বলছেন, কারণ তাতে জম্মু, কাশ্মীর এবং লাদখ, তিনটি অঞ্চলের প্রতিনিধিরাই সরকারের শরিক হতে পারবেন কংগ্রেস লাদখে চারটির মধ্যে তিনটি আসনেই জয়ী হয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস আর বিজেপি একই জোটে থাকবে কী করে? দিল্লির দরবার থেকে ‘বৃহত্‌ জাতীয় স্বার্থে’ জম্মু ও কাশ্মীরে এমন একটা জোটের প্রেরণা দেওয়া হবে, এমন আশা নিতান্ত দুরাশা।

পিডিপি এবং বিজেপি’র মধ্যে অন্তরালে রীতিমত আলোচনা চলছে, কিছু কিছু বিষয়ে ফাইল বিনিময়ও হয়েছে। কিন্তু দলের পনেরো বছরের ইতিহাসে পিডিপি’র পক্ষে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার চ্যালেঞ্জ আগে কখনও আসেনি। দর-কষাকষিতে বিজেপি’র পক্ষে তাদের দিক থেকে আপসরফার সূত্র দেওয়া তুলনায় সহজ, সংবিধানের ৩৭০ ধারার মতো বিতর্কিত প্রশ্নগুলিকে তারা ইতিমধ্যেই এক পাশে সরিয়ে রেখেছে, কিন্তু পিডিপি’র পক্ষে আপস মানে নিজের রাজনৈতিক আদর্শ থেকে সরে আসা। বিজেপি’র এখন প্রধান তাগিদ হল রাজ্যের শাসনক্ষমতায় শরিক হওয়া। ২০০৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই দল ১১টি আসন পেয়েছিল, সেখান থেকে ২৫-এ উঠেছে। এখন ক্ষমতায় এলে তারা নিজেদের জনভিত্তিটাকে আরও ভাল করে গড়তে পারবে এবং ভবিষ্যতে আরও বড় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে। তাদের রাজনৈতিক আদর্শ বা লক্ষ্যগুলি নিয়ে এখনই তত্‌পর না হলেও কোনও অসুবিধে নেই।

পিডিপি’র পক্ষে দুটো ব্যাপারই গুরুত্বপূর্ণ: রাজনীতির ময়দানে টিকে থাকার জন্যই তাদের ক্ষমতায় আসা দরকার, আবার এমনটাও যেন প্রতিপন্ন না হয় যে, ক্ষমতার জন্য তারা নিজেদের আদর্শগত ভাবে বিকিয়ে দিচ্ছে। মুফতি মহম্মদ সইদ দলের বিধায়ক এবং বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন, সকলের মতামত জানার চেষ্টা করছেন, কিন্তু কোন ধরনের জোট করলে তার কী পরিণাম হতে পারে, সেটাই তাঁর প্রধান চিন্তার বিষয়। ছ’বছরের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ তাঁর সামনে এসেছে বটে, কিন্তু তাঁর দলের ভবিষ্যত্‌ তাঁর কাছে আরও বড় প্রশ্ন।

বিজেপির সঙ্গে হাত মেলানোর স্বপক্ষে একটা যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে, এর ফলে রাজ্যে প্রচুর কেন্দ্রীয় সম্পদ আসবে এবং উন্নয়নের সুবিধে হবে। এই যুক্তি খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ ভারতের অনেক রাজ্যেই এখনও অ-বিজেপি সরকার, ঠিক যেমন কেন্দ্রে ইউপিএ’র শাসনকালেও অনেক রাজ্যে বিজেপির সরকার ছিল, কিন্তু সেই কারণে তাদের উন্নয়নের কড়ি জোগাতে কেন্দ্রীয় সরকার কার্পণ্য করছে এমন কোনও প্রমাণ নেই। পিডিপিকে যে বৃহত্তর সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে, সে সেই কর্মসূচির মধ্যে আছে: পাকিস্তানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ রেখা সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার প্রশ্নে দু’দেশের পারস্পরিক আস্থা নির্মাণের আয়োজন, একটা সুস্থির, নিরাপদ পরিবেশ তৈরি এবং রাজ্যের মানুষের জীবনে স্বস্তি আনার চেষ্টা। এই কর্মসূচি এবং তার অন্তর্নিহিত আদর্শ বা মনোভাব মেনে নেওয়া হয়তো বিজেপির পক্ষে সহজ হবে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইতিমধ্যে পাকিস্তান সম্পর্কে যে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন, এটা তার সঙ্গে মানানসই নয়। কিন্তু মুফতির মতে, কাশ্মীরকে বাদ দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্যা নিরসনের চেষ্টা সম্ভব নয়। উন্নয়নের চেয়েও রাজনৈতিক সমস্যাকে তিনি বেশি গুরুত্ব দেবেন, সেই প্রশ্নেই তিনি দর কষাকষিতে কঠোর অবস্থান নেবেন।

গত কয়েক মাসে মোদী বার বার বাজপেয়ীর পথ অনুসরণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। যদি পিডিপি এবং বিজেপির মধ্যে কোনও বোঝাপড়া শেষ অবধি সম্ভব হয়, তবে তিনি সেই ইচ্ছা পূরণের একটা সুযোগ পাবেন। কিন্তু কাশ্মীরে যে দল একটাও আসন পায়নি, তার সঙ্গে হাত মেলানো পোড়খাওয়া রাজনীতিক মুফতি মহম্মদ সইদের পক্ষে কঠিন হতে পারে। বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধাটা তাঁর কাছে আত্মরক্ষার আশায় ফাঁসির মঞ্চে এগিয়ে যাওয়ার শামিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement