প্রধানমন্ত্রী অশ্রু সংবরণ করিয়া আরও পঞ্চাশটি দিন সময় চাহিয়া লইয়াছেন। অনুমান করা চলে, নগদ টাকার সংকট খুব সহজে মিটিতেছে না। রাতারাতি ৮৫ শতাংশ নোট অচল করিয়াও জনজীবনে তাহার আঁচ লাগিতে না দিতে হইলে যে প্রস্তুতি প্রয়োজন ছিল, দৃশ্যতই ভারতে তাহা ছিল না। সিদ্ধান্তটির ঘোষিত উদ্দেশ্য পূরণ করিতে আকস্মিকতা আবশ্যক ছিল বটে, কিন্তু প্রস্তুতির এই অভাবও একই রকম অপরিহার্য ছিল না। ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট উবিয়া গেলে ১০০ টাকার নোটের চাহিদা যে বাড়িবে, তাহা আঁচ করিতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নাই। নূতন ৫০০ টাকার নোটও যাহাতে দ্রুত বাজারে পৌঁছাইতে পারে, তাহার ব্যবস্থা করাও বিধেয় ছিল। পর্বান্তরের এই প্রক্রিয়াটিকে মসৃণ করিবার জন্য কী কী ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, কালো টাকার বিরুদ্ধে জেহাদের উত্তেজনায় প্রধানমন্ত্রী হয়তো তাহা ভাবিয়া দেখিবার অবকাশ পান নাই। তাঁহার সরকার যেহেতু প্রকৃত প্রস্তাবে উত্তমপুরুষ একবচন, অতএব অন্যরাও ভাবিবার সুযোগ পান নাই। এত বড় একটি পরিবর্তন আরও খানিক বিবেচনা দাবি করে।
ব্যাঙ্ক, এটিএম-এর সম্মুখে দীর্ঘ লাইন এবং বাজারে ততোধিক নির্জনতা দেখিয়া বোঝা যায়, প্রভাব বেশ জোরদারই পড়িয়াছে। কিন্তু, অসন্তোষের পরিমাণ সেই অনুপাতে নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। শহর হউক বা গ্রাম, সাধারণ মানুষ বিরক্ত বটে, কিন্তু বেশির ভাগই ক্ষুব্ধ নহেন। তাঁহারা ‘দেশের স্বার্থে’ এই কষ্টটুকু স্বীকার করিতে সম্মত— প্রধানমন্ত্রী যেমনটি বলিয়াছেন। টাকার জোগান অব্যাহত রাখিতে যে ‘ম্যানেজমেন্ট’ প্রয়োজন ছিল, নরেন্দ্র মোদী তাহাতে ডাহা ফেল করিলেও সিদ্ধান্তটিকে সাধারণের নিকট গ্রহণযোগ্য করিয়া তুলিবার ম্যানেজমেন্টে দারুণ সফল। কত ভাগ দেশপ্রেমের সহিত কত ভাগ বড়লোকের বিরুদ্ধে রাগ মিশাইলে এই দুরূহ কাজটি সম্ভব, প্রধানমন্ত্রী তাহা দিব্য বুঝিয়াছেন। বিপণনে তাঁহার পারদর্শিতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু, নিজের ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতির বিপণন এক কথা, আর যাঁহারা নগদ টাকার অভাবে হন্যে হইতেছেন, তাঁহাদের সেই অসুবিধাটিকেও দেশেপ্রেমের পাঁচন বলিয়া গিলাইয়া দেওয়া আর এক। দ্বিতীয় কাজটি নিঃসন্দেহে কঠিনতর। কেহ বলিতে পারেন, ধনীরা ‘প্লাস্টিক মানি’-র সৌজন্যে তেমন ঝামেলায় পড়েন নাই, আর দরিদ্রদের নানাবিধ অসুবিধা সহিয়া লইবার অভ্যাস আছে। ফলে, কোনও পক্ষই ক্ষোভে ফাটিয়া পড়িবার মতো অবস্থায় এখনও পৌঁছায় নাই। যুক্তিটি উড়াইয়া দেওয়ার নহে। তবুও, একটি অপ্রিয় পরিস্থিতিকেও গ্রহণযোগ্য করিয়া তুলিতে যে দক্ষতার প্রয়োজন হয়, প্রধানমন্ত্রীর তাহা বিলক্ষণ আছে— এই কথাটি স্বীকার করা ভাল।
পরিকল্পনার অভাবকে বিপণনের মাহাত্ম্যে উতরাইয়া দেওয়া যাইবে কি না, প্রধানমন্ত্রীও সম্ভবত সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজিতেছেন। উত্তর সময় দিবে। মহাকাল নহে, কয়েক দিনের সময়। সরকার ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কত দ্রুত টাকার জোগানকে স্বাভাবিক করিতে পারে, সেই সময়। যদি টাকার জোগান দ্রুত স্বাভাবিক হয়, বাজারে নগদ টাকা কাজ চালাইবার উপযোগী পরিমাণে ঘুরিতে আরম্ভ করে, তবে অল্প কয়েক দিনের সমস্যার কথা মানুষ সম্ভবত মনে রাখিবেন না। বরং এই কয়েক দিনের দুর্দশাকে মহৎ লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় মহত্তর আত্মত্যাগ মনে করিবেন। কিন্তু, টাকার জোগান স্বাভাবিক হইতে যদি সময় লাগে, বাজারে চাহিদার অভাবে কেনাবেচা বন্ধ হইবার উপক্রম হয়, অর্থাৎ যদি পেটে টান পড়ে, দেশপ্রেমের সুবাস ক্ষণস্থায়ী হইবে বলিয়াই অনুমান। খেলা স্লগ ওভারে পৌঁছাইয়াছে। নরেন্দ্র মোদী কতখানি ব্যাট চালাইতে পারিবেন?