প্রবন্ধ ২

এই বন্দি তোমার নাট্যেশ্বর

নেত্রীর পা চেটে আর্টিক্ল লিখেছি, কাগজ লুফে ছেপেছে। জেলের ভেতর ডাইরি লিখেছি, সেই নেত্রীকেই বাঁশ-দেওয়া, কাগজ তা ছেপে হাল্লাক।ওরে, ব্রাত্য সুমন কৌশিক কী নাটক করে রে? নাটক আমার কাছ থেকে শিখে যা। শম্ভু মিত্তির মহত্‌ মানছি, কিন্তু আমায় অত গলা কাঁপাতে হয় না। এমনকী হপ্তায় তিন দিন করে ঝাড়া দেড় ঘণ্টা স্টেজের ওপর ঘ্যামচ্যাক দেখাব, এই ফর্মটাকেও আছড়ে ভেঙেছি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share:

ওরে, ব্রাত্য সুমন কৌশিক কী নাটক করে রে? নাটক আমার কাছ থেকে শিখে যা। শম্ভু মিত্তির মহত্‌ মানছি, কিন্তু আমায় অত গলা কাঁপাতে হয় না। এমনকী হপ্তায় তিন দিন করে ঝাড়া দেড় ঘণ্টা স্টেজের ওপর ঘ্যামচ্যাক দেখাব, এই ফর্মটাকেও আছড়ে ভেঙেছি। জাস্ট কোর্ট থেকে বেরিয়ে ভ্যানে উঠতে, চকিত ঘাড়ের টার্ন মেরে এক সেকেন্ডে দেড়খানা বাক্য, ব্যস, সারা স্টেট জুড়ে নাটক শুরু। আর কী জমাটি ড্রামা! তাতে তক্ষুনি তড়বড়িয়ে অভিনয় মচাবেন মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে টপ আঁতেল, চায়ের দোকানের সুড়ুত্‌ চুমুক-পার্টি থেকে কেটলিবাহী ছোঁড়া। এমন নাটক থাকবে আমার ওই চুটকি-কথামৃতয়, তা সহস্র নাটককে মুহূর্তে উসকে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। উত্‌পল দত্তর ডেলিভারিতেও এত ঝাঁঝ ছিল না, বাদল সরকার অদ্দিন থার্ড থিয়েটার বাগিয়েও এই ফোর্থ ডাইমেনশন পাকড়াতে পারেননি। কত্ত হাউসফুল কাণ্ড হয়েছে, কেউ বাস্তবকে এ ভাবে দলামোচড়া খাওয়াতে পেরেছে? একটা নাটক মিডিয়াকে শট মেরে, বাসট্রামের আলোচনাকে ক্যাচ লুফে, সমস্ত ভেদাভেদ ভেংচে কেরানি প্রফেসর পকেটমার সবসুদ্ধু নিজের আলখাল্লায় সেঁধিয়ে চরকিপাক লাগিয়ে দিয়েছে?

Advertisement

বাপু, ভাষা সোজা কথা নয়। আমি ভাষার সঙ্গে ভাব, ভাবের সঙ্গে আড়ি, আড়ির সঙ্গে কাঁচাপাকা দাড়িকে এক ঘাটে জল খাওয়াতে পারি, নিমেষে। ঠিক কী ভাবে কথা আর লেখা গোল্লা পাকিয়ে তোদের টাকে ছুড়তে হয়, কখন তার সঙ্গে তিন আউন্স অশ্রু ছিটিয়ে দিলেই ইমোশনের ঝোল টুবুটুবু, কখন দু’পাউন্ড তেতো-হাসি টাঙালে সিনিক-পণ্ডিত হাউড়ে হাঁ, কখন সমঝদারির ভাঁজ গালে টোলালে ‘ভিকট্রি’-র ভি-সাইন নেকলাইন বরাবর পষ্ট— সাধনার ধন। যখন জেলের বাইরে ছিলাম, নেত্রীর পা চেটে জ্বালাময়ী আর্টিক্ল লিখেছি, কাগজ তা লুফে ছেপেছে। এখন জেলের ভেতর ডাইরি লিখেছি, সেই নেত্রীকেই বাঁশ-দেওয়া, কাগজ তা ছেপে হাল্লাক। বাবা, যার খ্যামতা থাকে, তাকে আদুর করেই রাখো আর পুলটিশ দিয়েই ঢাকো, ঠেলে বেরোবেই। শিবির-ফিবির কোনও ব্যাপার না। প্রতিভা ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেললেও গোওওল, আর মোহনবাগানের... না থাক, ওই ক্লাবটার নাম নিয়ে লাভ নেই।

যখন ধরা পড়লাম, ইমেজে কী কালি! চাইনিজ ইংক একেবারে! যারা চোর-জোচ্চোর বলছে না, তারা অবধি খেপে আগুন, ‘শালা, আলু কিনতে পারছি না, এই বাজারে ব্যাটা মাসে পনেরো-ষোলো লাখ মাইনে পায়? মার!’ কিন্তু আমি ঘাবড়াইনি। কারণ, সময় আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। ওকে ইউজ করতে জানতে হয়। ব্যাপারটা ক’দিন থিতিয়ে গেল, আমি ক্ল্যারিনেট ফুঁকে নতুন অবতারের মটুক চড়ালাম। ছিলাম ক্রিমিনাল, হলাম শহিদ। করুণ গলায় কান্না টেনে বলতে লাগলাম, বড় বড় রাঘব-বোয়ালের দাঁতে ফেঁসে গেছি, অসহায় বালক মুই, স্যর, মেধার জোরে টপে উঠেছিনু, কিন্তু টপারুদের চক্রান্ত বুইতে পারিনিকো, তা, আমার এই অবোধপনার জন্যে, এই জন্মসত্‌-ফিল্টার দিয়ে প্যাঁচোয়া পাপ-প্ল্যান গলেনি বলে, অ্যাত্ত নোবেল প্রাইজ বানে ভেসে যাবে? ধম্মাবতার! আর্তনাদ হাঁকড়ে তাকাচ্ছি আদালতের লোকটার দিকে, কিন্তু আসলে মড়াকান্নার সর্ব-ডেসিবেল পৌঁছে যাচ্ছে জনগণের আদালতে, তারা আমার ইমেজ ধোয়া-পাখলা করে তাক-এ সাজিয়ে বলছে, আ ছি! শত ধিক! আমরা এই ফান্দে পড়িয়া কান্দনরত বগাকে অ্যায়সান খিস্তি করলুম গা? আমরা বাঙালি জাতি কি যুগে যুগে বিপন্ন পরাজিত ঝাড়-খাওয়া ভিক্টিমেরই আরাধনা করি না? ব্যস, মায়া-ছলছল রবার মেরে, পাস্টটাকে জাস্ট ‘নেই’ করে দিলাম। আগে কার সঙ্গে কার আলাপ করিয়ে দিয়েছি, কোন সভায় ফিসফিস মেরেছি, ফিল্ম প্রোডিউস করে আর ‘আমি আজ কুইজমাস্টার, পোড়ো মোর বেঙালছানাটি’ হেঁকে কত্ত ফালতু শোর হামলেছি, কোন টেরিফিক কুকীর্তিকে নির্লজ্জ সাপোর্ট করে কী কুরুচিকর নিবন্ধ হাঁকিয়েছি, সব ঢাকা পড়ে গেল। মিডিয়া নেত্রীকে পেড়ে ফেলতে চায়, বিরোধী দল নেত্রীকে বাঁশ দিতে চায়, তারা সব আমাকে মসিহা বানিয়ে মাথায় তুলে নাচতে লাগল। আমার কথা হয়ে উঠল সত্যের জাহাজ, মিথ্যের মুখোশ-ফাঁসানো শার্প সমাজ-শলাকা, আমার যুধিষ্ঠির-যুধিষ্ঠির খেলা থামাতে দুষ্টু লোকেরা হারেরেরে প্র্যাকটিস করল, আমি ন্যায়ের বেদিতে ফিনাইল ড্রপাতে ড্রপাতে ঝেঁকে বললেম, আমি জেলে ঢাকের শব্দ শুনব আর ওরা পুজো উদ্বোধন করবে? ‘আমরা-ওরা’ করে দিলাম। আমি-ওরা। ওরা খারাপ, তার কনট্রাস্টে আমি ভাল। কেন? কারণ আমি আগে ধরা পড়েছি। পয়লা আসামি। তাই আমি সত্‌। বেচারা। বলির পাঁঠা।

Advertisement

টাইম ম্যাগাজিন আমাকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’করল না কেন? গবেট বলে। নইলে স্নোডেন, অ্যাসাঞ্জের কান মুলে আমি তো মেগাস্টার বে। একটা করে নাম বলব, আর সে ভেব্লে ভ্যানিশ! একটা করে টপিক তুুলব, সিআইডি তক্ষুনি সে দিকে কান্নিক। মাধে মাঝে ড্রামা আলুনি হয়ে গেলে কী বাগাব? প্যাথজ! ট্র্যাজেডি! বাঙালি যা খেয়ে খানদানি আমাশা বাধাল! আত্মহত্যা করতে যাব। অনশনে বসব। অবশ্য ঠিক ততগুলো পিল খাব, যা নিরাপদ। তত দিনেই অনশন তুলে নেব, যাতে ডায়েটিংটা ঠিক ঘটে। নিউজেও নামব, লিভারও খোঁচাব না।

বেরিয়ে, প্রথম কাজ: গিনেসের সঙ্গে অক্সফোর্ড-ওয়েবস্টারকেও শোধরানো। জেলের মধ্যে থেকে যে-লোকটা গোটা রাজ্যের পলিটিক্স নির্ধারণ করে, তাকে ডেসক্রাইব করতে নয়া ওয়ার্ড কই? তার পর, স্লাইট গলা খাঁকারি দিয়ে, একটা দলে ঢুকব। পার্টিগুলো উজবুকের মতো হাতের হিরো পায়ে ঠেললে, নিজে পার্টি খুলব। ‘কারাগারের কেষ্ট’ বেস্টসেলার লিখব। তাতেও কল্কে না পেলে? কী আর করা? আভাঁ-গার্দ নাটক নামাব একখান, গোড়াতেই গান: অলীক কুনাট্য রঙ্গে, মজে লোক পশ্চিমবঙ্গে!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement