সম্পাদকীয় ২

গল্পবিজ্ঞান

সূচনাটি আগেই হইয়াছিল। প্রধানমন্ত্রী প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার বৈজ্ঞানিক সাফল্যের নিদর্শন হিসাবে গণেশ ও কর্ণের দৃষ্টান্ত দিয়া প্লাস্টিক সার্জারি ও নলজাতক জন্মানোর প্রযুক্তি করায়ত্ত থাকার দাবি জানাইয়াছিলেন। এখন জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনেও একের পর এক ‘গবেষণাপত্র’ পেশ করিয়া ছয়-সাত হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিন্দুদের গ্রহান্তরে মহাকাশযাত্রার রোমহর্ষক ‘প্রমাণ’ও দাখিল করা শুরু হইয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

সূচনাটি আগেই হইয়াছিল। প্রধানমন্ত্রী প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার বৈজ্ঞানিক সাফল্যের নিদর্শন হিসাবে গণেশ ও কর্ণের দৃষ্টান্ত দিয়া প্লাস্টিক সার্জারি ও নলজাতক জন্মানোর প্রযুক্তি করায়ত্ত থাকার দাবি জানাইয়াছিলেন। এখন জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনেও একের পর এক ‘গবেষণাপত্র’ পেশ করিয়া ছয়-সাত হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিন্দুদের গ্রহান্তরে মহাকাশযাত্রার রোমহর্ষক ‘প্রমাণ’ও দাখিল করা শুরু হইয়াছে। তবে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির তাবত্‌ অর্জন খ্রিস্টজন্মেরও অনেক আগে হইতে হিন্দুদের কুক্ষিগত ছিল, এমন দাবি অর্বাচীন নয়। জাতীয়তাবাদকে যখনই হিন্দুত্বের সহিত একাকার করিয়া দেখার চেষ্টা হইয়াছে, তখনই মহাকাব্য-পুরাণের গল্প ও কল্পকথাকে ইতিহাস, তথ্য ও স্পন্দমান বাস্তব রূপে দাবি করিয়া বিশ্বের অপরাপর জাতির তুলনায় আপন শ্রেষ্ঠত্বের অভিজ্ঞান হিসাবে তাহাকে তুলিয়া ধরার চেষ্টা চলিয়াছে। বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা ‘সব ব্যাদে আছে’ মার্কা এই অতীতচারিতার মর্ম বিদ্ধ করিয়াছিলেন। ক্রমে পরাধীন দেশের জাতীয়তাবাদ স্বাধীন দেশের হিন্দুত্বে পরিণত হইলে এই প্রচেষ্টা বাড়িয়াছে। বিশেষত হিন্দুত্ববাদীরা কেন্দ্রীয় শাসনক্ষমতা হাসিল করিলে তাহা মাত্রা ছাড়ায়। পাইথাগোরাসের তত্ত্ব হইতে শুরু করিয়া সবই নাকি হিন্দু বিজ্ঞানের আবিষ্কার, উদার হিন্দুরা স্বেচ্ছায় সব কৃতিত্ব অন্যদের হস্তগত করিতে দিয়াছে!

Advertisement

ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে এই ধরনের কল্পবিজ্ঞানের চর্চা সম্মেলনটিকে উপহাসের বিষয় করিয়া তোলে। বিশ্বের বিজ্ঞানী-মহল ‘মূর্খের পাণ্ডিত্য’ প্রকাশের এমন রাষ্ট্রীয় আয়োজনে চমত্‌কৃত। তবে তাহাতে এই অবিজ্ঞান-সাধকরা দমিবার পাত্র নন। হিন্দু হওয়ার অহঙ্কার বা গর্ব বিশ্বময় ছড়াইয়া দিতে তাঁহারা হয়তো কালক্রমে বিশ্বের সভ্যতা-সংস্কৃতির যাবতীয় অর্জনের উপরেই প্রাচীন ভারতের স্বত্ব দাবি করিয়া বসিবেন। গল্পের গরুকে গাছে তোলার লৌকিক অভ্যাস তাঁহারা অনুশীলন করিতেছেন পুরাণকথাকে ইতিহাসে পরিণত করিয়া। বিবিধ ‘ইতিহাস’বিদ রামায়ণ-মহাভারতের গল্পকে ইতিহাস হিসাবে পঠন-পাঠনে উদ্গ্রীব। যে-প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি চাপা পড়িয়া যাইতেছে, তাহা হইল, হিন্দুদের এত কীর্তি ও অর্জন সত্ত্বেও ভারত আজ এত পশ্চাদ্বর্তী কেন? আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত, সুশ্রুত হইতে কেন গালিলেয়ো-নিউটনে, আধুনিক শল্যচিকিত্‌সায় পৌঁছানো গেল না। কেন বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, এমনকী পরমাণু বোমা থাকা সত্ত্বেও সুলতান মামুদ সতেরো বার ভারত লুণ্ঠন করিতে পারিলেন, কেনই বা ভারতের ‘শেষ হিন্দু সম্রাট’ পৃথ্বীরাজ চহ্বান মহম্মদ ঘোরির অশ্বারোহীদের কাছে পর্যুদস্ত হইলেন?

অতীতকে নিশ্চয় চর্চা করিতে হইবে, তবে তাহা আপন শ্রেষ্ঠত্বের কাল্পনিক ধারণা প্রমাণের পূর্বানুমান হইতে নয়, বরং বর্তমানকে আরও ভাল ভাবে উপলব্ধি করা এবং ভবিষ্যত্‌কে সুষ্ঠু ভাবে নির্মাণের জন্য। সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে যে ধারণাগুলি প্রচার করা হইতেছে, তাহাও বিভ্রান্তিকর। ইহা কেবল অপৌরুষেয় শ্রুতি বা স্মৃতির ভাষা নয়, কালিদাস-শূদ্রক-ভাস-মাঘ-ভর্তৃহরি-বাণভট্টের সাহিত্যের এবং আর্যভট্ট-ব্রহ্মগুপ্ত-সুশ্রুতের ছন্দিত বিজ্ঞানচর্চারও বাহন এই সংস্কৃত। সংস্কৃত শেখা প্রয়োজন ধর্মীয় কারণে নহে, হিন্দুত্বের গৌরববশতও নহে, ভাষা এবং যুক্তিচর্চার স্বার্থেই তাহা আবশ্যক। যুক্তি ছাড়িয়া ভ্রান্ত গৌরবের বশবর্তী হইয়া অতীতের সাধনা করিলে ভবিষ্যত্‌ উজ্জ্বল হয় না, অতীতেরও অমর্যাদা হয়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement