সম্পা়দকীয় ১

চাকা আবিষ্কার

এক শত টাকা আয় করিতে যদি ৯২ টাকা খরচ করিতে হয়, তবে উন্নয়নের জন্য আর কী পড়িয়া থাকে? প্রশ্নটি ভারতীয় রেলের সমবয়সি না হইলেও প্রাচীন। লালুপ্রসাদ যাদব যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, প্রশ্নটি তখনও ছিল, নীতীশ কুমারের সময়েও ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলেও। সুরেশ প্রভুও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রশ্নটি পাইয়াছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:৪৯
Share:

এক শত টাকা আয় করিতে যদি ৯২ টাকা খরচ করিতে হয়, তবে উন্নয়নের জন্য আর কী পড়িয়া থাকে? প্রশ্নটি ভারতীয় রেলের সমবয়সি না হইলেও প্রাচীন। লালুপ্রসাদ যাদব যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, প্রশ্নটি তখনও ছিল, নীতীশ কুমারের সময়েও ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলেও। সুরেশ প্রভুও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রশ্নটি পাইয়াছেন। ঘটনাক্রমে, এই দফায় উত্তর খুঁজিবার দায়টি খানিক হইলেও অর্থমন্ত্রীর, কারণ ২০১৭ সালে আর পৃথক রেলবাজেট থাকিবে না, তাহা সাধারণ বাজেটের অন্তর্ভুক্ত হইবে। নোট বাতিলের ডামাডোলের মধ্যেও যে অরুণ জেটলি রেলের ‘অপারেটিং রেশিও’-র কথা ভাবিতে পারিয়াছেন, তাহা চমৎকৃত করিয়া দেওয়ার ন্যায় তথ্য। অবশ্য, যখন কোনও একটি দুশ্চিন্তা চাপিয়া বসে, গুরুজনরা তখন অন্য কোনও বিষয়ের কথা ভাবিতে পরামর্শ দিয়া থাকেন। অরুণ জেটলি ভাবিয়াছেন। এবং, একটি সমাধানসূত্রও খুঁজিয়া পাইয়াছেন— রেলে ভর্তুকি তুলিয়া দিতে হইবে। বিজ্ঞাপনই হউক অথবা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, ভর্তুকি না তুলিলে কোনও পথেই যে রেলের অর্থসংকট মিটানো সম্ভব নহে, অর্থমন্ত্রী তাহা বুঝিয়াছেন। গত আড়াই বৎসরে বোঝেন নাই কেন, কেহ জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। যে যাত্রাপথের ভাড়া হওয়া উচিত ১০০ টাকা, রেল তাহার জন্য মাত্র ৫৭ টাকা লয়। বাকি ৪৩ টাকা ভর্তুকি। ভর্তুকি রদ করিতে হইলে, অতএব, যাত্রিভাড়া ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি করিতে হয়। সেই সাহসও অর্থমন্ত্রীর হইবে কি? উত্তরটি যে নেতিবাচক, রেলমন্ত্রক সূত্রে সেই ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই মিলিয়াছে। অর্থাৎ, জেটলি আরও এক বার চাকা আবিষ্কার করিলেন বটে, সংস্কারের গাড়ি কিন্তু গড়াইবে না। এত দিন যেমন গড়ায় নাই, ঠিক তেমনই।

Advertisement

দড় রাজনীতিকের হাতে পড়িলে ভর্তুকি বস্তুটি দুই ধারওয়ালা তরবারি হইয়া উঠে। নিজের জন্য ভোটের ব্যবস্থা, উত্তরসূরিদের জন্য অত্যাগসহন বোঝার উত্তরাধিকার। রেল যুগের পর যুগ সেই বোঝা বহিতেছে। কেন পণ্য মাসুল বাড়াইয়া যাত্রিভাড়ায় ভর্তুকি দেওয়ার খেলাটি কখনও বন্ধ হয় নাই, সেই প্রশ্নের উত্তর আরও বহু দিকে ইঙ্গিত করিবে বটে, কিন্তু ভোটের অঙ্কটি অগ্রাহ্য করিবার নহে। আগেকার আমলে তবুও যুক্তি ছিল, দরিদ্র মানুষকে বাছিয়া লইয়া ভর্তুকি দেওয়ার উপায় না থাকায় ভাড়ায় সকলকেই ভর্তুকি দেওয়া হয়। আজ প্রধানমন্ত্রী যখন ‘ডিজিটাল, ডিজিটাল’ রবে দেশ মাত করিতেছেন, তখন এই যুক্তিটিই বা দাঁড়ায় কোথায়? প্রয়োজনে না হয় গরিবদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সম্পূর্ণ ভাড়াটাই পাঠাইয়া দিন। কিন্তু, টিকিটের দামে ভর্তুকি থাকিবে কেন? মধ্যবিত্তের ভোটের মায়া কাটাইয়া ওঠা অবশ্য কঠিন কাজ। অন্যরা যখন পারেন নাই, তখন অরুণ জেটলিরা পারিবেন, আশা করা অনুচিত হইবে।

সরকার কেন আদৌ রেলভাড়া নির্ধারণ করিবে, এই প্রশ্নের কোনও যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর নাই। দিল্লির মসনদে বসিলে নেতারা ভুলিয়া যান, বাজার নামক একটি বস্তু আছে। বিমানভাড়া যদি বাজারের নিয়মে ধার্য হইতে পারে, রেলভাড়াই বা নহে কেন? সুরেশ প্রভু কয়েক মাস পূর্বে কিছু সংস্কারমূলক কথা বলিয়াছিলেন। আশঙ্কা হয়, সেই ফাইলে ধুলা জমিতেছে। অথবা ভাইরাস। যাত্রীদের নিকট ভাড়া বাবদ অন্তত প্রকৃত ব্যয়টুকু তুলিতে হইবে, শুধুমাত্র এই নিয়ম বাঁধিয়া সরকার ভাড়া ঠিক করিবার দায়িত্বটি ছাড়িয়া দিক। রেল নিজস্ব নিগম গড়িয়া ভাড়া নির্ধারণ করুক। সংস্কার যদি করিতে হয়, তবে তাহা প্রকৃত সংস্কার হওয়াই বিধেয়। ক্রমাগত পিটুলিগোলা খাওয়াইয়া চলিলে অর্থনীতির কী হাল হয়, রেলের দিকে তাকাইয়াও কি অর্থমন্ত্রী বুঝিতে পারিতেছেন না?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement