সম্পাদকীয় ২

কৃষ্টি

কার্যত সমগ্র ২০১৪ সাল জুড়িয়াই রাজ্যে একটি বস্তুর উচ্চফলনশীল কৃষ্টি দেখা গেল। তাহার নাম কুকথা। নানা জনের কণ্ঠে নানা বাণী। বাবু বঙ্কিমচন্দ্র থাকিলে অবশ্য লিখিতেন: আহা কী শুনিলাম, বর্ষবর্ষান্তরেও ভুলিব না! নানা ভাষা, নানা মত, নানা অভিধান, কিন্তু অন্তরে অন্দরে সকলের এক রা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share:

কার্যত সমগ্র ২০১৪ সাল জুড়িয়াই রাজ্যে একটি বস্তুর উচ্চফলনশীল কৃষ্টি দেখা গেল। তাহার নাম কুকথা। নানা জনের কণ্ঠে নানা বাণী। বাবু বঙ্কিমচন্দ্র থাকিলে অবশ্য লিখিতেন: আহা কী শুনিলাম, বর্ষবর্ষান্তরেও ভুলিব না! নানা ভাষা, নানা মত, নানা অভিধান, কিন্তু অন্তরে অন্দরে সকলের এক রা। দল ও রাজনীতি নির্বিশেষে সকলে দুর্বাক্যে পারঙ্গম। মুখ খুলিলেই তাহা নির্গত হইতেছে। স্বাদে-গন্ধে অপূর্ব! রাজনীতিবিদদের ভাষা তাঁহাদের ভাবের বাহন। পশ্চিমবঙ্গ এই গালিগালাজের স্রোতে অকাতরে গা ভাসাইয়া দিয়াছে। বাঙালি এক্ষণে গালিগালাজকেই মহান বিপ্লব বলিয়া ভাবে। সমাজ যেমন, সমাজের রাজনীতিও তেমন। সমাজ সংস্কৃতির পরিসরেও ব্যাধির লক্ষণ স্পষ্ট। গালিগালাজই অধুনা ‘স্মার্ট’ হইবার সহজ প্রকরণ। ভদ্রলোক বাঙালির পপকর্ন-সেবিত সিনেমা কালচার। গালাগাল শুনিয়া হাস্য। ঢলাঢলি। আহ্লাদ। ইতিবাচক ভাবনা নাই, গড়িয়া তুলিবার মুরোদ নাই। রাজনীতির দুনিয়াই বা পিছাইয়া থাকে কেন? ছোট নেতা হইতে বড় নেত্রী, সকলে কুভাষা ধরিবেন, পাড়িবেন। এই সকল নাকি কথামৃত। লোকায়ত ভাষা। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক উচ্চারণ। আসলে নির্ভেজাল গরল অভব্য অশিক্ষার বিষ। অশিক্ষিতের, বস্তুত অশিক্ষা-গর্বিতের যুক্তির অভাব হয় না! সে যুক্তি কুযুক্তি, অপযুক্তি। বাঙালি অপযুক্তির বশ হইয়াছে।

Advertisement

বাঙালির গালিগালাজ নূতন জন্ম লইল, এমন নহে। অতীতেও সুজলা সুফলা বঙ্গরাজনীতিতে কানা বেগুন হইতে জোড়া বলদ বহুবিধ কুবাক্যের চাষ হইয়াছে। কিন্তু তাহা হইতে উত্তরণের পরিবর্তে সমাজ উত্তরোত্তর পঙ্কের অতলে নামিতে চাহিবে, ইহাই কি নিয়তি? ইহাকেই সমাজ ও রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি বলিয়া মানিয়া লইতে হইবে? অথচ বাঙালি আপন ইতিহাস হইতে শিক্ষা লইতে চাহিলে তাহার সুযোগ ছিল এবং আছে। বাঙালি তো অন্য রকম ইতিহাসও দেখিয়াছে। রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্র প্রসঙ্গে লিখিয়াছিলেন, বঙ্কিম বঙ্গ সাহিত্যে ‘শুভ্র সংযত হাস্যরস’ লইয়া আসিয়াছিলেন। বঙ্কিমে তাহা সীমিত ছিল না। রাজনীতিবিদদের বাগ্মিতা কী হইতে পারে ইতিহাসে তাহার সাক্ষ্য রহিয়াছে। দেশ স্বাধীন হইবার পরেও দিল্লিতে বাঙালি রাজনীতিবিদরা, ফলপ্রসূ রাজনীতিতে না হউক, তার্কিক বাচনে সম্মানিত ছিলেন। বঙ্গভূমির সাংসদেরা কী ভাবে তাঁহাদের বক্তব্য পেশ করেন, তাহা অপরাপর প্রদেশের নেতারা শুনিতেন, ভাবিতেন, অনুসরণ করিতেন। আর এক্ষণে? নিজের ভাষাতেও সুষ্ঠু সুন্দর ভাবে দুটি কথা বলিবার সাধ্য নাই। বাঙালি যথার্থ বং হইয়াছে।

অতএব আশাবাদের স্থান নাই, ভবিষ্যত্‌ তমসাচ্ছন্ন। ভাষার কদর্যতা সেই অন্ধকারের প্রতীক এবং অগ্রদূত। অপশব্দ আঘাত করে। অপরকে হেয় করে। যাঁহার আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস নাই তিনিই অপরকে হেয় করিয়া থাকেন। বাঙালির সব গিয়াছে। আত্মসম্মানহারা, আত্মবিশ্বাসহারা জাতির নেতারা জেলের অন্ন খাইতেছেন। বলিতেছেন, রাজনীতিবিদ জেলে যাইতেই পারেন, গাঁধী নেহরু সুভাষও গিয়াছিলেন। সব জেলযাত্রা সমান নহে। সব বাক্য কথামৃত নহে। কিন্তু সে কথা বাঙালিকে কে বুঝাইবে? বুঝাইবার চেষ্টাও বৃথা। অতল জলের আহ্বানে সে যেমন চলিয়াছে, তেমনই চলিবে, কেহ সমালোচনা করিলেই কুবাক্যের প্লাবন ছুটাইয়া দিবে। ইহাই বাঙালির বর্ষফল।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement