প্রবন্ধ ১

গরিবের জন্য কান্নার রাজনীতি আর নয়

‘দু’টাকা কিলো চাল’-এর ছক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আশা করব, গুজরাত মডেলের প্রবক্তা গরিবদের জন্য ‘বাঁচতে’ গিয়ে হরির লুটের অর্থনীতি অনুসরণ করবেন না। সুগত মারজিত্‌।বিপুল জনাদেশ সমৃদ্ধ নতুন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর সরকার গরিব মানুষদের জন্য বাঁচবে এবং কাজ করবে। কথাটা শুনতে আমরা অভ্যস্ত। আর সেই কারণেই নরেন্দ্র মোদীর মুখে কথাটা শুনে অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে কিছুটা আশঙ্কিত বোধ করছি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৪ ০০:০০
Share:

বিপুল জনাদেশ সমৃদ্ধ নতুন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর সরকার গরিব মানুষদের জন্য বাঁচবে এবং কাজ করবে। কথাটা শুনতে আমরা অভ্যস্ত। আর সেই কারণেই নরেন্দ্র মোদীর মুখে কথাটা শুনে অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে কিছুটা আশঙ্কিত বোধ করছি। এ দেশে সব রাজনৈতিক দলই গরিবদের জন্য অশ্রু মোচনে যারপরনাই পারদর্শী। তার ফলাফল হল পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির মরণফাঁদ, যা দেশের অর্থনীতিকে কখনওই স্বাস্থ্যবান করে তোলে না। নতুন প্রধানমন্ত্রীও সেই ফাঁদে পা দেবেন না তো? মনে করার কারণ আছে যে, নরেন্দ্র মোদী হতদরিদ্র থেকে নিম্নবিত্ত, মধ্য-মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, সবার ভোটেই ক্ষমতায় এসেছেন। আশা করব, গুজরাত মডেলের সফল প্রবক্তা গরিবদের জন্য ‘বাঁচতে’ গিয়ে হরির লুটের অর্থনীতি অনুসরণ করবেন না।

Advertisement

আমরা ভারতকে মাথাপিছু আয় বা দরিদ্রের সংখ্যা বিচারে গরিব দেশ বলতে পারি। কিন্তু তথ্যভিত্তিক গবেষণা এবং অরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করলে বোঝা যায়, এ দেশে দরিদ্রের সংখ্যা কিছুতেই পঁচিশ শতাংশের বেশি হতে পারে না। এই অনুপাত ক্রমশ কমছে, সেটাও স্পষ্ট। এমন একটা বিশাল দেশে দারিদ্রের নির্ভুল হিসেব কষা শক্ত। কিন্তু দারিদ্রের অনেক ধরনের সামাজিক সংকেত আমরা পাই। যেমন, ভারতের বড়, মাঝারি, ছোট শহরে বাড়িতে কাজের লোক, অসুস্থ বৃদ্ধবৃদ্ধাদের জন্য সেবিকা ইত্যাদি পাওয়া আগের চেয়ে অনেক শক্ত। কেন? কারণ, সুখবর, বাড়িতে কাজ করেন যে মানুষজন, তাঁরা আর আগের মতো দরিদ্র নেই। বিভিন্ন গবেষণাপত্রে বার বার এ কথাটা উঠে আসছে যে, গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনা প্রকল্পের ফলে কৃষিক্ষেত্রে মজুরি অনেক বেড়ে গেছে, মজুর পাওয়াও দুষ্কর হয়ে উঠছে। ফলে কৃষকরা, বিশেষত মাঝারি ও ছোট চাষিরা বিপদে পড়ছেন।

গরিব মানুষ বিত্তশালী হচ্ছেন এ অত্যন্ত ভাল কথা, উন্নয়নের সাফল্যের কথা। তাঁরা যত আর্থিক ভাবে বলশালী হবেন, সমাজের পক্ষে ততই মঙ্গল। কিন্তু তার ফলে উত্‌পাদন ব্যয় বাড়বে এবং স্বল্পবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মানুষদের অসুবিধে হবে, যদি না তাঁদের রোজগারও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। তা সর্বক্ষেত্রে হয় না, হচ্ছে না। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে। মূল্যবৃদ্ধি এ ক্ষেত্রে এক বড় সমস্যা। পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির তাড়নায় সরকার পরিকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিনিয়োগে বেশি খরচ করতে পারেন না। গ্রামে হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে কর্মসংস্থান করা হচ্ছে, কিন্তু আমরা জানি এই নীতি দীর্ঘমেয়াদি সুফল দেবে না। বরং সেই খরচের খানিকটা কৃষিতে, সেচে, প্রযুক্তি উন্নয়নে বিনিয়োগ করলে অনেক বেশি মানুষের অনেক দিনের জন্য লাভ হত। ভারতের কৃষি পৃথিবীর মধ্যে উত্‌পাদনশীলতার হিসেবে একেবারে তলার দিকে। কৃষিতে খরচ ঊর্ধ্বমুখী হলে খাদ্যশস্যের জোগান ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সমস্যা আরও বাড়বে।

Advertisement

সরকারি খয়রাতি শেষ পর্যন্ত কাদের হাতে পৌঁছচ্ছে, সেটাও বড় প্রশ্ন। যাঁদের বেঁচে থাকার জন্য বাড়তি অর্থের প্রয়োজন নেই, আমি যদি তাঁদের টাকা দিতে থাকি, তাঁরা টাকাও নেবেন, আমাকে ভোট দেবেন না কারণ তাঁরা দেখবেন, কে তাঁদের ছেলেমেয়েদের উচ্চাশা পূরণ করবে, শিক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করবে, শিল্প গড়ে চাকরির ব্যবস্থা করবে। তাঁরা মোটেও চাইবেন না যে, তাঁদের ছেলেমেয়েরা লোকের বাড়ি কাজ করবে বা শুধু লাঙল ঠেলবে। এই উচ্চাশা বস্তুটি নিঃসন্দেহে এ বারের নির্বাচনের ফলাফল খানিকটা নির্ধারণ করেছে। তা ছাড়া, পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতিতে ১০০ টাকা খরচ করলে অন্তত ৫০ টাকা দলের বা দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনের ভাগে আসে, সেটা আজ সবাই বোঝেন। আর রাজনীতির নেতারা এ ভাবে টাকা উপার্জনের জন্যও অশ্রুসিক্ত চোখে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতিকে বাহবা দিতে থাকেন। একশো দিনের কাজের প্রকল্পকে অন্য ভাবে কৃষিতে বিনিয়োগের কাজে লাগানো দরকার। দয়া করে করদাতাদের টাকা এবং ঘাটতি-নির্ভর সরকারের ঋণের টাকায় দানছত্র করবেন না। অর্থনীতিকে মর্যাদা দিন।

কংগ্রেস ও বামপন্থীদের অর্থনীতির মধ্যে তেমন কোনও ফারাক আমরা দেখি না, সমাজবাদের নামে আর ভেদাভেদকে অবলম্বন করে দুটোই অঢেল পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। এই ধারায় শিক্ষিত অভিজ্ঞ সব ছোট-বড়-উঁচু-নিচু রাজনৈতিক নেতার এটাই স্ট্র্যাটেজি: পাইয়ে দিয়ে ভোটব্যাংককে সংগঠিত করো। আবার, পাইয়ে দেওয়া মানে শুধু যে ভর্তুকি দেওয়া, তা-ও নয়। সংরক্ষণের ব্যবস্থা করো। সর্বোপরি এমন ভাবে তোষণ করো, যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঁধ ভেঙে যায়। ভোট হলেই হল, কুছ পরোয়া নেই।

জাতীয় নির্বাচন থেকে যতটুকু শিক্ষা পাচ্ছি, তাতে মনে হয়, মানুষ খানিকটা জাতপাত ভুলে ধর্মপরিচয় ভুলে ভোট দিয়েছেন, আর্থিক উন্নয়নের প্রত্যাশা করে। মানুষ কাজ করে রোজগার করতে চায়। তাই সম্মানের সঙ্গে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে, এটাই মূল চাহিদা। তার জন্য কল্পনা আর বাস্তব মিলিয়ে যে গুজরাত মডেল, তাকে বিশ্বাস করে মানুষ ভোট দিয়েছে। তাই, পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি নিয়ে নেতাদের এখন নতুন করে ভাবতে হবে। শুধু ভর্তুকির জন্য আর হয়তো মানুষ ভোট দেবে না। দু’বেলা খেতে পান না যে মানুষ, তাঁকে দু’বেলা খেতে দিলে ধন্যি ধন্যি করবেন নিশ্চয়ই, কিন্তু খেতে পাওয়ার পর আর এক থালা ভাতের বদলে তিনি অন্য কিছু চাইবেন। ফলে সত্যিকারের উন্নয়ন আনতে না পারলে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ অসম্ভব। উন্নয়ন বলতে রাস্তায় একগাদা হকার এবং উঁচুতলার বাড়িতে রক্ষীর চাকরি, কৃষিতে উন্নতি নেই অথচ কোটি কোটি টাকার দানযজ্ঞ এমন ভাবনা ক্রমশ অচল হয়ে পড়ছে।

এ বার আসি পশ্চিমবঙ্গে। নির্বাচনে রাজ্যের শাসক দল খুবই ভাল ফল করেছে। অনেকের মতে, সংখ্যালঘু ভোটেই তাঁদের এই সাফল্য। কিন্তু সেটা খুবই একপেশে ব্যাখ্যা। ঘটনা হল, মানুষ সরকারের কাজকর্ম দেখছেন সংবাদমাধ্যম যা-ই প্রচার করুক না কেন। বর্তমান শাসকদল কাজ করছে না বা কাজ করার চেষ্টা করছে না, সে কথা কেউ বলতে পারবেন না। প্রকৃত সাফল্যের পরিমাণ এ দিক ও দিক হতে পারে, কিন্তু মানুষ এখনও মনে করেন, শাসক দলই এখনও এ রাজ্যের কাণ্ডারি।

কিন্তু তরুণ প্রজন্মের, অপেক্ষাকৃত উচ্চশিক্ষিতদের কাছে তাঁরা কতটা জনপ্রিয়, সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। শহুরে মধ্যবিত্তের আশাভরসা আর জঙ্গলমহলের আশা-ভরসা এক রকম নয়। উচ্চশিক্ষা, শিল্প, উচ্চ মানের কাজ, এ সবই আজ এক বিশাল তরুণ জনগো

কলকাতায় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতিবিদ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement