একটি অপ্রিয় সিদ্ধান্ত লইলেই বলিষ্ঠ এবং সাহসী রাষ্ট্রনায়কের দায় ফুরায় না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁহার সাহস এবং বলিষ্ঠতা প্রমাণের কাজ শুরু করিয়াছেন। অতঃপর তাঁহাকে স্বনির্দেশিত সেই পথ অনুসরণ করিতে হইবে। আরও অনেকগুলি অপ্রিয় সিদ্ধান্ত বলবৎ করিতে হইবে। দ্রুত। আগামী স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লায় দাঁড়াইয়া বলিবার জন্য অপেক্ষা করিলে চলিবে না। স্বাধীনতা দিবস বছরে এক বার আসে। এক বছর অতি দীর্ঘ সময়। কাজের বিশদ তালিকা পেশ করিবার অবকাশ নাই, তাহার প্রয়োজনও নাই। আপাতত একটি কাজের কথাই যথেষ্ট। যে চিনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া যোজনা কমিশনকে বিদায় জানানো হইতেছে, এমনকী তাহার স্থলে প্রস্তাবিত নূতন সংস্থাটির নামও ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট রিফর্ম কমিশন রাখিবার কথা উঠিয়াছে, সেই চিনের রীতি অনুসারেই প্রধানমন্ত্রী আর একটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে মনোযোগ করিতে পারেন। সেই প্রতিষ্ঠানটির নাম কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা।
নরেন্দ্র মোদী যখন তাঁহার মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তুতি চালাইতেছিলেন, তখন আশা জাগিয়াছিল, তিনি একটি যথার্থ নির্মেদ সরকার তৈয়ারি করিবেন। সেই আশা সম্পূর্ণ বিফল হয় নাই, পূর্ববর্তী ইউপিএ সরকারের মন্ত্রিসভা অপেক্ষা প্রায় চল্লিশ শতাংশ ক্ষুদ্রতর মন্ত্রিসভা লইয়া এনডিএ সরকার কাজ শুরু করিয়াছিল। কিন্তু পরিমাণগত পরিবর্তন কখন গুণগত পরিবর্তনে পর্যবসিত হইবে, তাহা শতাংশের পাটিগণিত কষিয়া স্থির করা যায় না। প্রধানমন্ত্রী মোদী যথার্থ প্রশাসনিক সংস্কারের সূচনা করিতে চাহিলে মনমোহন সিংহের সরকারকে মাপকাঠি সাব্যস্ত করিলে চলিবে না, যথার্থ মেদবর্জিত প্রশাসনের সহিত নিজের তুলনা করিতে হইবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উৎকৃষ্ট মাপকাঠি, কিন্তু আপত্তি উঠিতে পারে: উন্নত দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশ অ-তুলনীয়। চিন আমেরিকা নহে, তদুপরি ভারতের সহিত তাহার তুলনা বহুলপ্রচলিত। চিনে মন্ত্রিসভার আয়তন মনমোহন সিংহের তুলনায় প্রায় এক-চতুর্থাংশ, কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর তুলনায়ও অর্ধেকের কম। চিনে ঠিক যে যে মন্ত্রক আছে, মন্ত্রকগুলিকে যে ভাবে ভাগ করা হইয়াছে, ভারতেও তাহাই করিতে হইবে, এমন নিশ্চয়ই নহে। সামাজিক পরিস্থিতির জটিলতার কারণে ভারতে কয়েকটি বিশেষ দফতরের প্রয়োজনও হয়তো আপাতত থাকিতে পারে। কিন্তু সে সকলই খুঁটিনাটির প্রশ্ন। মূল চরিত্রে সাদৃশ্য বিস্তর। কেন সমস্ত জ্বালানি বা সমস্ত পরিবহণের জন্য একটি করিয়া মন্ত্রক যথেষ্ট নয়, তাহার কোনও সদুত্তর মনমোহন সিংহের ঝুলিতে ছিল না, নরেন্দ্র মোদীর তহবিলেও নাই।
মন্ত্রিসভার সদস্যদের শিক্ষাদীক্ষা বা কর্মক্ষেত্রের বিচারেও চিনের নিকট ভারতের শিখিবার আছে। গত দশকের প্রথমার্ধে জিয়াং জেমিন-এর নেতৃত্বে চিনের কমিউনিস্ট পার্টি দলীয় তথা প্রশাসনিক কাঠামোয় শিল্পোদ্যোগী ও পেশাজীবীদের গুরুত্ব দানের যে রীতি প্রবর্তন করে, তাহা উত্তরোত্তর জোরদার হইয়াছে। এখন চিনের প্রশাসনের উচ্চস্তরে, বিশেষত মন্ত্রিসভায়, উচ্চশিক্ষিত, প্রশিক্ষিত এবং পেশাজীবী সদস্যের আধিপত্য অতি প্রবল। ভারতের মতো দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পথে উঠিয়া আসা নেতৃত্ব সচরাচর উচ্চশিক্ষায় কৃতী হইবেন না, তাহা অপ্রত্যাশিত নয়। এমনকী, তাঁহাদের অনেকের মনেই উচ্চশিক্ষিত বা পেশাজীবীদের প্রতি এক ধরনের অসূয়া নিহিত থাকিবে, ইহাও অস্বাভাবিক নহে। কিন্তু সেখানেই প্রকৃত নেতার দায়িত্ব। নির্বাচনী রাজনীতির পথে না হউক, সমান্তরাল প্রক্রিয়ায় তেমন যোগ্য ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভায় লইয়া আসিতে হইবে। মনমোহন সিংহকে নরসিংহ রাও সেই ভাবেই আনিয়াছিলেন। নরেন্দ্র মোদী এখনও তাহার কোনও উদ্যোগ করেন নাই। করা দরকার। তাহা না হইলে, যোজনা কমিশন-উত্তর পর্বেও চিন দূর অস্ত্।