প্রবন্ধ ২

‘চেষ্টা করছে, কিছু দিনের মধ্যে ভাল করবে’

‘ও পারে না।’ ‘তোমার কিস্সু হবে না।’ ‘কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক।’ এই চেনা ছকের বাইরে আর একটা উপায় আছে। ছোট ছোট পড়ুয়াদের ভালবাসা। তাদের মনটা বোঝা। তাদের কাছে যাওয়া, পাশে থাকা। দিব্যি কাজ হয় তাতে। পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়আবার গার্জিয়ান কল, আবার শিক্ষকদের হুঁশিয়ারি: ‘আপনার ছেলে অবাধ্য। কথা শোনে না। ক্লাসে কিচ্ছু লিখছে না, প্রশ্ন করলে একটা শব্দ মুখ থেকে বার করছে না। যদি এখনও নজর না দেন তা হলে ওকে স্কুলে রাখা হবে কি না আমাদের ভাবতে হবে।’

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share:

কালজয়ী। ‘টু স্যর উইথ লাভ’ (১৯৬৭)

আবার গার্জিয়ান কল, আবার শিক্ষকদের হুঁশিয়ারি: ‘আপনার ছেলে অবাধ্য। কথা শোনে না। ক্লাসে কিচ্ছু লিখছে না, প্রশ্ন করলে একটা শব্দ মুখ থেকে বার করছে না। যদি এখনও নজর না দেন তা হলে ওকে স্কুলে রাখা হবে কি না আমাদের ভাবতে হবে।’

Advertisement

কলকাতার এক নামী বেসরকারি স্কুলের ক্লাস টু-এর এক ছাত্র। ইংরাজি ক্লাস, কম্পিউটার ক্লাসের পড়া তার এক্কেবারে ভাল লাগে না। পেনসিল বক্সটাকে গাড়ি বানিয়ে সে খেলতে থাকে। পড়াকে তার কাছে কী করে আকর্ষণীয় করে তোলা যায় তা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন বা সময় নেই শিক্ষকের। ঝামেলা এড়ানোর সহজ পন্থা হিসাবে প্রায় রোজই তাকে ক্লাসের বাইরে বার করে দেওয়া হয়। সাত বছরের ছেলে স্কুলের বাগানে, মাঠে ঘুরে বেড়ায়। পড়ার থেকে সেটা তার কাছে অনেক বেশি ভাল লাগার। তাই পরের ক্লাসে সে ইচ্ছা করে বদমায়েশি করে, যাতে টিচার তাকে আবার বার করে দেন। সেটাই তার কাম্য এসকেপ রুট।

আর একটি ছেলে, ক্লাস থ্রি। পড়াশোনায় বেশ খানিকটা পিছিয়ে। সর্বসমক্ষে ক্লাস টিচার তাকে সম্বোধন করেন ইডিয়েট হনুমান মাথামোটা ইত্যাদি বিশেষণে। ইউনিট টেস্টে ছেলেটি প্রায় কিছুই লিখতে পারে না। এক ইনোভেটিভ শাস্তি বার করেন শিক্ষক। সহপাঠীদের বলেন, বোর্ডে বড় বড় করে লিখে দিতে, ‘অমুক ইজ আ ব্যাড বয়।’ এবং নির্দেশ দেন, সারা দিন বোর্ডে এই লেখাটা থাকবে। মোছা হবে না। ভিতরে ভিতরে অপমানে, অভিমানে তলিয়ে যেতে থাকে ছেলে। সেখান থেকে জন্মায় বিদ্রোহ। ‘হ্যাঁ, আমি ব্যাড বয়। কেউ আমাকে ভালবাসে না, বাসতেও হবে না। ব্যাডই থাকব আমি। গুড হব না। আরও আরও ব্যাড হব।’

Advertisement

উত্তর কলকাতার এক বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্রীর মানসিক কাউন্সেলিং চলছে। ছ’বছরের শিশুটি একটু অন্তর্মুখী। পড়া বুঝতে একটু সময় লাগে তার। অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চটপট বোর্ড দেখে লিখতে পারে না, যোগে ভুল হয়ে যায়। ক্লাস টিচার মেয়েটিকে বসিয়ে দেন লাস্ট বেঞ্চে। বাকি বাচ্চাদের ফরমান দেন, ‘ও বাজে মেয়ে। কেউ ওর সঙ্গে খেলবে না।’ মেয়েটিকে তিনি বলেন, ‘পড়া না পারলে তোমাকে বস্তায় ভরে দেব। স্কুলের ছাদে ভূতের ঘরে সারা দিন তালা দিয়ে রাখব আর বাবা-মাকে বলে দেব যেন তাঁরা তোমার বদলে অন্য একটা মেয়ে নিয়ে আসেন।’

শিক্ষিকার এই কয়েকটা বাক্য ছ’বছরের মনকে ফালাফালা করে দেয়। একেবারে চুপ করে যায় মেয়েটি। ঘুমের মধ্যে চিত্‌কার করে জেগে ওঠে, বিছানা ভিজিয়ে ফেলে। শিক্ষিকা তখনও যুক্তি দেন, ‘আমি ওকে মারিনি, বকিওনি। কোনও ভাবে তো আমাদের বাচ্চাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সেটাই করেছিলাম।’

মারা বা বকা নয়, ছাত্রছাত্রীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য একটা অন্য ধাঁচের শাসন দরকার। শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে গভীর যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন তৈরি না হলে সেই শাসন করা যায় না। আগে ক্লাসের প্রতিটি ছাত্রের দুর্বলতা-সবলতা, ভাল লাগা-মন্দ লাগা শিক্ষক জানবেন। প্রত্যেকের সঙ্গে তাঁর লাগাতার, সাবলীল কথাবার্তা থাকবে, মানবিক বোঝাপড়া থাকবে। তবেই তিনি সেই শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। শিশুদের মন অত্যন্ত স্পর্শকাতর। কোন শিক্ষক তাকে কেয়ার করছেন, এক জন শিশু সেটা অসম্ভব ভাল বুঝতে পারে এবং মনে মনে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে। সেই শিক্ষক তাকে দৃঢ় ভাবে কিছু বললে বা ধৈর্যের সঙ্গে কিছু বোঝালে সে তখন সেটা মেনে চলার চেষ্টা করে।

কলকাতার খুব কাছে মফস্সলের এক ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে ক্লাস থ্রি’তে পড়ে মেয়েটি। কোনও সাবজেক্টেই তার ভাল নম্বর হয় না, ব্যতিক্রম শুধু অঙ্ক। ঝপাঝপ অঙ্ক করে সে। অভিভাবকরা আবিষ্কার করেন, অন্য শিক্ষকেরা কথায় কথায় তার নিন্দা করতেন, খোঁটা দিতেন, কিন্তু অঙ্কের ম্যাডাম কাছে ডেকে বোর্ডে অঙ্ক কষাতেন। ভুল হলেও গোটা ক্লাসকে বলতেন, ‘ও খুব ভাল চেষ্টা করেছে। পরের বার আরও ভাল করবে। তোমরা সবাই হাততালি দাও।’ খাতায় চারটের মধ্যে একটা অঙ্ক ঠিক হলে তিনি তার নীচে বড় করে ‘গুড’ লিখে দিতেন। পেরেন্ট-টিচার মিটিংয়ে সকলের সামনে মেয়েটিকে কোলে টেনে নিয়ে আদর করে বলতেন, ‘ও খুব ইন্টেলিজেন্ট। আমার খুব প্রিয় ছাত্রী।’ ম্যাজিকের মতো কাজ করেছিল এই ট্রিটমেন্ট। দ্বিগুণ উত্‌সাহে অঙ্ক করতে থাকে সেই মেয়ে। অঙ্কে নম্বর বাড়তে থাকে হুহু করে।

একটা পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে দেখেছিলেন কলকাতার এক দল মনোবিশেষজ্ঞ। উল্টোডাঙার একটি সরকারি স্কুলের ক্লাস নাইন। পড়ুয়ারা বেশির ভাগই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। কেউ স্কুলের বাইরে মাছের দোকানে বসে, কেউ খবরের কাগজ বিলি করে, কেউ গাড়ির চাকায় হাওয়া দেয়। শিক্ষকেরা তাদের আচরণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘নাইনের প্রত্যেকটা ছেলে উচ্ছন্নে গিয়েছে। মেরেও এদের রাস্তায় আনা যাবে না। কেউ পাশ করবে না মাধ্যমিকে।’ দু’তিন জন মনোবিশেষজ্ঞ সেই ক্লাসে গিয়ে ছেলেদের সঙ্গে একটু একটু করে আলাপ জমালেন। প্রথম ক’দিন শুধু গল্প করে তাদের বাড়ির খবর, কে কী ভাবে বাড়িতে সময় কাটায়, কার কী কাজ সবচেয়ে পছন্দের, সব জানলেন। ছুটি হওয়ার পরেও তাঁরা কিছুক্ষণ ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মারতেন, মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলায় ছাত্রদের উত্‌সাহ দিয়ে আসতেন।

তার পর এক দিন একটা খেলা খেলানো হল। ক্লাসের ছেলেদের দু’ভাগে ভাগ করা হল। এক দল তাদের মনের জমে থাকা নানা সুখদুঃখের কথা বলবে আর তাদেরই সহপাঠীদের আর একটি দল সে সব শুনবে। যারা শোনার দলে ছিল বিশেষজ্ঞেরা তাদের আগে থাকতে গোপনে বলে দিলেন, তারা যেন কথা না শোনার ভান করে। তা-ই হল। এর পর যারা কথা বলার দলে ছিল তাদের জিজ্ঞাসা করা হল, বন্ধুরা যখন তাদের কথা শুনছিল না তখন তাদের কেমন লাগছিল? প্রত্যেকেই বলল, তাদের খুব খারাপ লাগছিল। তখন বিশেষজ্ঞরা বোঝালেন, শিক্ষকরা পড়ানোর সময় ছাত্ররা তাঁদের কথা না শুনলে তাঁদেরও এই রকম খারাপ লাগে। তিন মাস লেগেছিল ক্লাস নাইনের বদলে যেতে।

মারধর করা মানে মানসিক লড়াইয়ে এক জন অল্পবয়স্ক ছাত্র বা ছাত্রীর কাছে শিক্ষকের হেরে যাওয়া। তিনি আর কোনও পথ বার করতে পারছেন না, অসহায় হয়ে চরম অস্ত্র প্রয়োগ করে ফেলছেন। এক সময় সেই অস্ত্রও ফেল করে। একরত্তি ছাত্র তুমুল ঔদ্ধত্যে পিঠের জামা তুলে বা গাল এগিয়ে দিয়ে শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে বলে, বিশেষজ্ঞেরা ‘মারবে? মারো, এই নাও মারো, আমি তা-ও কথা শুনব না।’ তখন কী উপায় হবে? কী করবেন শিক্ষক?

এক প্রবীণ মনোবিদ বলছিলেন, মারার দরকার নেই। গলার স্বর একটু চড়িয়ে, একটু চোখ বড় করে কিংবা অবাধ্য বাচ্চার দু’টো হাত নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকলেই অনেকটা কাজ হয়। আসলে নিজের কাজ নিয়ে, নিজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অনেক অনেক ভাবতে হবে শিক্ষকদের। এটা ঠিক যে, এ দেশে শিক্ষকদেরও অনেক সমস্যা। তবে কিছু করার তাগিদ ভিতর থেকে এলে খানাখন্দ ডিঙিয়েও কিছু করা যায়।

কলকাতার কয়েকটি স্কুলে ঘুরে একটা সমীক্ষা চালিয়েছিলেন এক সরকারি হাসপাতালের কয়েক জন মনস্তাত্ত্বিক। কী কী ভাবে দুষ্টু বাচ্চাদের বুঝিয়ে লেখাপড়ায় আগ্রহী করা যায় তা নিয়ে হাতেকলমে সমীক্ষা। একটি বাচ্চা এক মুহূর্ত স্থির হয়ে বসছে না, একে ওকে খোঁচাচ্ছে। মনস্তাত্ত্বিক দলের এক প্রতিনিধি তার দিকে কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে রইলেন। তার পর তাকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘ও বোধ হয় কিছু বলতে চায়। ওর কেন ক্লাস ভাল লাগছে না সেটা ও বলবে আর আমরা শুনব।’ সমীক্ষকদের মতে, অনেক বাচ্চাই বাড়তি অ্যাটেনশন চায় এবং তার জন্য নেগেটিভ কাজ করে। যে মুহূর্তে সে আলাদা মনোযোগ পেল, সে চুপ করে যাবে, শান্ত হয়ে যাবে।

উত্তর কলকাতার একটি সরকারি ছেলেদের স্কুলে শিক্ষকরা বৈঠক করে ঠিক করলেন, পরীক্ষামূলক ভাবে ক্লাসের অবাধ্য ছেলেদের কোনও না কোনও গুণ খুঁজে বার করা হবে। যেমন, কেউ ভাল ক্রিকেট খেলে, কেউ গান গায়, কেউ ক্যারাটে করতে পারে, কারও পেপারকাটিংয়ের হাত চমত্‌কার, কেউ ফাটাফাটি গোলকিপিং করে। সপ্তাহে অন্তত দু’তিন দিন ক্লাসে খানিকটা সময় ওই ছেলেদের পছন্দের বিষয় নিয়ে শিক্ষকেরা আলোচনা করতেন। ছেলেরা ওই বিষয়ে কতটা ভাল তা নিয়ে প্রশংসা করতেন, উত্‌সাহ দিতেন। ছ’মাসের মধ্যে সেই ‘কমিউনিকেশন’-এর ইতিবাচক ছাপ পড়েছিল তাদের পড়াশোনায়। পড়ায় মন দিতে শুরু করেছিল ‘দুষ্টু’ ছেলেগুলো।

অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদরা বলছেন, ক্লাসে যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল বা অমনোযোগী, পড়া চলাকালীন ক্রমাগত তাদের ছোট ছোট প্রশ্ন করা, তাদের থেকে প্রশ্ন চাওয়া উচিত, যাতে সেই সময় অন্য কোথাও তাদের মন চলে যাওয়ার সুযোগই না থাকে। অমনোযোগীদের লাস্ট বেঞ্চে বসানো নিষিদ্ধ। সামনে অনেকগুলো মাথা নাড়াচাড়া করলে তাদের মনোযোগ আরও পালাবে। তাদের বার বার ডেকে বোর্ডওয়ার্ক করাতে হবে। ভুল হলে বকুনি বা ভয় দেখানো চলবে না। বরং বলতে হবে, ‘ও আজকে খুব ভাল চেষ্টা করেছে। এই রকম চললে কিছু দিনের মধ্যে সব পারবে।’

হোমওয়ার্ক শেষ করতে পারেনি বা বোর্ডের লেখা কপি করতে পারেনি বলে ক্লাসের পরে অতিরিক্ত সময় শিশুকে বসিয়ে কপি করিয়ে তার পর নিজের দায়িত্বে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার নজিরও রয়েছে কয়েকটি স্কুলের। মধ্য কলকাতার একটি স্কুলের ক্লাস টুয়ের হাইপারঅ্যাকটিভ বাচ্চা। বাবা-মা দিশেহারা। স্কুলের ইতিহাসের দিদিমণি এক দিন বাবা-মাকে ডেকে সেই বাচ্চাকে সাঁতার, ক্যারাটের মতো ঘাম-ঝরানো ব্যাপারে যুক্ত করার পরামর্শ দিলেন। এতেই দু’মাসের মধ্যে অস্থিরতা অনেকটা কেটেছিল ছেলেটির।

শুধু মারের ভয় দেখিয়ে, বকুনি দিয়ে বা গার্জিয়ান কল করে অভিযোগ উগরে দিলে এই জীবনগুলো হয়তো নিরন্তর দিশা হাতড়ে যেত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement