যুক্তিবাদের দায়ে। গোবিন্দ পানসারে (বাঁ দিকে) এবং ডা. নরেন্দ্র দাভলকর।
ছোটবেলায় ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’ রচনায় পাতা ভরে লিখতাম বিজ্ঞান আমাদের কী কী দিয়েছে— সকালে ঘুম ভাঙা থেকে রাত্তিরে শুতে যাওয়া পর্যন্ত জীবনযাত্রার নানা উপকরণে বিজ্ঞানের প্রায়োগিক দিকগুলোকে কী ভাবে ব্যবহার করি। তখন বুঝিনি, বিজ্ঞান বলতে আমরা যা বোঝাচ্ছি, তা আসলে প্রযুক্তি। শুনলাম, এই বছরও মাধ্যমিক পরীক্ষায় এই রচনাই লিখতে বলা হয়েছে। সেই ট্র্যাডিশন।
২৮ ফেব্রুয়ারি ছিল জাতীয় বিজ্ঞান দিবস। পদার্থবিজ্ঞানী সি ভি রমন এই দিনেই ‘রমন এফেক্ট’ আবিষ্কার করেন, যার জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৮৬ থেকে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সঞ্চার নিগম (এনসিএসটিসি) দিনটাকে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস বলে ঘোষণা করেছে। গত বছর বিজ্ঞান দিবস উদযাপনের ‘থিম’ ছিল ‘বিজ্ঞানচেতনার উন্নয়ন’। এ বছর: ‘জাতিগঠনে বিজ্ঞান’। কিন্তু বিজ্ঞান কী, সেটাই যদি পরিষ্কার না থাকে, আর বিজ্ঞান যে অভিশাপ নয়, আজও যদি তার প্রমাণ দিতে হয়, তবে বিজ্ঞানচেতনার উন্নয়নই বা হবে কী করে, তাকে জাতীয় গঠনকার্যে ব্যবহার করাই বা যাবে কী ভাবে?
ছোটবেলার সেই রচনায় লিখতাম, যাবতীয় ঘটনাবলির অন্তর্নিহিত যে নিয়ম, কার্যকারণ সম্পর্কে যে বিশেষ জ্ঞান, তা-ই হল বিজ্ঞান। বিজ্ঞানচেতনার গোড়ার কথাই হল বুঝতে শেখা, প্রশ্ন করতে শেখা আর যে-কোনও অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতন হওয়া। কিন্তু এ কথাটা শুধু রচনায় নয়, আমাদের জীবনেও ক্রমশ এমন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে যে সারা জীবন বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেও আমরা ঠিক ভাবে যুক্তিবাদী বা বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠতে পারি না।
কিন্তু যাঁরা বিজ্ঞানমনস্কতার মানে বোঝেন, যাঁরা সত্যিই লোককে যুক্তিবাদী হয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারেন, আমাদের দেশে তাঁদের ভবিষ্যত্ খুব ভাল নয়। এমন এক জন যুক্তিবাদী প্রবীণ গোবিন্দ পানসারে গত ২০ ফেব্রুয়ারি খুন হয়ে গেলেন আততায়ীর গুলিতে। বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী মানুষটি সারা জীবনে মার্ক্সবাদ ছাড়াও বিশ্বায়ন, সংরক্ষণ, কৃষি ইত্যাদি বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে কলম ধরেছেন। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ ছত্রপতি শিবাজির নতুন মূল্যায়ন। শিবাজিকে শুধু হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে না দেখে তিনি তাঁকে এক প্রজাদরদি ও ধর্মনিরপেক্ষ সুশাসক রূপে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এতে শিবাজির গরিমা বেড়েছে, কিন্তু হিন্দু ধর্মোন্মাদদের স্বার্থের পক্ষে সেটা ভাল হয়নি।
এই মৃত্যু দেড় বছর আগের আর একটি মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দিল। ২০১৩’র ২০ অগস্ট, সকাল ৭টা ২০ নাগাদ প্রাতর্ভ্রমণ সেরে ফেরার পথে আততায়ীর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান প্রবীণ মরাঠি চিকিত্সক নরেন্দ্র দাভলকর। আরও এক বার প্রমাণিত হয়, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে আজও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলার মূল্য দিতে হয় জীবন দিয়ে। আদ্যন্ত বিজ্ঞানসচেতন মানুষটির সারা জীবন মানবিকতা ও যুক্তিবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে গেছেন। জাতপাতের অনুশাসন, ধর্মীয় কারণে পশুবলি, নানা ধরনের তন্ত্রমন্ত্র, ঝাড়ফুঁক ও ভেলকির (ব্ল্যাক ম্যাজিক) সাহায্যে রোগ সারাবার চেষ্টা— এই রকম আরও যে-সব বিশ্বাস ও সামাজিক নির্মাণ মানুষের ও পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর, ডাক্তার হিসেবে তার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলাটা উনি কাজেরই একটা অংশ মনে করতেন। তাই ডাক্তারির পাশাপাশি অজস্র বই লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, নিজের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে গড়ে তুলেছেন ‘মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি’। জন্মগত ভাবে হিন্দু মরাঠি ব্রাহ্মণ দাভলকর নিজের একমাত্র ছেলের নাম রেখেছিলেন হামিদ, যিনি এখন ডাক্তার।
তেরো বছর ধরে ডা. দাভলকর মহারাষ্ট্র সরকারকে কুসংস্কার-বিরোধী যে-বিলটা পাশ করবার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন, তাতে বিভিন্ন প্রকারের ভাঁওতাবাজির সাহায্যে মানুষকে ঠকানোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি ছিল। ডাকিনীবিদ্যার চর্চা, কাউকে ডাইনি সাব্যস্ত করা, অঘোরীবিদ্যা, ওঝাতন্ত্র অর্থাত্ মন্ত্র পড়ে কুকুর বা সাপে কাটা রোগীর চিকিত্সা করা, ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করার দাবি— এই রকম মোট বারোটা বিষয়ের কথা এই বিলে উল্লেখ করা ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই দাভলকর প্রচুর শত্রু বাড়িয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু বিলটা পাশ করতে পারেননি। বিধানসভায় তিন বার বিলটার প্রস্তাবনা আর ঊনত্রিশ বার সংশোধন সত্ত্বেও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্থার বিরোধিতায় শেষ পর্যন্ত বিলটা পাশ হয়নি। ওঁর মৃত্যুর দু’দিন পর প্রবল জনরোষকে সামলাতে মহারাষ্ট্র সরকার কুসংস্কার-বিরোধী একটা আইন জারি করেন।
দাভলকরের আনা যে বিলটাকে ‘হিন্দু বিরোধী’ ভেবে ধর্মোন্মাদরা ভয় পেয়েছিল, তারা জানতই না যে, ওই বিলটায় ঈশ্বর বা ধর্ম বিষয়ে একটি কথাও ছিল না। ওরা ভেবেছিল, এই বিল পাশ হলে ‘হিন্দু-বিশ্বাস ও ধর্মাচরণের স্বাধীনতা’ খর্ব হবে। কিন্তু মানুষের যে বিশ্বাস অন্য কারুর কোনওরকম ক্ষতি করে না, সেই বিশ্বাস ও আচরণ নিয়ে এই বিলে কিচ্ছু ছিল না। নিজে ধর্মবিশ্বাসী না হয়েও উনি গণেশপুজো বন্ধ করার কথা বলেননি। কিন্তু এই নির্দেশটা আদায় করেছিলেন যে, সমস্ত গণেশমূর্তি হতে হবে মাটির তৈরি আর প্রাকৃতিক রঙে রাঙানো, যাতে সেগুলো বিসর্জনের পর পরিবেশের ক্ষতি করতে না পারে। নিজের কর্মপদ্ধতির মধ্যে ডা. দাভলকর ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণের ক্ষতিকর দিকগুলোকে আলাদা করতে পেরেছিলেন। অর্থাত্, ওঁর লড়াইটা ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের নয়, জ্ঞান ও বুদ্ধির সঙ্গে অজ্ঞতার। ওঁর আনা বিলে যে বিষয়গুলোর কথা ছিল, সেগুলো সকলের পক্ষেই ক্ষতিকর। কিন্তু কুসংস্কার ব্যাপারটাই তো এই রকম, নিজের ভালমন্দ বোঝার ক্ষমতাই নষ্ট করে দেয়। কিন্তু বিজ্ঞানচেতনার গোড়ার কথাই যে যুক্তিনিষ্ঠ হওয়া, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতন হওয়া। তার অর্থ যদি গুলি খেয়ে পড়ে থাকা হয়, তবে দেশে বিজ্ঞানচেতনা গড়ে উঠবে কী করে?
দেশের এই বিপরীত প্রান্তে বসে আমরা অণ্ণা হজারে বা অরবিন্দ কেজরীবালের দুর্নীতিবিরোধী প্রকল্পে দারুণ উত্সাহিত হয়েছি, কিন্তু ডা. দাভলকরের কুসংস্কার-বিরোধী কাজের ঢেউ আমাদের কাছে পৌঁছয়নি। অথচ আমাদের সংবিধান অনুসারে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নিজের বিশ্বাস ও ধর্মাচরণের স্বাধীনতা যেমন আমাদের মৌলিক অধিকার, তেমনই বিজ্ঞানচেতনা গড়ে তোলা, মানবিকতা ও জ্ঞানের চর্চাকে উত্সাহিত করা আর হিংসাকে প্রতিরোধ করাও প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমরা কিন্তু কুসংস্কার বিরোধিতাকে আমাদের সংস্কৃতি করে তুলতে পারিনি। জ্যোতিষী-ফকির-সাধুসন্তের পাল্লায় পড়ে মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে, খুনও হয়ে যাচ্ছে। সেই সব দেখেশুনেও আমরা সচেতন হইনি।
ভারতরত্ন বিজ্ঞানী সি এন আর রাও বলেছেন, উপগ্রহ ক্ষেপণের আগে পাঁজিতে শুভক্ষণ বিচার করা বা ভগবানের আশীর্বাদ চাওয়া স্রেফ কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। এই কথাটা স্পষ্ট ভাবে বলার জন্য ওঁকে ধন্যবাদ। কিন্তু এই উদাহরণটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে, আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানচেতনাও শুধু পড়াশোনা বা কাজকর্মেই সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞানচেতনা যে শুধু কিছু তত্ত্ব, ছবি আর চিহ্নমাত্র নয়, আসলে একটা সংস্কৃতি— যা জীবনের সর্বত্রই বজায় রেখে চলতে হয়, যা কোনও অযৌক্তিক ধারণাকেই প্রশ্রয় দেওয়ার বিরোধী। সেটা আমাদের জীবনে সত্যি হয়ে ওঠেনি সে ভাবে। তেমনই বিজ্ঞান দিবস মানেও যে একদিন সচেতন হয়ে উঠে বাকি দিনগুলোতে চোখ বুজে থাকা নয়, বরং এই কাজটাকেও জীবনে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা, সেটা বুঝতে আরও কতগুলো নরেন্দ্র দাভলকরকে লাগবে, কে জানে!
পুনশ্চ: আর এক জন যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ অভিজিত্ রায় খুন হয়ে গেলেন বাংলাদেশে, মুসলমান মৌলবাদীদের হাতে। আমেরিকাপ্রবাসী এই তরুণ ইঞ্জিনিয়ার মুক্তমনা নামে একটি ‘ব্লগ’ চালু করেছিলেন, যেখানে যাবতীয় কুসংস্কার ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখি চলত। আর এক বার প্রমাণিত হল, ধর্ম-উদাসীন যুক্তিবাদী মানুষরা পৃথিবীর কোথাও ভাল নেই।
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এর গবেষক