গেরুয়া-গৌরব। দীপাবলিতে বিজেপি মিছিল, শ্রীনগর, ২৩ অক্টোবর। ছবি: পিটিআই।
বড় যুদ্ধের মুখোমুখি জম্মু ও কাশ্মীর। শাসক দল ন্যাশনাল কনফারেন্স-এর (এন সি) প্রবল আপত্তি এই সময় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু সে সব আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে জাতীয় নির্বাচন কমিশন রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। এন সি ছাড়া অন্যান্য সব দল অবশ্য পুরোমাত্রায় প্রস্তুত। একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। এন সি রাজ্যের শাসক দল হলেও তাদের আপত্তিতে কিন্তু রাজ্য প্রশাসনের একটা বড় অংশের সায় নেই, তাঁরা দ্রুত নির্বাচন চান। একই দলে থেকেও মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা যে প্রশাসনের বাকি অংশের থেকে কতটা দূরে চলে গিয়েছেন, এর থেকে তার একটা আন্দাজ মিলতে পারে।
৭ সেপ্টেম্বরের সেই কালান্তক বন্যার দুর্গতি এখনও কাশ্মীরের আনাচে কানাচে জানান দিচ্ছে। এখনও বহু মানুষ ঘরছাড়া। যাঁরা ঘরে ফিরেছেন, তাঁরাও নিশ্চিন্ত জীবনে ফিরতে পারেননি। এর মধ্যেই নির্বাচন? প্রশাসন অবশ্য বলছে, প্রাদেশিক নির্বাচনী কেন্দ্রগুলির মাত্র আটটিতে এখনও বন্যাপরবর্তী সংকট চলছে। অন্যান্য জায়গায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে ইতিমধ্যে, স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। কিন্তু যেখানে মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে, সেখানেও কি এত বড় মাপের একটা নির্বাচন করার পরিস্থিতি আছে, প্রশ্ন এটাই।
এখানে অবশ্য আরও একটা বিচার্য বিষয় আছে। বন্যার ধ্বংস-তাণ্ডব পেরিয়ে মানুষকে আবার নিশ্চিন্ত জীবনে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব তো রাজ্য সরকারেরই। এখন, যে রাজ্য সরকার সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেনি, যাচ্ছেতাই ভাবে ত্রাণ ও সুরক্ষার কাজে ব্যর্থ হয়েছে, মানুষ যদি মনে করেন তারা থাকলে উন্নতির আশা নেই, এবং নির্বাচনের সময় হয়েই এসেছে, তা হলে নির্বাচন স্থগিত রাখার যুক্তি কোথায়? আরও একটা পথ অবশ্য আছে, রাজ্যপালের শাসন! তবে তার থেকে তো নির্বাচনই শ্রেয়!
এন সি ছাড়া সকলেই তাই আপাতত ভোটের পক্ষে। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার শরিকি মন্ত্রিসভার ‘ব্যর্থতা’র কথা তুলে ধরার সুবর্ণসুযোগ থাকবে এই পরিস্থিতিতে। ভোটের ত্রাণকার্য ব্যাহত হবে বলেই নাকি এন সি ভোট চাইছে না! এমন একটা হাস্যকর দাবিকে স্বভাবতই কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। দেওয়ার কারণও নেই। গত এক মাসে ওমর আবদুল্লা ও তাঁর দলের সাধারণ সচিব আলি মহম্মদ সাগরের কাজকর্মে কথাবার্তায় ত্রাণবিষয়ক দুশ্চিন্তার এতটুকুও প্রমাণ মেলেনি। গত ছয় বছরে যে ধরনের প্রশাসনিক কাজ হয়নি, সামনের কয়েক সপ্তাহে সে সব মন্ত্রবলে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না কাশ্মীরের জনসাধারণ।
এখানেই সরকারি দায়িত্বহীনতার শেষ নয়। আরও আছে। বন্যার সর্বব্যাপী দুর্গতির মধ্যেও প্রত্যহ চলছে প্রশাসনিক সুবিধা আদায়ের ধারাবাহিক রাজনীতি। ইতিমধ্যে এন সি সরকার নির্লজ্জ ভাবে জম্মু ও কাশ্মীরে আরও ৪০০টি প্রশাসনিক ইউনিট বানিয়েছে। তার ফলে রাজ্যের কোষাগারের উপর চাপ অনেক গুণ বেড়েছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে: উত্তর কাশ্মীরের রাফিয়াবাদে তিন কিলোমিটারের মধ্যে তৈরি হয়েছে তিনটি তহশিল। ৮০০টি নতুন স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি হয়েছে। মোটের উপর ওই সংখ্যাতেই শিক্ষাকেন্দ্রও স্থাপিত হয়েছে অর্থমন্ত্রকের প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছাড়াই। এত তড়িঘড়ি, পরিকল্পনাবিহীন, অপচয়-বহুল ‘উন্নয়ন’-এর একমাত্র লক্ষ্য, অবশ্যই, ভোটব্যাঙ্কের সেবা। উল্টো দিকে এন সি মন্ত্রীরা বন্যাকবলিত অঞ্চলগুলি স্বচক্ষে এক বার দেখে আসারও সময় পাচ্ছেন না। বরং তাঁদের ভিড় জমাতে দেখা যাচ্ছে নতুন ট্রেজারি বা নতুন তহশিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, কিংবা নতুন নতুন ডিগ্রি কলেজ, পলিটেকনিকের সামনে।
ভোটের বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে তাই স্পষ্ট, এ বারের যুদ্ধটা অন্য রকম, বেশ বড় মাপের। ২০০২ সাল থেকে এ রাজ্যে শরিকি সরকার। দুই-দুই বার জম্মু-র দৌলতে বড় সংখ্যক আসন পেয়ে কংগ্রেস সবচেয়ে জরুরি জায়গাটা নিতে পেরেছিল, শরিকি বোঝাপড়ার মধ্যে শাসক দলকে প্রয়োজনীয় সমর্থন জোগানোর কাজটা করতে পেরেছে। ফলে তার নিজের গুরুত্বও রাখতে পেরেছে। গত মে মাসের জাতীয় নির্বাচন কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছে, সে জমানা শেষ, এ বছরটা আর কংগ্রেসের নয়। জম্মু ও লাদাখে তিনটি আসনই এ বার বিজেপি-র। অথচ এগুলোই ছিল কংগ্রেসের জোরের জায়গা। একই ভাবে, কাশ্মীরের এন সি-র সব আসনগুলি পেয়েছে পিপলস্ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বা পি ডি পি। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, বিজেপি এ বার খেলাটা অনেকটাই পাল্টে দিতে পারবে।
বিজেপি নিজে কী চাইছে? ৪৪টির বেশি আসন। হয়তো একটু অবাস্তব উচ্চাশা। কিন্তু এই উচ্চাশাই বলে দেয় যে বিজেপি-র অবস্থা এ বার অনেকটাই অন্য রকম। জম্মুতে এ বার তাদের আশা, ৩৭টি আসনের অধিকাংশই তারা পাবে। ১৫টি কেন্দ্র মুসলিমপ্রধান, কিন্তু তাতে কী! সেখানে বিজেপির চাল হবে উত্তরপ্রদেশের মতো হিন্দু ভোট আর মুসলিম ভোটের স্পষ্ট মেরুকরণ, এবং হিন্দু ভোটের একত্রীকরণ। এই স্ট্র্যাটেজি সফল হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই, কেননা উল্টো দিকের ভোট অন্তত তিন ভাগে ভাগ হয়ে যাবে এন সি, পি ডি পি এবং কংগ্রেসের মধ্যে। অধিকাংশ আসনেই চলবে চতুর্মুখী লড়াই। সুতরাং জম্মুতে সন্দেহাতীত ভাবে অ্যাডভান্টেজ বিজেপি। লক্ষণীয়, জম্মুতে বিজেপির যতটা লাভ, প্রায় সবটাই কিন্তু কংগ্রেসের ক্ষতি। কিছুটা ক্ষতি এন সি-রও। লোকসভা ভোটে বিজেপি-র ‘সুইপ’, চলমান সীমান্ত-সংঘর্ষ, নরেন্দ্র মোদীর জাতীয়তাবাদের দৃঢ় বার্তা, বিজেপি-র পক্ষে জোরালো হাওয়া বওয়াতে যথেষ্ট।
এবং সে ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্যও পাল্টাতে বাধ্য। জম্মুতে বিজেপি বড় জয় পেলে পি ডি পি, এন সি দু-এরই বিরাট সমস্যা। বাইরে থেকে সমর্থন নিয়ে সরকার গড়ার কোনও আশাই আর তাদের থাকছে না। দুই দলের কাছেই কংগ্রেস ছিল ‘সেকুলার’ দল, সরকার গড়ার পক্ষে হাত মেলানোর জন্য ঠিকঠাক যোগ্য। বিজেপি জিতলে সে গুড়ে বালি। তার চেয়েও বড় কথা, রাজনৈতিক কূজনগুঞ্জন যদি বিশ্বাস করতে হয়, তবে বিজেপি বড় ভাবে জিতে এসে সরকার গড়লে আরও একটা ঘটনা প্রথম বার ঘটতে পারে। জম্মু ও কাশ্মীরের হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী। প্রথম বার।
২৭ অক্টোবর বিজেপি মুখপাত্র নলিন কোহলির মন্তব্যেই প্রথম বার স্পষ্ট হয় যে এ বার জিতলে বিজেপি এ রাজ্যে হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগের কথা ভাববে। বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে বলেছিলেন কোহলি, “জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী যিনিই হোন না কেন, তাঁকে অবশ্যই রাজ্যের মানুষ হতে হবে, প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার নির্বাচিত সদস্য হতে হবে, কিন্তু তাঁর ধর্মীয় পরিচয় কী হবে, তা নিয়ে কোনও বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে না।” বিজেপি এও জানিয়ে দিয়েছে যে তারা নির্বাচনে একাই লড়বে, ৮৭ আসনের প্রতিটিতেই। লড়বে না-ই বা কেন! লোকসভা নির্বাচনে তিনটি আসনই তো তাদের ছিল। তার পর ঘটে গিয়েছে হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রের নির্বাচন। বিজেপি এখন জম্মু-কাশ্মীরেও ‘নতুন ইতিহাস রচনা’র তোড়জোড়ে ব্যস্ত।
কেবল জম্মুতে নয়, কাশ্মীর উপত্যকাতেও বিজেপির স্পষ্ট জানান এ বছর। প্রতি দিন চেনাশোনা রাজনৈতিক অরাজনৈতিক মুখগুলিকে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে বসতে দেখা যাচ্ছে। বিজেপি যে উপত্যকা-অঞ্চলে নিজের মতো একটা জায়গা তৈরি করে নিয়েছে, তার সব লক্ষণই চোখের সামনে। ঐতিহ্যগত ভাবে উপত্যকার যে আড়াইটে জেলা হিন্দুপ্রধান, আগে থেকেই বিজেপি সেখানে উপস্থিত ছিল। তবে খুব একটা জোরদার ছিল না সেই উপস্থিতি। ২০০২-এর প্রাদেশিক নির্বাচনে কংগ্রেস যথেষ্ট ভাল করে, জম্মুর ৩৭টি আসনের ১৬টা পায়। কাশ্মীরে পায় চারটি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে অমরনাথ মন্দিরের জমি-সংক্রান্ত মামলা শুরু হয়, ফলে কংগ্রেস আসন-সংখ্যা নেমে আসে ১৩-য়। ওই অমরনাথ মামলার জেরেই বিজেপি-র ২০০২ সালের মাত্র একটি আসন ২০০৮ সালে উঠে আসে ১১-য়!
সব মিলিয়ে এ বারের নির্বাচন জম্মু ও কাশ্মীরে বিজেপি-র ভাগ্যাকাশের উজ্জ্বলতা অভূতপূর্ব। অনেক দিন ধরে কাশ্মীরের রাজনীতি কেবল চক্রাকারে ঘুরে চলেছে: ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী ও কেমন, সেই প্রশ্ন ঘিরেই চলছে নানা দলের চাপান-উতোর। এ বার কিন্তু দিল্লির বিজেপি সরকার যে পথে চলছে, তাতে জম্মু ও কাশ্মীরে খুলতে চলেছে রাজনীতির নতুন চক্র, ধর্মীয় মেরুকরণের চক্র। বোঝাই যাচ্ছে, জনবিন্যাসের ধরন কিংবা আইডেন্টিটির প্রশ্নের সামনে মানুষকে জাঁতাকলে চেপে রাজনীতির ফসল তোলার চেষ্টা করবে বিজেপি। হয়তো এর থেকে আবার নতুন করে একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। হয়তো সেটা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখাও মুশকিল হতে পারে। বিজেপি যেটা চাইছে, তা যদি বাস্তবায়িত হয়, তা হলে নিশ্চিত ভাবে কাশ্মীর ফিরে যেতে চলেছে সেই ১৫৮৬ সালে, যখন কাশ্মীরের রাজা ইউসুফ শাহ চাক-কে আসনচ্যুত করেন মুঘল সম্রাট আকবর, আর তার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় সংখ্যাগুরু সমাজের পিছিয়ে পড়ার ঐতিহাসিক অভিমুখ।