গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস চলে গিয়েছেন, মাস পুরতে চলল। মনে পড়ে, দিনটা কাটছিল ব্যস্ততায়। খবরের কাগজ পড়তে পারিনি, নেট-ও নয়। তাই খবরটা যখন সহকর্মীর কাছ থেকে পেলাম, তখন প্রায় সন্ধে। ল্যাপটপ খুলে দেখলাম, লক্ষ লক্ষ শোক সংবাদ, মেসেজ, ব্লগ, পোস্ট, ছবি। তার মধ্যেই প্রবল নাড়া দিয়ে গেল ফেসবুকে এক বন্ধুর পোস্ট করা কয়েকটি শব্দ প্রথম বার Cien a os de soledad পড়াটা যেন ছিল একটা ‘শক্’, একটা তীব্র অভিঘাত। ‘শক্’: মার্কেসের এই বই সম্পর্কে শব্দটা নতুন নয়, দুনিয়া জুড়ে অনেকেই অনেক বার বলেছেন।
ভাবতে গিয়ে দেখলাম, আমারও বইটির কথা ভাবলে ঠিক শক্ খাওয়ার অনুভূতিটাই প্রথমে মনে পড়ে, বইটির কোনও বিশেষ অংশের থেকে অনেক বেশি করে। পরে গার্সিয়া মার্কেসের অন্যান্য লেখার সঙ্গে পরিচিতি ঘটল। যে শিক্ষকরা ম্যাজিক রিয়েলিজ্ম বা জাদু বাস্তবতা বুঝিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে ‘তাত্ত্বিক’ আলোচনা থেকে অনেক কিছু শিখলাম। কিন্তু আজও ফিরে তাকালে বুঝি, গভীরতম স্মৃতি হয়ে আছে ওই শক্ খাওয়ার অনুভূতিটাই।
ম্যাজিক রিয়েলিজ্ম বা জাদুবাস্তবতা ও সুররিয়েলিজ্ম বা পরাবাস্তবতার সম্পর্ক, কিংবা বাস্তব, উপকথা ও জাদুর মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে অনেকেই গবেষণা করেছেন। একটা কথা সত্যি। এই বই নিয়ে এত পাঠকের মনে যে ‘শক্’ বা অভিঘাতের কথা বার বার ফিরে আসে, সেটা কিন্তু ফরাসি পরাবাস্তবতা-সাহিত্যের প্রধান প্রতিনিধি ব্রতঁ বা আরাগঁ-র মতো লেখকদের লেখা পড়লে যে বিস্ফোরক ‘শক্’, তেমন নয়। বরং এ যেন এক ‘প্রলম্বিত’ অভিঘাত আমরা যেন মেনে নিই যে বাস্তব পৃথিবী ও জাদু পৃথিবী সত্যিই পাশাপাশি অস্তিত্বশীল হতে পারে। কাহিনিতে যে অলৌকিক ঘটনাবলি ঘটে, যে অবিশ্বাস্য দৃশ্যের স্রোত বয়ে যায়, আমাদের বিস্ময় সেগুলোকে ঘিরে তৈরি হয় না। বিস্ময় বরং তৈরি হয় ঘটনাগুলি ঘটে যাওয়ার পর, কী করে আমরা বিস্মিত না হয়ে তাদের স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারলাম, সেই উপলব্ধি থেকে।
ছাত্রছাত্রীদের প্রায়ই বলি, কোনও বইয়ের উপর আলোচনা না পড়ে সরাসরি মূল বইটির মধ্যে ঢুকে পড়া ভাল। তারা প্রশ্ন করে, কেন, আগে কোনও ভূমিকা বা লেখক-বিষয়ক তথ্য বা লেখাটার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত জেনে নিলে আরও ভাল নয় কি? শুনলেই মনে পড়ে গার্সিয়া মার্কেসের লেখার সঙ্গে নিজের প্রথম মোলাকাতটা। ওই শক্ খাওয়ার অভিজ্ঞতা আজও আমার কাছে ‘পড়া’র নির্মল আনন্দের দ্যোতক হয়ে থেকে গিয়েছে। তত্ত্ব এবং প্রসঙ্গের ভিড় ঠেলে যদি বইটিকে পেতাম, এই আনন্দটা নিশ্চয়ই ঠিক এমন হত না।
আমার প্রজন্মের অন্যদের মতোই গার্সিয়া মার্কেসের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সত্তরের দশকের শেষের দিকে। তখনও হাইস্কুলে, পড়ার বই দেখলেই বিরক্তি ধরছে, হাতের কাছে যা পাচ্ছি পড়ে ফেলছি। তখন জানতাম না, তাঁর ডাক নাম গাবো। জানতাম না লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা, সাংবাদিকতায় বর্ণময় কেরিয়ার, কাস্ত্রোর সঙ্গে বন্ধুত্ব বা মারিয়ো ভার্গাস ইয়োসা-র সঙ্গে দ্বন্দ্ব। ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েব-এর আগেকার যুগ সেটা। এক পূর্ণ অজ্ঞতা, সরল আচ্ছন্নতা নিয়ে আমি নেমে এলাম মাকোন্দোর সেই আশ্চর্য জগতে, কী পেতে চাই, কী জানতে চাই, কিচ্ছুটি না জেনে।
পরে পড়েছি হর্হে লুই বোর্হেস, হুলিয়ো কর্তাসার, আলেহো কার্পেন্তিয়ের। জেনেছি কী ভাবে পরাবাস্তবতার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটা সাহিত্য আন্দোলন উঠে এসেছিল। এক অস্থির রাজনৈতিক সমাজের নানা ভুল ও অন্যায়ের মধ্যে থাকতে থাকতে যে মানুষগুলি প্রাণপণ নিজেদের স্বর খুঁজে চলতেন, টিকে থাকার পরিসরটুকু চাইতেন, তাঁদের কত জনকে সেই আন্দোলন শক্তি জুগিয়েছে, জেনেছি। বুঝতে পেরেছি, কী ভাবে পুরনো-নতুনের টানাপড়েন থেকে, দুর্নীতি আর অসহায়তার দিনযাপন থেকে, চলমান ইতিহাসের সার-টুকু ধরে রাখতে তৈরি হয়ে উঠেছে el realismo magical বা জাদু-বাস্তবতা।
বাস্তব সমাজটা গার্সিয়া মার্কেসের কাছে বড় বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি জাদু তৈরি করতেন বাস্তবের ফাঁকে ফাঁকে নীরবতা ও প্রকাশের মাঝে, ক্ষমতা ও সংশয়ের মাঝে, আড়ম্বরহীনতা ও চোখ-ধাঁধানো অসামান্যের মাঝে। এবং তিনি গল্প বলতে পারতেন। আশ্চর্য নয় যে তাঁর যে-কোনও উপন্যাসের কাহিনি সংক্ষেপ আকারে বলাটা বেশ কঠিন। আসলে তিনি তো মাত্র একটা গল্প বলতেন না। তিনি যেন একটা দুনিয়া তৈরি করে ফেলতেন, একটা জাতিকে বুনে দিতেন, সৃষ্টি করতেন একটা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ বা মহা-আলেখ্য। কী নেই সেখানে, স্মৃতি, কল্পনা, ইচ্ছে, মৃত্যু, স্বপ্ন, জীবনযাপন। অসংখ্য পরস্পর-সংযুক্ত গল্পের দুনিয়া খুলে দিত তাঁর লেখা।
২০১২ সালের জুলাই-এ জানা যায়, তিনি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত, লেখালিখি বন্ধ। তাঁর বই-এর অন্যতম সম্পাদক পেরা জানান, গার্সিয়া মার্কেস একটা উপন্যাস নিয়ে কাজ করছেন তখন। তবে বই প্রকাশের ব্যাপারে আর তাঁর আগ্রহ ছিল না। পেরা-কে নাকি বলেছিলেন, “এত অবধি এসে আমার আর নতুন বই প্রকাশের প্রয়োজন নেই।” তাঁর লেখা নিয়ে কত চলচ্চিত্র, টিভি-অনুষ্ঠান হয়েছে, কোনওটিই তাঁর লেখার শৈল্পিক বা বাণিজ্যিক সাফল্যের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি। ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস্ অব সলিটিউড’ নিয়ে ছবি বানানোর অনুরোধ তিনি গ্রহণ করেননি।
গার্সিয়া মার্কেস বলেছিলেন, ‘‘চরিত্রগুলোকে পাঠক সব সময় তাঁরা নিজেরা যেমন চান, সে ভাবে দেখতে পছন্দ করেন, নিজেদের পিসি মাসি ঠাকুরদার মতো করে। যে মুহূর্তে চরিত্রগুলো সিনেমার পর্দায় চলে আসে, পাঠকদের কল্পনাটাও সীমায় ঠেকে যায়।’’ এই কথাটাও আমার কাছে একটা ‘শক্’ ছিল, বুঝতে পেরেছিলাম কেন এত সিনেমা-প্রীতি সত্ত্বেও কোনও প্রিয় উপন্যাস থেকে বানানো ছবি আমি সহজাত প্রবৃত্তি-বশেই এড়িয়ে চলি। আসলে ভয় পাই যে আমার মনের মধ্যে যে ছবিটা, সেটা বড্ড সহজে পর্দায় ফুটে উঠে ছোট হয়ে যাবে।
১৯৪৭ সালে আন্তোন্যাঁ আর্তো লিখেছিলেন, ভ্যান গঘের ছবিতে কোনও ভূত নেই, কোনও বৃহত্-এর স্বপ্ন নেই, কোনও ভ্রমকল্পনা নেই। আছে কেবল বেলা দুটোর সূর্যের সেই প্রখর তাপদাহ। জন্মপূর্ব যন্ত্রণার স্মৃতি। আছে পবিত্র, উলঙ্গ পৃথিবী। আমরা তার আরও কাছে যাওয়ার মতো জ্ঞান অর্জন করলেই যে প্রকৃতি নিজেকে লুপ্ত করে ফেলে।” গার্সিয়া মার্কেসকে ভাবতে গেলেও এই কথাটাই মনে আসে আমার। যে শক্-এর কথা বলছিলাম তাঁর বই প্রথম পড়ার সূত্রে প্রথম বার প্রখর সূর্যালোকের তলায় স্বপ্ন আর কল্পনার মুখোমুখি দাঁড়াতে পেরেই হয়তো সেই শক্ বার বার উঠে আসে। সেটাই বাস্তবতার জাদু।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনলজি-তে গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভস-এর সিনিয়র ডিরেক্টর