মদন মিত্রের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী গোষ্ঠ পালকে ব্যাক-এ রাখিয়া ময়দানে নামিয়াছেন। আশ্চর্য ব্যাপার? মোটেও নহে। ইদানীং তাঁহার উত্তরোত্তর দিশাহারা আচরণ এবং লাগামছাড়া কথাবার্তাতেও বিস্ময়ের কিছুমাত্র কারণ নাই। এমনটি না হইলেই নজরদার নাগরিক অবাক হইতেন। মধ্যরাত্রের মহানগরে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠিলে যিনি ‘সাজানো ঘটনা’র তত্ত্ব খাড়া করিয়া সম্পূর্ণ অকারণ নিজেকে জড়াইয়া ফেলেন, মন্ত্রিসভার সহকর্মী এবং স্নেহধন্য সহচর সিবিআইয়ের হেফাজতে চলিয়া গেলে তিনি ‘আইন আইনের পথে চলিবে’ বলিয়া আপন কাজে মন দিবেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপন স্বভাবে অবিচল। সম্ভবত নিরুপায়ও। অতলান্ত দুর্নীতির অভিযোগ যে ভাবে তাঁহার বিবিধ গ্রহ এবং উপগ্রহগুলিকে গ্রাস করিতেছে, আটপৌরে শাড়ি, হাওয়াই চপ্পল এবং মুড়ি-তেলেভাজায় সুনির্মিত তাঁহার ভাবমূর্তিতে সেই সকল কলঙ্কের ছায়া যে ভাবে গাঢ় হইতে গাঢ়তর হইতেছে, তাহাতে আক্রমণই হয়তো এখন তাঁহার আত্মরক্ষার একমাত্র অস্ত্র। কত দিন সেই অস্ত্র কাজ করিবে? হীরক রাজ্যের জ্যোতিষী চতুর হাসি আড়াল করিয়া বলিতেন: যত দিন তত দিন।
শ্রীযুক্ত মদনগোপাল মিত্র এবং তাঁহার অগ্রপথিকরা কেহই এখনও দোষী সাব্যস্ত হন নাই, অচিরে হইবেন বলিয়াও মনে হয় না বিচারের পথ সুদীর্ঘ। আইনের চোখে তাঁহারা আপাতত অভিযুক্তমাত্র। কিন্তু ‘জনতার আদালত’ অন্য বস্তু। সেই আদালতে ধারণার গুরুত্ব অপরিসীম এবং সেই ধারণার নির্মাণে ও পরিবর্তনে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ভূমিকা বিরাট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাহা বিলক্ষণ জানেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তাঁহার বিপুল সাফল্যের পিছনে সমাজের ধারণার অবদান ছিল অপরিসীম। এই রাজ্যের নাগরিকদের একটি বড় অংশ তাঁহাকে চিনিয়াছিলেন এক জন সত্ রাজনীতিক হিসাবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যিনি আপসহীন। সেই প্রতিবাদী সততাকে কুর্নিশ করিয়াই অনেকে তাঁহার বহু ত্রুটি এবং সীমাবদ্ধতাকে মানিয়া লইয়াছেন। সারদা কেলেঙ্কারির অভিঘাতে সেই ধারণা ভয়ানক ভাবে বিপর্যস্ত। নাগরিকরা বিস্ফারিতনয়নে দেখিতেছেন, শাসক দলের সহগামী ও প্রসাদধন্য ‘বিদ্বজ্জন’ হইতে শুরু করিয়া নেতা, সাংসদ, মন্ত্রীর নাম একের পর এক এই অতিকায় প্রতারণার সহিত জড়াইয়া পড়িতেছে এবং দলনেত্রী ও রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক তারস্বরে ‘ষড়যন্ত্র’ ‘ষড়যন্ত্র’ বলিয়া সেই অভিযুক্তদের পাশে দাঁড়াইতেছেন। জনমানসে ইহার অনিবার্য প্রতিক্রিয়া একটিই। মানুষ ভাবিতেছেন যে, অভিযোগ তবে মিথ্যা নহে, তাহা না হইলে মুখ্যমন্ত্রীকে সব কাজ এবং জলসা ফেলিয়া ‘আমরা ভাল লক্ষ্মী সবাই তোমরা ভারী বিশ্রী’ হুঙ্কার দিয়া পথে নামিতে হইবে কেন এবং আপনবেগে পাগলপারা গালিগালাজের বন্যা ছুটাইতে হইবে কেন?
সারদা হইতে খাগড়াগড়, বিবিধ কেলেঙ্কারির তদন্তে তত্পর না হইয়া এবং সমস্ত প্রয়োজনীয় সাহায্য না করিয়া পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন কেন ক্রমাগত উল্টো পথে হাঁটিতেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন রাজধর্ম পালন না করিয়া আপন সরকারের মুখে ক্ষুদ্র রাজনীতির চুনকালি মাখাইয়া এবং রাজ্য ও দেশের ক্ষতি সাধন করিয়া চলিয়াছেন, আজ বোধহয় আর সে সকল প্রশ্ন তুলিয়া কোনও লাভ নাই। পথ চলিতে দুই-চারিটি চোরকাঁটা শাড়িতে বিঁধিলে তাহা তুলিয়া ফেলা যায়, কিন্তু চোরকাঁটারা সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হইলে এবং ক্ষমতার স্বার্থে তাহাদের প্রশ্রয় দিয়া চলিলে এক সময় তাহারাই রাজদণ্ডকে গ্রাস করিয়া লয়। মদন মিত্র মহাশয়ের বাণী সত্য হইয়াছে, বিন্দু বিন্দু জমিয়া সিন্ধু হইয়াছে। সেই পঙ্কসাগরে পশ্চিমবঙ্গ ডুবিতেছে। আত্মঘাতের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে সেই সলিলসমাধির লক্ষ্যে অবতরণ করিতে করিতে সর্বাধিনায়িকা ঘোষণা করিতেছেন: কে আটকাইবে, আইস চ্যালেঞ্জ।