পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ এখন। অসুখের নাম ম্যাকবেথ। চারশো বছর আগে লেখা শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডির নায়ককে এ ভাবেই দেখতে চান মণিপুরের নাট্যকার ও পরিচালক রতন থিয়াম। এ শহরে স্বরসঙ্গমের আয়োজনে তাঁর নির্দেশনায় কোরাস রেপার্টরি থিয়েটার-এর ম্যাকবেথ নাটকের প্রথম অভিনয় আজ। (ছবিতে নাটকের একটি দৃশ্য)
ম্যাকবেথ এ শহরে নতুন নয়। ইংরেজি তো বটেই, বাংলাতেও বহু বার এ নাটক অভিনীত হয়েছে শহরের মঞ্চে। ১৭৯৬-এ ক্যালকাটা থিয়েটারে ডেভিড গ্যারিক-এর উপদেশনায় ইংরেজিতে ম্যাকবেথ মঞ্চস্থ হয়েছে। ঠিক দুশো বছর আগে অভিনীত হয়েছে চৌরঙ্গী থিয়েটারে। পরে গিরিশচন্দ্র ঘোষ, শিশিরকুমার ভাদুড়ীর নাম জড়িয়েছে এ নাটকের প্রযোজনায়।
কিন্তু সে সব নেহাতই মঞ্চে শেক্সপিয়র প্রযোজনা, তার বেশি কিছু নয়। এ দেশের বর্তমান কী করে বহু দূর অতীতের এই নাটককে নতুন করে পড়েছে সমসময়ের মঞ্চে, সেই ইতিহাসের শুরু বোধহয় উত্পল দত্তের ম্যাকবেথ থেকে। জরুরি অবস্থার সময়ে উত্পল দত্তের নির্দেশনায় পিপল্স লিটল থিয়েটার যে ম্যাকবেথ অভিনয় করেছিল রবীন্দ্রসদনে, সমসাময়িক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভাষ্য ছিল তার মধ্যে। সে কথা স্পষ্ট বলেওছিলেন উত্পল। ২৬ জুন ১৯৭৫ ভারতে জরুরি অবস্থা জারি হয়। তার ঠিক তিন মাস পরে, ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ ওই ম্যাকবেথ-এর প্রথম অভিনয়। দু’বছর পর এক সাক্ষাত্কারে উত্পল দত্ত শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ যখন আমরা করলাম, আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ-এর চেয়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বেটার প্লে হতে পারে না। ইমার্জেন্সির বিরুদ্ধে এত ভাল নাটক আর নেই। এখনও পর্যন্ত লেখা হয়নি। কিন্তু আমরা জানতাম, এটা যে শ্রীমতী ইন্দিরা গাঁধীর ইমার্জেন্সির বিরুদ্ধে নাটক, সেটা ধরার বুদ্ধি কংগ্রেসিদের নেই। ম্যাকবেথ করলে ওরা বলবে যে দল শেক্সপিয়র সাধনায় মগ্ন আছে, এদেরকে কিছু বোলো না। তাই হল। ম্যাকবেথকে ওরা কোনো বাধা-টাধা দেয়নি।’
উত্পল দত্তের এই স্ট্র্যাটেজি (এই শব্দটাই উনি ব্যবহার করেছিলেন সাক্ষাত্কারে) দর্শকের মনে কতটা কার্যকর হয়েছিল সেটা অন্য প্রশ্ন। কিন্তু ম্যাকবেথ’কে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পড়ার এই ধরনটা আর একটু বড় জায়গা নিয়ে এসেছে কৌশিক সেনের নির্দেশনায় স্বপ্নসন্ধানী-র সাম্প্রতিক ম্যাকবেথ-এ। বছর দুয়েক আগে, এ রাজ্যে পালাবদলের ঠিক পরে নাটকটি প্রথম বার অভিনীত হয়। সমসময়ের পালাবদল আর বদলহীনতার যন্ত্রণাকে সরাসরি নাটকে মিলিয়ে দেন কৌশিক। তা নিয়ে বিতর্কও হয়। নির্দেশকের কথা-য় কৌশিক লেখেন, একটা পাওয়ারফুল লোক, সে পাওয়ারে গিয়ে সেটা হ্যান্ডেল করতে পারল না। নিজের, সমাজের, সময়ের একটা বিপুল ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করল। এই ট্র্যাজেডিটা মারাত্মক।... আর ম্যাকবেথ পড়ার সময় আমি পৃথিবীর কমিউনিস্ট শাসনের একটা মিল পাচ্ছিলাম। একটা সাংঘাতিক নিষ্ঠুরতা। তার পর একটা চরম পরিণতি। শেষে আমি একটু ডিভিয়েট করেছি সচেতনে। সময়ের স্বার্থে। বিতর্ক হয়েছে।... আমি কখনও চাইনি এটা শুধু ম্যাকবেথ বা লেডি ম্যাকবেথের ট্র্যাজেডি হোক। ফোকাসটা ছিল এই থিয়েটারটা যেন গোটা একটা সিস্টেমের ট্র্যাজেডির কথা বলে।
সিস্টেমের সেই ট্র্যাজেডির নায়ক তো শুধু রাজতন্ত্র কিংবা রাষ্ট্র নয়, ব্যক্তিমানুষও। ম্যাকবেথকে একটি অসুখের রূপে দেখেছেন রতন থিয়াম, যার উপসর্গ, তাঁর মতে, অসম্ভব উচ্চাশা, ক্ষমতার লোভ, হিংসা। অস্থির এই সময়ে সেই অসুখ ছড়িয়েছে মহামারির মতো। জরুরি অবস্থা, সত্তরের দশক, নকশাল আন্দোলন পুরো পরিপ্রেক্ষিতটাকে মাথায় রেখে ডানকান-হত্যার দৃশ্যে ম্যকবেথের কথাকে এই ভাবে বঙ্গানুবাদ করেছিলেন উত্পল দত্ত, ‘এ কার হাত?... সপ্তসিন্ধুবারি কি পারবে হাত থেকে এ রক্তচিহ্ন মুছে ফেলতে? না! এই হাতই ঊর্মিমুখর সবুজ সমুদ্রকে করে দেবে লালে লাল।’ বহু পরে, নন্দীগ্রাম পর্বে রূপকার্থে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে রক্তের দাগ নিয়ে প্রায় এই ভাষাই উঠে এসেছিল বিদ্বজ্জনেদের আলোচনায়। মাত্রা যতই লঘু হোক, ম্যাকবেথ এ ভাবেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ থেকে পরিণত হয়েছে এক অসুস্থতায়, মিশে গিয়েছে এ দেশের এই অসময়ের সঙ্গে।
মুম্বইয়ের অপরাধ জগত্ নিয়ে বিশাল ভরদ্বাজ যখন বছর দশেক আগে ‘মকবুল’ ছবি তৈরি করলেন, তখন তারও শিথিল অবলম্বন ছিল শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ। এখন, পশ্চিমবঙ্গের সিন্ডিকেট-সংঘর্ষেও সেই রক্তাক্ত রাজকীয় সময়ের ছায়া দেখতে পাবেন হয়তো কেউ কেউ। পাড়ার ছেনো গুন্ডার সঙ্গে ম্যাকবেথের তফাত মনে রাখলেও ক্ষমতার লড়াই আর রক্তের চরিত্রটা তো একই।
কিন্তু কেবল সেই ছায়ার সন্ধানটাই বড় কথা নয়। সমসময়ের কোনও এক রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে ম্যাকবেথ-এর তুলনাটাও নয়। সে তুলনায় আলোচনা জমে উঠতে পারে, রাজনীতিবিদ্যার নতুন গবেষণাপত্র লেখা হতে পারে, কিন্তু মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়াতে থাকা ওই ম্যাকবেথ-অসুখটার মূলে যাওয়া যায় না। নির্দেশকের কথায় রতন থিয়াম সেটাই বলছেন, ‘লক্ষ লক্ষ বই, চারুশিল্প, নাটক, সিনেমা কিংবা প্রযুক্তিবিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি পৃথিবীর সেই গভীর ক্ষতে বাইরে থেকে প্রলেপ হয়তো দিয়েছে, কিন্তু অসুখের সেই বীজটায় পৌঁছতে পারেনি।’
জরুরি অবস্থাটা তাই কেবল কোনও রাষ্ট্রের ঘোষণা নয়, রক্তাক্ত সময়টা মানুষের মনেই। ক্ষমতার ছোট ছোট বৃত্তে ছোট ছোট ম্যাকবেথ কিংবা ব্যাংকোকে দেখা যায় চারপাশের সময়েই। লেনক্সরাও আছেন, ‘অন্য ভাষায় ভিন্ন প্রেক্ষিতে বলে উঠছেন, বেশি রাত করে বেড়াতে যাওয়া কারুর পক্ষেই ঠিক নয়। এ দিকে এ কথা কে না জানে যে, ম্যালকম ও ডোনালবেন পশুর মতন হিংস্রতায় নিজেদের দয়ালু পিতাকে হত্যা করেছে? কাণ্ড দেখে ম্যাকবেথের কত দুঃখ হল বলুন তো! মহত্ ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে তিনি তক্ষুনি মদমত্ত নিদ্রাচ্ছন্ন দুই অপরাধীকে খণ্ড খণ্ড করে ফেললেন। কী উচ্চ ভাব বলুন তো!’ ম্যাকবেথ বলেছিল, ক্ষমতা নয়, চাই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। দল বা ব্যক্তি, যে কোনও বৃত্তেই ভাষাটা বদলালেও চরিত্রটা একই আছে।
এ শহরে এই নতুন ম্যাকবেথ-এর প্রথম অভিনয়ের তারিখটাও হয়তো তাই নিছক সমাপতন নয়, ২৬ জুন। ১৯৭৫-এর ঠিক যে দিনটায় এ দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল!
বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার, প্রোডাকশন