বন্দিদের উপর নির্মম নির্যাতন চালাইবার বর্বরতা আধুনিক সভ্যতা নিয়ত প্রত্যক্ষ করিতেছে। সকলের চোখের সামনেই ধর্মান্ধ শস্ত্রধারীরা নিরস্ত্র বন্দিদের গলার নলি কাটিয়া বিশ্ববাসীকে সেই রক্তাক্ত বর্বরতার ভিডিয়ো দৃশ্য প্রদর্শন করিতেছে। এই ধরনের নৃশংসতার বিরুদ্ধে নিন্দামুখর হওয়া, জনমত সৃষ্টি করা অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু লোকচক্ষুর অগোচরে দেশে দেশে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার নির্যাতন-শিবিরগুলিতে স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে বন্দিদের উপর যে অমানবিক নিষ্ঠুরতা চলে, তাহা গোপনই থাকিয়া যায়। মার্কিন গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হইল, কিছু কাল পর-পর এই গোপন নথিগুলি সর্বসমক্ষে প্রকাশ করিয়া দেওয়া। সম্প্রতি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ অনুসৃত পদ্ধতির এমনই একটি রোমহর্ষক বিবরণীর সংক্ষিপ্তসার মার্কিন সেনেট প্রকাশ করিয়াছে। স্বভাবতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বস্তুত সমগ্র সভ্য বিশ্বেই হইচই পড়িয়া গিয়াছে। ইহাই যদি মুক্ত দুনিয়ার অবাধ গণতন্ত্রের বন্দিদের প্রতি আচরণ হয়, তবে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলির অত্যাচার দেখিয়া স্তম্ভিত হওয়ার কিছু নাই।
ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা তবু অন্ধকারের জীব। সিআইএ তো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা, যে-রাষ্ট্রের আইনে এ ভাবে বন্দি-নির্যাতন আইনবিরুদ্ধ। সিআইএ আইন লঙ্ঘন করিয়াই অপকর্ম অব্যাহত রাখিয়াছে। সিআইএ এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পরোয়া করে নাই, নিজেই কার্যত একটি সমান্তরাল শাসনপ্রণালী একতরফা ভাবে অনুশীলন করিয়াছে। ইহা মার্কিন গণতন্ত্রের পক্ষে শ্লাঘার বিষয় নয়। শুধু এইটুকু বলিলে মনে হইতে পারে, এমন সমান্তরাল বন্দোবস্ত বুঝি কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই রহিয়াছে। পাকিস্তানের আইএসআই, ইজরায়েলের মোসাদ, ইরানের সাভাক, ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের কেজিবি একই ধরনের গোয়েন্দা সংস্থা, আইনের শাসনের কাছে যাহাদের জবাবদিহির বিশেষ দায় নাই। অতীতে লাতিন আমেরিকার দেশে দেশেও এ ধরনের সংস্থা হাজার-হাজার ‘রাষ্ট্রদ্রোহে অভিযুক্ত’ বন্দিকে নির্যাতনের পর এই গ্রহ হইতে নিয়মিত অদৃশ্য করিয়া দিত, পরেও তাহাদের কোনও হদিশ মিলিত না।
মার্কিন গণতন্ত্রের শক্তি হইল, এই ধরনের অন্যায়, অনাচার, অমানবিক বর্বরতার ঘটনাগুলি রাষ্ট্রই আবার একত্র করিয়া নিয়মিত দেশবাসীর সম্মুখে পেশ করে। আর ইহার মধ্যেই নিহিত থাকে আইনের শাসনের প্রতি এই গণতন্ত্রের দায়বদ্ধতা। প্রকৃত গণতন্ত্র নিজের ব্যবস্থাগত ত্রুটিবিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা ব্যক্ত করিতে ভয় পায় না, বরং সেগুলিকে সকলের সামনে উন্মোচিত করিয়া তাহা লইয়া জাতীয় বিতর্কের অবতারণা করিয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকে শুদ্ধ করিতে সচেষ্ট হয়। চিন, রাশিয়া কিংবা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যেমন ভূরি ভূরি, সেগুলিকে গোপন রাখার রাষ্ট্রীয় প্রয়াস তেমনই মরিয়া। ফলে অনাহারে-দুর্ভিক্ষে কোটি কোটি মানুষ নিহত হইলেও সেই সমাচার সমাজতান্ত্রিক চিন বছরের পর বছর গোপন করিয়া যায়। রুশ গোয়েন্দা সংস্থা আজও পুতিন-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের লোপাট করিয়া দেয়, উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্রনেতার প্রতি জায়মান যে-কোনও কাল্পনিক চ্যালেঞ্জ নির্মূল করিতেও প্রকাশ্যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কোতল করে। তবে অন্যে মানবাধিকার লঙ্ঘন করিতেছে বলিয়াই সিআইএ-কেও তাহা করিতে দেওয়া উচিত, ইহা কোনও যুক্তি নয়। মার্কিন প্রশাসনের তাই উচিত, সিআইএ-র সংবিধান-বহির্ভূত কর্তৃত্ব ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা।