‘রাগের মাথায়’। সে দিন, মিঠানিতে। জানুয়ারি ’১৫। ছবি: সন্তোষ কুমার মণ্ডল।
টাইম ইজ আউট অব জয়েন্ট...’ বাবার মৃত্যু-রহস্য জানার পর হ্যামলেটের এই উক্তি, প্রতিদিন মনে হয় আজও সমান সত্য। কিংবা হয়তো বেশি সত্য। চার দিকে ঘটে যাওয়া ব্যাখ্যাতীত ঘটনার সারি জোড় খুলে যাওয়া সময়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
মাস দুয়েক আগের কথা। ১৬ জানুয়ারি। বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে দেখা গেল এক অকল্পনীয় দৃশ্য। আসানসোলের কাছে মিঠানি গ্রামের হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষককে হাওয়াই চটি দিয়ে প্রহার করছেন ক’জন গ্রামবাসী। ওই স্কুলে মেয়েদের ভর্তি করতে এসেছিলেন ওঁরা। অনেকটা সময় অপেক্ষা করার পর জানতে পারেন যে, জন্ম-তারিখের শংসাপত্রটি যথাযথ নয়, ওই দিন ভর্তি হবে না। দুজনেই বাসন মাজার কাজ করেন, স্বামীরা জনমজুর। এক দিন ছুটি নিয়ে এসে এ ভাবে ফিরে যেতে হবে শুনে অসহিষ্ণু হয়ে মেরে বসেন।
অসহিষ্ণুতার এই চেহারা আমাদের জানা। আমরা সকলেই নিজেদের পরিসরে প্রতিদিন নানা অসহিষ্ণুতার সাক্ষী হই, কখনও বা শিকার হই। হয়তো নিজেদের অজ্ঞাতে নিজেরাও অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করি। মনে মনে বোধহয় ধরেই নিয়েছি যে, এ রকমই হবে। এই অসহিষ্ণুতা, অভদ্রতাই স্বাভাবিক। খানিকটা অসাড়ও হয়ে গেছি। তবু হঠাৎ হঠাৎ এক একটা ঘটনা সমস্ত অসাড়তাকে ঝাঁকানি দিয়ে চৈতন্য ফিরিয়ে আনে।
সে দিন ওই দৃশ্যটি দেখে, তার পরে খবরের কাগজে বিশদ বিবরণ পড়ে নতুন করে মনে হল, কী থাকে এমন অসহিষ্ণুতার পিছনে? ভাবতে ভাবতে ঠিক করলাম, অন্তত এই গ্রামটিতে গিয়ে দেখি, শুনি, কেন ওঁরা এমন ভাবে মাস্টারমশাইয়ের ওপর চড়াও হলেন। গেলাম।
মিঠানির পাশে বেজডিহি গ্রামে ওঁদের বাড়িতে যখন যাই, তখন ওই দুই মহিলা সন্ধ্যা বাউড়ি ও তুলসী বাউড়ি, দুজনেই ও ওঁদের স্বামীরা হাজতবাস করে ফিরেছেন। খুব কুণ্ঠিত হয়ে বলেন, ‘কাজটা খুব খারাপ হয়েছে। রাগের মাথায় করেছি। আমরা হেডমাস্টার মশাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইব।’ আর এই ঘটনার কথা তুলতেই প্রধান শিক্ষক বৃন্দাবন পাল বলেন, ‘ওদের কী দোষ? যারা উসকানি দিয়েছে, আমি তো মনে করি দোষ তাদের।’ এই উসকানির প্রশ্নে সন্ধ্যারা কেউ হ্যাঁ বা না কিছুই বলেননি।
বৃন্দাবনবাবুর সঙ্গে মিঠানি হাইস্কুলে কথা বলে স্কুলের বাইরে পা রাখতেই গ্রামবাসীরা দল বেঁধে আসেন কথা বলতে। কেউ স্কুলের প্রাক্তনী, কেউ অভিভাবক, আবার কেউ কোনও ভাবেই স্কুলের সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁরা যা বলেন, তার সার কথা: ১৬ তারিখে যা ঘটেছে, তার জন্য প্রধান শিক্ষকের দীর্ঘ অসহযোগী আচরণই দায়ী। আবার প্রধান শিক্ষক যে-চিত্রটিঁ আঁকেন, তাতে এক অন্য কাহিনি সামনে আসে। ১৯৮৩ সাল থেকে স্কুলটিতে ক্লাস ফাইভ থেকে এইট পর্যন্ত মেয়েদের পঠনপাঠন বন্ধ ছিল। বৃন্দাবনবাবু ২০০৮-এর শেষ দিকে স্কুলে যোগ দিয়ে জানতে পারেন, স্কুলটি কিন্তু সহ-শিক্ষার অনুমোদনপ্রাপ্ত। এবং মেয়েদের যে ফাইভ থেকে ভর্তি নেওয়া হয় না, সেটি কাগজেকলমে লিখিত ভাবে গৃহীত কোনও সিদ্ধান্তপ্রসূত নয়। বৃন্দাবনবাবু স্কুলটিতে পুনরায় মেয়েদের ফাইভ থেকে ভর্তির জন্য দরবার শুরু করেন, অনশনও করেন। ২০১০-এ আবার ফাইভ থেকে মেয়েদের ভর্তি শুরু হয়।
এখন, বোর্ড পরীক্ষার সময় জন্ম-তারিখের যথাযথ প্রমাণ না থাকলে স্কুলকে তার দায়িত্ব নিতে হয়। বয়স নিয়ে গোলমাল হলে তার দায়টা এসে পড়ে স্কুলের ওপর। তাই বৃন্দাবনবাবু জোর দেন, ভর্তির সময় ওই জন্ম-তারিখের প্রমাণ দাখিল করতে হবে। তাতেই নাকি গ্রামবাসীদের অনেকের আপত্তি। তাঁদের বক্তব্য, গ্রামে ও-সব কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকে না, তাই নিয়ে অত কড়াকড়ি করলে চলবে কেন? শুধু তা-ই নয়, স্কুলবাড়ি বানানোর বরাত দেওয়া থেকে কম্পিউটার শিক্ষক নিয়োগ, কম্পিউটারের বরাত দেওয়া দেওয়া সব বিষয়ে গ্রামবাসীরা মাতব্বরি করতে চান। এবং প্রধান শিক্ষকের অভিযোগ, গ্রামবাসীদের এই সব কাজের পিছনে স্থানীয় শাসক দলের রাজনৈতিক কালো হাত আছে। ১৬ তারিখের ঘটনায় প্রথমে যারা তাঁর গায়ে হাত তুলেছিল (ক্যামেরায় নেই), তাদের নামে তিনি এফআইআর করলেও, তাদের বিরুদ্ধে কোনও পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সকলের সঙ্গে কথা বলে একটা কথা মনে হয়েছে আমার। গ্রামবাসীরা এবং প্রধান শিক্ষক, দু’পক্ষই স্কুলের মঙ্গল চান। কিন্তু দু’পক্ষের চাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। এবং সেই ফারাকটা দুর করা যাচ্ছে না, কারণ তার কোনও ব্যবস্থা নেই। মাঝখান থেকে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে শিশুদের, অভিভাবকদের, শিক্ষকদের, সমাজের। এক বারও কেউ ভাবেন না, যে বাচ্চা মেয়েগুলিকে ভর্তি করা নিয়ে এত কাণ্ড, তাদের সামনে এবং আর পাঁচ জন ছাত্রছাত্রীর সামনে তাদের প্রধান শিক্ষককে হেনস্থা করলে তাদের ভিতরে কী প্রতিক্রিয়া হয়! অভিভাবক-শিক্ষক-ছাত্র তিন পক্ষের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক যে লেখাপড়া শেখার জরুরি অঙ্গ, এ কথাটাও মনে থাকে না কারও।
গোটা ব্যবস্থাটাই মনে রাখতে দেয় না। ব্যবস্থা নয়, আসলে এক বিরাট অব্যবস্থা। ঘটনা এই যে, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা আর সমাজব্যবস্থা এখনও পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠেনি। একটা সময় ছিল, যখন গ্রামের শিক্ষানুরাগী জমিদার বা সম্পন্ন মানুষরা স্কুল প্রতিষ্ঠা করতেন। গ্রামবাসীদের সঙ্গে স্কুল পরিচালকদের সম্পর্কটা তখন ছিল সহযোগিতার, হয়তো আনুগত্যেরও। এখন অর্থবান মানুষের জায়গা নিয়েছে রাষ্ট্র। রাজা-প্রজা নয়, সম্পর্কটা এখন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং অধিকারসচেতন নাগরিকের। এই রাষ্ট্রকে নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আসতেই হবে। অথচ এই শৃঙ্খলা এখনও আমাদের সমাজের ধাতে নেই, বস্তুত তার অনুমোদনও পায়নি। জন্ম-তারিখের শংসাপত্রের বিষয়টি তার স্পষ্ট উদাহরণ। জন্ম-তারিখের প্রমাণ থাকাটা আধুনিক রাষ্ট্রের কাছে জরুরি। স্কুল যথাযথ একটি শংসাপত্র দাবি করবে, এটাও তাই স্বাভাবিক। অন্য দিকে, বাস্তবে এখনও অনেক শিশুরই জন্ম হয় বাড়িতে, ফলে যথাযথ জন্ম-তারিখ পাওয়া মুশকিল। বস্তুত, জন্ম হাসপাতালে হলেও অনেক সময় কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকে না, রাখা হয় না, রাখার অভ্যেসটাই এখনও যথেষ্ট তৈরি হয়নি। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমরা একটা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছি।
এবং এখানেই তৈরি হচ্ছে অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। নানা ধরনের দ্বন্দ্ব। যেমন ধরা যাক, সর্বশিক্ষা অভিযানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, বয়সের শংসাপত্রের জন্য কারও স্কুলে পড়া যেন আটকে না থাকে। অন্য দিকে স্কুলের ওপর চাপ থাকছে যে, জন্ম-তারিখের যথেষ্ট প্রমাণ দেখেই যেন তারা ছাত্রছাত্রীর বয়স বিচার করে। আবার এটাও তো ঠিক যে, স্কুলে যদি শংসাপত্র বাধ্যতামূলক হয়, তা হলে হাসপাতালে প্রসব করানোর ব্যাপারে একটা বাড়তি তাগিদ সৃষ্টি হবে। সেটা তো আখেরে ভাল। কিন্তু সেই ভাল’য় পৌঁছনোর রাস্তাটা সমস্যাসঙ্কুল।
পুরনো সমাজ আর আধুনিক রাষ্ট্র তথা অর্থনীতি, দুইয়ের মধ্যে সেতু বাঁধতে পারত রাজনৈতিক দলগুলি, যদি তারা সদর্থক ভূমিকা পালন করতে চাইত! কিন্তু আমাদের দেশে, কী শাসক, কী বিরোধী কোনও দলই সেই ভূমিকায় আগ্রহী নয়। অথচ পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক পরিসরটি অনেক দিন ধরেই চলে গেছে দলীয় রাজনীতির হাতে। গণতান্ত্রিক সহনশীলতার বদলে সেই দলীয় রাজনীতি কেবলই অসহিষ্ণুতার শিক্ষা দিয়েছে। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, মানুষ নিজেকে ছোট করতে করতে হারিয়ে ফেলেছে যাবতীয় বোধ-বুদ্ধি-যুক্তি-সম্পর্ক। তারই উৎকট সব প্রকাশ দেখছি রোজ। কাজটা ভয়ানক অন্যায় জেনেও সন্ধ্যা আর তুলসী চটি নিয়ে প্রধান শিক্ষককে যে ভাবে মারধর করেন, সে কি স্বাভাবিক কোনও মানুষের দ্বারা সম্ভব?
সত্যিই, আশ্চর্য এক জোড় খুলে যাওয়া সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি।