নাইজিরীয় লেখক চিনুয়া (চিনুয়ালুমোগু) আচেবে-র থিংস ফল অ্যাপার্ট ও অন্য উপন্যাসগুলো পড়ার সুযোগ হয় বছর পনেরো আগে, এক বন্ধুর বাত্সল্যে। লেখাগুলো গিলতে গিলতে যতটা না অভিভূত হচ্ছিলাম, তার চেয়ে বেশি বোধ হয় ঈর্ষান্বিত। সম্প্রতি সেই ঈর্ষা বাড়তে বাড়তে একটা আক্ষেপে পরিণত হল, চিনুয়া-র সহনাগরিক চিমামান্দা এন্গোজি আদিচি-র উপন্যাস পার্পল হিবিস্কাস ও ছোটগল্প হাফ অব আ ইয়েলো সান পড়তে পেরে। আক্ষেপের কারণটা এঁদের কাহিনি ও আমাদের দেশের সম্ভাবনা-বিনষ্টির সঙ্গে যুক্ত।
দুই লেখকেরই মাতৃভাষা ইগ্বো। দু’জনেই ইংরেজি ভাষাতে লিখে বিশ্বসাহিত্যে পাকা আসন করে নিয়েছেন। ইংরেজির সঙ্গে এঁদের সম্পর্কটা দ্বান্দ্বিক, চিনুয়া একে বলেছিলেন ‘উপনিবেশ বিস্তারীদের ভাষা’, চিমামান্দার কাছেও এ ভাষা ‘কাজের জিনিস’। দু’জনের মধ্যে বয়সের তফাত প্রায় অর্ধশতাব্দীর: চিনুয়ার জন্ম ১৯৩০, চিমামান্দা-র ১৯৭৭। আরও অনেক আফ্রিকীয় ও অন্য দেশের কৃষ্ণকায় লেখকলেখিকাদের মতো চিমামান্দার কাছেও চিনুয়া আদর্শ, অনুপ্রেরণা। তিনি আবার চিনুয়ার স্নেহধন্যা। চিনুয়া একদা যে বাড়িতে থাকতেন, সেই বাড়িতে থাকারও সুযোগ পেয়েছিলেন চিমামান্দা। প্রয়াত (২০১৩) চিনুয়া বিশ্বখ্যাত হয়েছেন প্রথম উপন্যাসেই। শুধু কৃষ্ণ-বিশ্বেই নয়, তাবত্ সাহিত্যপ্রেমীর কাছেই চিনুয়া এক প্রিয়তম নাম। চিমামান্দার লেখাপত্রও খ্যাতির পূর্ণ পীতসূর্যালোকে উদ্ভাসিত।
খ্যাতি সহজিয়া নয়। রচনার উপাদান সংগৃহীত হচ্ছে যে-সমাজ থেকে, তার কঠোর জীবনসংগ্রাম, ভিন্ন ভিন্ন পরাধীনতা থেকে মুক্তির প্রয়াস, ঐক্য ও বিচ্ছিন্নতা, সংঘাত ও সম্প্রীতি, বহুত্ব ও একত্বের দ্বন্দ্বে লেখকদের নিজস্ব মনোজাগতিক অংশীদারি থেকে উদ্ভূত হৃদয়ের যন্ত্রণা, মস্তিষ্কের আলোড়নকে ভাষা দেওয়ার পথ কত কষ্টে তাঁরা পার হয়েছেন, কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। সে সমাজ তাঁদের নিজেদের, তার ভাঙা-গড়া, উত্তরণ-অবতরণ, সুখ-দুঃখ, সবেতেই তাঁদের পূর্ণ অংশীদারি। তাদের কথাগুলো তাঁরা নিজেরা বলতে পেরেছেন বলেই সেগুলো এত সজীব, পাঠকের কাছে এত মর্মগ্রাহী। নিজেদের মর্মভেদী কিন্তু সক্ষম অভিব্যক্তিতে সেগুলো এত সত্য। শুধু বক্তব্য বিষয়ই নয়, কথনশৈলীটাও তাঁরা খুঁজে নিয়েছেন ইগ্বোদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য থেকেই: সত্যের প্রকাশ তার উপস্থাপনায়।
আক্ষেপের কারণটা বিশ্বসাহিত্যের আসরে চিনুয়া থেকে চিমামান্দার নিরবচ্ছিন্নতার পাশাপাশি ভারতবর্ষের ম্রিয়মাণ ছবি, অথচ তারও তো আছে এক আশ্চর্যময় ভাষা-সাংস্কৃতিক, সামাজিক ঐতিহ্যের ধারা, যা আমাদের আদিবাসী প্রতিবেশ, তার সমাজ, তার ইতিহাস, দৈনন্দিনতা ও পরম্পরায় গড়া মনোবিশ্বকে বিশ্বের কাছে উপস্থাপিত করতে পারলে বিশ্বসাহিত্য কত-না ধনবান হতে পারত! ইগবোরা যদি পারেন, তা হলে মুন্ডা বা সাঁওতাল, ভীল বা পানিয়া, কন্ধ বা ওরাওঁরাই বা পারবেন না কেন? এঁদেরও তো আছে দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ভাষার বিপুল সম্ভার, সেই সঙ্গে মানবিক-গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুশীলনের উত্তরাধিকার। এ কারণেই ঈর্ষা, আক্ষেপ। হতাশাও কি নয়?
আক্ষেপটা তো আসলে আশা-ই। সেটা যে অসঙ্গত নয়, যেন সে কথা প্রমাণ করতেই হাতে এল হাঁসদা সৌভেন্দ্রশেখরের উপন্যাস দ্য মিস্টিরিয়াস এলমেন্ট অব রূপি বাস্কে (আলেফ)। তর্জমা নয়, মূল ইংরাজিতে লেখা। সৌভেন্দ্র পেশায় সরকারি ডাক্তার, বোধ হয় লেখক-নাম হিসেবে বংশ-নামকে আগে নিয়ে এসেছেন। ঘাটশিলা এলাকায় নিজের গ্রামের অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করে সৌভেন্দ্র তাঁর কাহিনিকে মিশিয়ে দিয়েছেন বৃহত্তর জগতের সঙ্গে: অভিজ্ঞতা তাঁর লেখার শেকড়বাকড়, শিক্ষার প্রশস্ত অঙ্গন তাঁর পুষ্পপল্লব।
উপন্যাসে এ গ্রাম কদমডিহি, গ্রামের সর্বশ্রদ্ধেয় মানুষ সোমাই হাঁসদা বিবেক ও ন্যায়বিচারের প্রতীক। বহু বার নষ্টগর্ভা প্রথমা পত্নী একমাত্র জীবিত কন্যা পুটকি-র জন্ম দিয়ে মারা যান। সাঁওতাল সামাজিক প্রথা অনুযায়ী অপুত্রক সোমাই ঘরজামাই প্রথায় মেয়ের বিয়ে দেন লোয়াডিহি-র খড়দা বাস্কের সঙ্গে। তাঁদের বড় ছেলে সিদো লেখাপড়া করে স্কুলমাস্টার। তার বিয়ে হয় তিরিলডি গ্রামের রূপির সঙ্গে।
নিত্রা গ্রামে সিদোর স্কুল, তার সহকর্মী ও অগ্রজপ্রতিম বন্ধু বৈরামের সঙ্গে সে বাসা নেয় গ্রামের মাঝি (প্রধান)-এর বাড়িতে। সিদোর সঙ্গে এখানে আসার পর কদমডিহির সবচেয়ে বলবতী ও কর্মঠ বধূ রূপি এক রহস্যময় অসুখে পড়ে, কোনও চিকিত্সাতেই কোনও কাজ হয় না। জনরব, বৈরামের ব্যক্তিত্বময়ী স্ত্রী গুরুবারি প্রেমে বেঁধে রেখেছিল সিদোকে, আর সে-ই নাকি রূপিকে দিয়েছিল এই অসুখ। কাহিনি রূপি-কেন্দ্রিক, নারী-প্রধান, কিন্তু প্রতিটা চরিত্রই অপরিহার্য, প্রতিটাই তেমনই জীবন্ত, যেমনটা ঝাড়খণ্ড সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের গ্রামগুলোতে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। চাষবাস, ঘরসংসার, ঈর্ষা, ভালবাসা, ডাইনিবিদ্যা, ধনকঁুদরা ভূত এবং অন্যান্য অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, মেয়েদের ক্ষমতা-অক্ষমতার জটিলতা পাঠকের মন টেনে রাখে। সমাজের নানা ভাঙাগড়া, পুরনো-নতুনের সংঘাত, হারানোর হাহাকার ও প্রাপ্তির উল্লাসের মধ্য দিয়ে, গ্রহণে-বর্জনে বিকাশমান জীবনের পথ ও বিপথের অসামান্য, নির্মেদ কিন্তু পূর্ণস্ফুট কথকতা। এ বাক্শিল্প সৌভেন্দ্র আয়ত্ত করেছেন সাঁওতাল সমাজের মৌখিক সাহিত্যের বিপুল সমৃদ্ধি এবং ভাষার যুক্তিনির্ভর শিল্পময়তা থেকে, যে ভাষা মাধুর্যের জন্য বাহুল্যের আবাহন করে না (যদিও তার সম্ভার বিপুল, পি ও বোডিং সংকলিত সাঁওতাল অভিধানটি পাঁচটি বৃহত্ খণ্ডের জায়গা নিয়েছে)।
“সন্ধ্যা নেমেছে। রাস্তার ও পারে পাহাড়ের পিছনে সূর্য অস্ত গেল। গোধূলিতে উঁচু পাথরগুলো অশরীরীর মতো দাঁড়িয়ে। হাল্কা কুয়াশা গ্রামটাকে ঢেকে ফেলল, যেন শীতকাল। রূপি চার দিকে তাকায়, ঘরের পাশে, গাছের ডালে পাখিদের কিচিরমিচির শোনে। ঠান্ডা বাতাস কান ছুঁয়ে যায়, সে কেঁপে ওঠে। আর তখনই দেখে সাদা চুল এক বুড়ি তার দিকে এগিয়ে আসছে।” (পৃ ১১১)
সে বুড়ি এক কাহিনি, যে একদা জীবিত ছিল। শুধু রূপি-ই না, যুক্তিবাদে তদ্গত পাঠকও কেঁপে ওঠে সমাজদেহে মিশে থাকা বহু কল্পবাস্তবতায়, শৈশবে শোনা ডাইনির গল্পগুলো স্মৃতি থেকে জেগে উঠে আসন্ন বার্ধক্যেও দেহে শিহরন জাগায়। উঠে আসে ধানখেত, মহুয়া, শালফুল, ঝাড়খণ্ড আন্দোলন, চালকল, রেলগাড়ি, পুরুষ-রমণীর উপভুক্ত দেহমন্থন। মানুষের ঢল নামে, সাঁওতালদের প্রতিবেশী, সাংস্কৃতিক আত্মীয় কামার, মাহাত, কুমোর-ঝাড়খণ্ডী জনসমষ্টি, তাদের ঐক্য ও বিরোধ, একত্র পথ চলার নানা বৈচিত্রময় দ্বান্দ্বিক অভ্যাস।
সুযোগ শুধু প্রতিভারই সমার্থক নয়, গণতন্ত্রেরও বটে। আদিবাসীদের সুযোগ-বঞ্চনার কারণে তাঁদের মধ্যে কত কত প্রতিভা কোথায় কোথায় মরে যায়, তার হিসাব তো আমরা জানিই না। আবার উল্টো দিকে পাই আদিবাসী সম্পর্কে বিজাতীয় দৃষ্টিতে আঁকা নানা ছবি; সহানুভূতিপূর্ণই হোক বা অবজ্ঞার, সে দৃষ্টি আদিবাসী সমাজ ঐতিহ্যের অন্তঃকরণে অন্তঃক্ষরণের নৈর্ব্যক্তিকতা থেকে গড়ে ওঠেনি— যেটা গড়ে উঠছে তাঁদের নিজস্ব আশ্চর্য লোককথাগুলোতে, যার নমুনা পাওয়া যায় পি ও বোডিং সংকলিত তিন খণ্ডের সান্থালি ফোক টেলস বা অন্য সংকলনগুলো থেকে। সৌভেন্দ্র যে কদমডিহি-র কথা বলেন, সেটা তাঁর কদমডিহি। এত দিন আমরা অন্যদের মুখে শুনে এসেছি ‘ওদের’ কদমডিহির কথা। আরোপিত অপরত্ব ভেঙে, আপন ও পরের বেড়া ভাঙার যে সাহিত্য, তাতে আপন সক্ষমতা একটা কেন্দ্রীয় ব্যাপার, যে সক্ষমতা আসে সামাজিক-অর্থনৈতিক সুযোগগুলো থেকে। ঠিক কতটা মূল্য দিয়ে সৌভেন্দ্র এ সুযোগ অধিকারে এনেছেন, তা কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু এ সুযোগ সমগ্র ভারতবাসীর জন্যই জরুরি।
এখন আর চিনুয়া ও চিমামান্দার প্রতি ঈর্ষা নেই, অনতিদিনেই আদিবাসী ভারতবর্ষের প্রতিনিধি— সৌভেন্দ্রই হোন বা অন্য কেউ— তাঁদের পাশে বসছেন, বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের জগত্টাকেও বিস্তৃত, সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য। নাগরিকের পূর্ণ অধিকার এবং নিজের জীবন নিজেরাই গড়ে তোলার যে সুযোগ শাসক ভারতবর্ষ তাঁদের দেয়নি, সেই অধিকার অর্জনের পথটাও হয়তো প্রশস্ত হবে রূপির রহস্যময় অসুখের নিরাময় প্রচেষ্টায়। সৌভেন্দ্রর লেখা উপন্যাস তাঁর সহভাষীদের মধ্যেও পঠিত হবার সুযোগ গড়ে উঠবে, আর তাঁদের ভাষাও সমান আদৃত, চর্চিত হয়ে উঠবে।