চারিদিকে শুধু শয়তান আর নির্বোধ! নইলে আমার বাড়ির ঠিকানা খুঁজলে লোকে বলে, কাককে জিজ্ঞেস করে নিন! আরে, গাদা গাদা কাক এঁকেছি কি সাধে! এই ইতর সমাজে আর আঁকার মতো আছে কী? তোরা প্রতিভার কদর করিস না, ঋষিপ্রতিম দাড়ি প্লাস শিশু ভোলানাথ মার্কা হাসি দেখে পায়ে লুটিয়ে পড়িস না, দৃপ্ত বক্তিমে শুনে ফুসফুসিয়ে হাসিস, তোরা মানুষ? সব ছাগল, আর শিম্পাঞ্জি। একটা সিরিজে এঁকেওছি ব্যাটাদের, নিজেদের মুখ একটু ভুরু কুঁচকে দেখলে চিনতেও পারবে, গোরিলার গালের মধ্যে থেকে, বেবুনের ঠোঁটের মধ্যে থেকে, মহা-আয়নার মতো তাকিয়ে আছে। অবশ্য এত বুদ্ধি থাকলে তো হয়েই যেত। আমাকে, আমার ক্যানভাসকে, একর একর জমি ব্যেপে গড়া আমার বিশাল শিল্প-ঘনঘটাকে, উঠতেবসতে পেন্নাম ঠুকত। তার বদলে এরা শিখেছে শুধু খ্যা খ্যা করে হাসি, অন্য লোকের দুর্দশায় আর অপমানে ন্যাজ দুলিয়ে ফুর্তিলাফ, বিচারবুদ্ধি কিস্যু না কাজে লাগিয়ে উচ্চণ্ড আমোদে ‘হোলি হ্যায়’ মর্মে কাদা ছোড়া। গা কনস্ট্যান্ট রি-রি করে। তাই এদের ছেড়ে, এই শহরের সত্যিকারের মহান যারা, যারা অন্যের নোংরা সাফ করে, কাউকে ঘাঁটায় না, লীলায়িত কালোকৃষ্ণ ঘাড় বেঁকিয়ে বারান্দায় বসে গোয়েন্দা-জরিপ লাগায়, আর বখেড়া বুঝলেই ডানা ফড়ফড়িয়ে উড়ে যায় নিজস্ব নির্জন মগডালে, সেই পাতি ও দাঁড়গণেরই শোয়া-বসা এঁকে আর স্টাডি করে কাল কাটিয়েছি।
কাল হল আমার নিজেকে সেই বায়স-বিলাসের বাইরে ছড়িয়ে দিতে চাওয়া। বিরাটতার কোনও তাত্পর্য আছে এই কুয়োর ব্যাঙদের দরবারে? ভাবলাম, এমন শিল্পসংগ্রহ দেখাব, গেঁয়োগুলোর চোখ তৈরি হবে, একটা আন্তর্জাতিক কাণ্ডাকাণ্ডর দিকে দীক্ষাটা গড়িয়ে যাবে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বচ্ছর বচ্ছর ছোটাছুটি শেষে বন্দোবস্ত করলাম। তা মর্কটগুলো বলে কী, কোন ধ্যাধ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে আর্টব্যবস্থা পাকিয়েছেন দাদা, সাড়ে ছ’টা বেজে গেলে বাস পাব না! আরে, আমি কি কন্ডাক্টর? তোকে পিকাসো চেনাব না দৌড়ে বাস ধরে দেব? তার পর এখন আবার পেছনে লেগেছে, অ্যাত্ত পেল্লায় যজ্ঞ করার পয়সা এল কোত্থেকে? আরে, সে সব নীরস বিরক্তিকর খুঁটিনাটি নিয়ে টান মারিস কেন? এন্ড-রেজাল্টটা দ্যাখ! একটা বাচ্চা গাবদাগোবদা দেখলে তাকে গাল টিপে ছুঙ্কুমুঙ্কু বলে আদর করবি, না কোন পয়সায় দুধ-ঘি খেয়ে বাছা এমন তন্দুরস্ত হল তাই নিয়ে প্যাচাল পাড়বি?
কেউ কেউ টিটকিরি মেরে সুপার-গেছোদাদা অবধি বলছে! আমার টিকি ধরতে গেলে নাকি প্রথমে দেখতে হবে আমি কোন কোন কোম্পানির বোর্ডে আছি, তার পর দেখতে হবে আমি কোন কোন কোম্পানির বোর্ডে নেই, তার পর দেখতে হবে কোন কোম্পানির বোর্ডে নেই কিন্তু নিজ বাড়ির ঠিকানাটা কেন কে জানে দিয়ে রেখেছি, তার পর দেখতে হবে কোন কোম্পানি থেকে ইস্তফা দিয়েছি কিন্তু কেন কে জানে আমার নাম রয়ে গেছে, তার পর দেখতে হবে ছ’কোটি পেয়েছি না চোদ্দো কোটি, তার পর দেখতে হবে তার কতটা নিজে নিয়েছি কতটা কাকদের দিয়েছি, কত বার বলেছি ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না কত বার বলেছি কাক চাইলেই ভাত দিতে যাব কেন, শেষে অবশ্যই দেখতে হবে দিদি কী বলছেন। উত্তর দিতেও ঘেন্না হয়। আমার স্ট্যান্ডার্ডের শিল্পী বিদেশে জন্মালে মাথায় তুলে নেত্য করত, বেয়াড়া প্রশ্ন করার ভাবনা অবধি মনে এলে হেঁচকি তুলে জিভ কাটত। আর এখানে, যাকে পাচ্ছে তুলে এনে অপদস্থ করছে। আসলে বেসিক শিক্ষা না থাকলে এই হয়। যে সরকার সত্যিকারের শিক্ষিত আবহাওয়া আনছিল, তাকে সব ভেস্টেড ইন্টারেস্টওলা কোংগুলো লাগাতার গালাগাল দিয়ে টায়ার ফুটো করে দিল, এখন ফ্যাশন হয়ে গেল মহান ভিআইপিদের তুলে এনে জেরা। আর শকুন-মিডিয়া তো আছেই, পাঁকে পড়া হাতিদের ছিন্ন ইগোগুলোর টুকরোটাকরা দিয়ে মোচ্ছব লাগাচ্ছে।
এমন আস্পদ্দা, জিজ্ঞেস করে, দিদির ছবি কি অত কোটি টাকায় বিক্কিরি হওয়া উচিত? আরে, শিল্পে আবার উচিত-অনুচিত কী? শিল্প তো আপেক্ষিক রে ব্যাটা। দিদির ছবি ভাল না খারাপ, আজ থেকে সাড়ে তিনশো বছর পরে এই ছবির এক একটা আঁচড় দোহন করে ক্রিটিকরা অমৃতানন্দে ডিগবাজি খাবে কি না, হলফ করে কেউ বলতে পারবে? কেউ বুকে হাত রেখে ঘোষণা করতে পারবে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিদির চেয়ে হারগিস উন্নত? আর্টের মজাই হচ্ছে ওই। তোমার কাছে যা সাড়ে তিন ইঞ্চি, আমার কাছে লিয়োনার্দো ভিঞ্চি। জীবনের ব্যাপারটাও তা-ই। তুই কী বুঝবি আমার ভাবনা, ভাঁজ, ভালবাসা? আমার মহত্ত্ব, কল্পনা, কীর্তিকাহিনি, এ সমুদ্দুরের ইশারা পেতে গেলেও তো তোকে এক-লাইব্রেরি ঢেউয়ে বাটারফ্লাই স্ট্রোক মারতে হবে।
আর, মেগা-মহান কাজ করতে গেলে তার ব্লুপ্রিন্ট গবা জনগণের সামনে মেলে ধরা যায় না। অপেরার রিহার্সাল পাঁচমাথা মোড়ে হয়? দুর্দান্ত ব্যাপারে মন্ত্রগুপ্তি দরকার হয়, ধ্যানের ঘরে ‘ডোন্ট ডিসটার্ব’ সাইনবোর্ড টাঙাতে হয়। বহু ফুসুরফুসুর ও গাঢ় গুজুরগুজুরের পরে, নিজের কর্মকাণ্ডে বউ-মেয়েকে ইনক্লুড করে, শেয়ার বেচে, কিনে, ফের ছেড়ে, রিজাইনের চুক্কি দিয়ে, পুরো জিনিসটা ফাঁকেতালে অন্যকে গছিয়ে, অনেক ভাঁজ ডজ সন্ধি অভিসন্ধির তেল পুড়িয়ে, তবে যুগান্তকারী অবদান মানবসভ্যতার পাতে গড়িয়ে দিতে হয়। সে সব না বুঝে যদি শুধু একটা কানা সত্-সত্ চু-কিতকিত খেলতে ব্যস্ত হোস, তবে খোলামকুচি ছুড়ে যা, কিন্তু কিস্যু করতে পারবিনি। আমি খুচরো ক্রো ধ কবেই জয় করেছি, শান্ত সমাহিত হয়ে সব সয়ে নিচ্ছি, কিন্তু এক বার রেগে গেলে গোটা রাজ্যের সাতাশ লাখ কাক লেলিয়ে দেব, ঠোকরের চোটে অনুসন্ধিত্সু ঘিলু ছেতরে থাকবে!
লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়