সত্যকারের শিল্পী-ভাবুক-চিন্তাবিদদের মধ্যে এক অদম্য স্বাধীনতা আর ন্যায়ের তৃষ্ণা থাকে, যাহাকে কিছুতেই মিটানো যায় না: এমন কথা এক কালে শোনা যাইত। মার্কিন কবি-সংগীতকার বব ডিলানের গানেও শোনা গিয়াছিল, তাঁহারা দেওয়াল সমানেই ভাঙিয়া যাইবেন, দরজায় সমানেই ধাক্কা দিতে থাকিবেন— সময় পাল্টাইবার আশায়। সে সব অন্য জগতের কথা। পশ্চিমবঙ্গের জগৎটি ভিন্ন। এখানে শিল্পী বা চিন্তাবিদদের সাধারণ ধরনটি সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁহারা অতি স্পষ্টত ক্ষমতার প্রিয়পাত্র হইতে ভালবাসেন, স্বাধীনতা, ন্যায়, মুক্তি ইত্যাকার বিমূর্ততায় তাঁহাদের বিশেষ আগ্রহ নাই। কিছু হাতে-গোনা ব্যতিক্রম বাদ দিলে চিরকালই বাঙালি শিল্পীসমাজ প্রতিবাদের অপেক্ষা সমর্থনের সংস্কৃতিতে মনপ্রাণ ঢালিতে অভ্যস্ত। নিবেদন আসিয়া তাঁহাদের যাহা কিছু দ্রোহভাব ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছে। তাই সুবোধ সরকার, অভিরূপ সরকার বা অরিন্দম শীলরা যখন স্পষ্ট কথায় বলেন যে তাঁহারা পক্ষপাতদুষ্ট, ‘দিদি’র প্রতি তাঁহাদের আজানু সমর্থন কোনও সারদা-নারদাতেই টলিবার নহে, ইহাকে কিছু ব্যতিক্রম বলিয়া ধরা যায় না। ইহাই বাঙালির সংস্কৃতি। যখন যিনি ক্ষমতায়, তাঁহার প্রতিই নিবেদন অতলান্ত। বুদ্ধ-জীবী হইতে দিদি-জীবী, কিছুতেই অনাগ্রহ নাই। বাম দক্ষিণ মধ্য কোনও আদর্শেই অনাসক্তি নাই, কেননা তাঁহারা আদর্শের ধার ধারেন না। বরং কোনও প্রকার সংঘর্ষ, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, আত্মখণ্ডন ছাড়াই এমন মোলায়েম তাঁহাদের ‘পরিবর্তন’ যে তাহাকে পরিবর্তন বলাই অসম্ভব। বলিতে হয়, স্বভাবজ আবর্তন।
তবু সে দিন প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে মমতা-পন্থী বিশিষ্ট জনের মঞ্চটি কিছু কারণে বিশেষ উল্লেখ দাবি করে। শিক্ষা-শিল্প-সংগীত-সাহিত্য-চলচ্চিত্রে মোটের উপর কৃতী হওয়া সত্ত্বেও কী সাবলীল ভাবে তাঁহারা একসূত্রে গাঁথা হইয়া ‘আমরা-ওরা’র দ্বিভাজিকাটি বজায় রাখিতে পারেন, তাহা বর্তমান বাঙালি মননশীলতা বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত দেয় বইকী। ‘ওঁরা’ নির্বাচন কমিশনের কাছে বর্তমান প্রশাসন বিষয়ে অসন্তোষ জানাইয়াছেন, তাই ‘আমরা’ বর্তমান প্রশাসনের চড়াম চড়াম ঢাক বাজাইব, এই আদ্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতাই দেখাইয়া দেয়, বাঙালি মননের উৎকর্ষের প্রশ্নাতীত রেখবিন্দু। অর্থনীতি বা সমাজনীতি গুলিয়া খাইবার পরও সন্ত্রাস বা দুর্নীতির অমায়িক সাফাই-এর ভঙ্গিটি বলিয়া দেয়, বাঙালি নিবেদনের অসামান্য দক্ষতা। অবশ্য ভঙ্গিতে দক্ষতা থাকিলেও সংগঠনে নাই। নিজেদের মধ্যে এত কম হোমওয়ার্ক করিয়া আসিয়া পদে পদে প্রশ্নকর্তাদের সামনে বিভ্রান্ত হওয়া উত্তম চাটুকারিতার প্রমাণ নহে। যে রাজনৈতিক দলের সপক্ষেই হউক, পরের বার তাঁহাদের চাটুকারগিরির অভ্যন্তরীণ বোঝাপড়া আর একটু ভাল হইবে, আশা থাকিল।
আশা থাকিল, একটু সূক্ষ্মতাও ইঁহারা ক্রমে শিখিতে পারিবেন। যে কোনও সরকারি দলের হইয়া ভোট ভিক্ষা করার মধ্যেই নির্লজ্জতা উজ্জ্বল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার আমাদের ‘সম্মান’ অর্থাৎ টাকাপয়সা ও পদ দিয়াছে, রাজ্যের অনেক দেনা কিন্তু তাহার মধ্যেও লক্ষ কোটি টাকা খরচ করিয়া আমাদের পুরস্কৃত করিয়াছে, তাই তাঁহার কোনও সমালোচনাই আমরা করিব না: এই উচ্চারণের মধ্যে অতি ন্যক্কারজনক তাঁবেদারি রহিয়াছে। বাংলা-সিরিয়াল-পুষ্ট সমাজের চোখেও ইহা মহা বাড়াবাড়ি। বিচারশাস্ত্রমতে অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁহারা শাস্তিযোগ্য হন না। কিন্তু অপরাধী যে সমর্থনযোগ্য থাকেন, এমন কথা কোনও শাস্ত্র বলে না। ‘ওরা’ চুরি করিলে আমরা আক্রান্ত, ‘আমরা’ চুরি করিলে তাহা চক্রান্ত, এই সমীকরণের হাস্যকর সরলতা কি ইঁহারা দেখিতে পান না? না কি, দিদি-জীবী হইলে বুদ্ধি সত্যই বিসর্জিত হয়?