প্রবন্ধ ১

এই অবিশ্বাস ইতিহাসের উত্তরাধিকার

বাঙালি হিন্দুদের সম্পর্কে একটা দ্বৈত মনোভাব দেখা যায় বাংলাদেশে। রাজনীতির পরিসরে এই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে বার বার। আজও ঘটছে। অশোক মিত্রসাতচল্লিশের ডিসেম্বর। মাত্র মাস চারেক আগে ভারত-ভাগ এবং পাকিস্তান গঠন করা হয়েছে, মহম্মদ আলি জিন্না ক্ষমতায় বসবার পর প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসেছেন। এক সন্ধ্যায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সভাকক্ষে ছাত্রছাত্রী ও অধ্যাপকদের কাছে চোস্ত ইংরেজিতে ভাষণ দিচ্ছিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share:

নেতা। আবুল কাশেম ফজলুল হক। সঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান।

সাতচল্লিশের ডিসেম্বর। মাত্র মাস চারেক আগে ভারত-ভাগ এবং পাকিস্তান গঠন করা হয়েছে, মহম্মদ আলি জিন্না ক্ষমতায় বসবার পর প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসেছেন। এক সন্ধ্যায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সভাকক্ষে ছাত্রছাত্রী ও অধ্যাপকদের কাছে চোস্ত ইংরেজিতে ভাষণ দিচ্ছিলেন। একটা সময় স্পষ্ট উচ্চারণে জানিয়ে দিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং একমাত্র উর্দু। সঙ্গে সঙ্গে সভাকক্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্রদের আর্ত প্রতিবাদী চিত্‌কার: ‘কায়েদ-এ-আজম জিন্দাবাদ, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!’ জিন্না থমকালেন, ক্রুদ্ধ নয়নে চার দিকে তাকালেন, তাঁর মুখাবয়ব রোষায়িত, একটি কথাও না বলে ওখানেই বক্তৃতা থামিয়ে কার্জন হল থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। ছাত্র সম্প্রদায় কিন্তু অদম্য আবেগে চেঁচিয়ে চলেছে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, কায়েদ-এ-আজম জিন্দাবাদ’। কায়েদ-এ-আজম তথা পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আনুগত্যে কোনও দ্বিধা নেই, কিন্তু নবগঠিত রাষ্ট্রের অন্যতম ভাষা হিসেবে তাদের মাতৃভাষা বাংলাকে সরকারি স্বীকৃতি দিতে হবে। উর্দু ভাষা সম্পর্কে তাদের কোনও বিরাগ নেই, কিন্তু বাংলা’কেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গণ্য করে সমান মর্যাদা দেওয়া প্রয়োজন এটা তাদের আবেদন, অনুরোধ, দাবি।

Advertisement

মাতৃভাষা-ভিত্তিক বাংলাদেশি জাতীয়তাবোধের ওই প্রথম বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু এই জাতীয়তাবোধের সূচনার সঙ্গে পূর্ববর্তী দশ বছরের ইতিহাস আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। নতুন ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ১৯৩৭ সালে অভঙ্গ বঙ্গপ্রদেশের নির্বাচনের পর ফজলুল হক তাঁর নিজের দল কৃষক প্রজা পার্টি এবং মুসলিম লিগের সমন্বয়ে সরকার গঠন করলেন। তিনিই প্রধানমন্ত্রী (ভারত শাসন আইনে এই পদবিই বিধিবদ্ধ ছিল)। তিনি চেয়েছিলেন কংগ্রেস দলের সঙ্গে মিলে সরকার গড়তে। মুসলিম লিগের সঙ্গে হাত মেলাতে তাঁর গভীর অনাগ্রহ, সরকার গঠনের জন্য কংগ্রেসের দিকে তিনি হাত বাড়িয়েছিলেন। বিধানসভায় কংগ্রেসের দলীয় নেতা শরত্‌চন্দ্র বসু ইতিবাচক সাড়া দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ফরমান জারি করলেন, কোনও প্রদেশেই কংগ্রেস অন্য কোনও দলের প্রধানমন্ত্রিত্বে কাজ করবে না। ব্যর্থমনোরথ ফজলুল হক মুসলিম লিগের সঙ্গে সরকার গড়তে বাধ্য হলেন, দেশের ইতিহাস সেই মুহূর্ত থেকে আমূল পাল্টে যেতে শুরু করল।

বরিশাল জেলার মাঝারি গোছের ভূস্বামী পরিবারে ফলজুল হকের জন্ম। গণিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিভাবান ছাত্র। হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করে খুব তাড়াতাড়ি পশারও জমালেন। তাঁর বাগ্মিতার ধরনটা একটু অন্য রকম। বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে প্রচুর দেশজ শব্দ ব্যবহার করে, সেই সঙ্গে শ্লেষ জুড়ে এমন জমিয়ে দিতেন যে বিচারপতিরা পর্যন্ত মুগ্ধ। নিজে মাঝারি জমিদার হওয়া সত্ত্বেও নিঃস্ব গরিব চাষিদের মর্মবেদনা উপলব্ধি করতেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জগদ্দল পাষাণে তারা পিষ্ট, জমিদার সম্প্রদায়ের সরকারকে দেয় রাজস্ব হাস্যকর নিচু জায়গায় বাঁধা, অথচ যে কৃষকশ্রেণি হাল টানে, বীজ বোনে, বীজ ছড়ায়, প্রাণপাত পরিশ্রম করে ফসল ফলায়, তাদের উপর জমিদারদের খাজনার বহর বেড়েই চলে। খাজনা দিতে না পারলে জমি থেকে উত্‌খাত। উত্‌খাতের আতঙ্কে কৃষক সম্প্রদায় মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়, ঋণের বোঝা ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। অপরিশোধনীয় ঋণের পাহাড়, দরিদ্র কৃষকদের অনাহারে অপুষ্টিতে দিনাতিপাত। অনুকম্পায়ী ফজলুল হক বুঝেছিলেন, যদিও কৃষককুলের অধিকাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত এবং জমিদারদের অধিকাংশ উচ্চবর্গীয় হিন্দু, সমস্যাটি সম্প্রদায়-ভিত্তিক নয়, শ্রেণিগত। সংগঠিত কৃষক আন্দোলন তখনও আঁতুড়ঘরে। ফজলুল হক ও তাঁর কৃষক প্রজা পার্টি কৃষকদের রক্ষাকর্তা রূপে কিছু কিছু সংস্কার সাধনে বদ্ধপরিকর। মুসলিম লিগে দু’এক জন বিত্তবান মুসলমান জমিদার ছিলেন, তাঁরা কোনও বাধা সৃষ্টি করলেন না। ফজলুল হক আইন করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে খাজনার হারে রাশ টানলেন। এখানেই থামলেন না, আমূল ভূমি সংস্কারের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করলেন। সেই সঙ্গে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রদেশের জনসংখ্যা অনুযায়ী শতকরা চুয়ান্নটি পদ মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণের নির্দেশ দিলেন।

Advertisement

উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্তদের মধ্যে হাহাকার শুরু হল। তখনও বামপন্থী চিন্তার প্রসার ঘটেনি, কংগ্রেস নেতৃত্ব ভূস্বামীসংকুল। শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তদের মধ্যেও সরকারি কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ কমে যাওয়ায় বিক্ষোভ-উত্তেজনা, কংগ্রেস রাতারাতি উগ্র ফজলুল হক-বিরোধী হয়ে উঠল। তাঁকে ঘোর সাম্প্রদায়িক হিসেবে বর্ণনা করে জনসভায় বক্তৃতার পর বক্তৃতা, হিন্দু মালিকানায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকায় দিনের পর দিন আক্রমণ। তিতিবিরক্ত হয়ে তিনি কৃষক প্রজা পার্টির পাট গুটিয়ে সদলবলে মুসলিম লিগে যোগ দিলেন, প্রাদেশিক সরকার পুরোপুরি মুসলিম লিগ সরকারে পরিণত হল। পরবর্তী যে সব ঘটনাবলি, তার ফলেই মুসলিম লিগের অভাবনীয় প্রভাব বিস্তার এবং তার ফলেই ১৯৪৭ সালে দেশভাগ।

ইতিহাস থেকে এখন ফজলুল হকের নাম বিলুপ্ত। কিন্তু তাঁরই উদ্যোগে গৃহীত সংস্কারগুলির পরিণামে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে একটি সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রমশ উদ্ভব, হক-কৃত সংস্কারাদিতে মুসলমানদের জীবিকা ও শিক্ষার সুযোগ বহুগুণ বাড়ল, গরিব কৃষক ঘরের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে শুরু করল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ শহরে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিল, সরকারি কাজে ঢুকল, হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্তদের নানা বাধাদানের মধ্যেও নিজেদের উন্নীত করল, সচেতনতায় একটু একটু করে সমৃদ্ধ হল, বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় সম্পর্কে তাদের শ্রেণিগত সন্দেহ অথচ বাংলা তাদেরও মাতৃভাষা এই দ্বৈততা তারা বহন করে চলেছে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবি তুলে নিজেদের অনেক রক্ত ঝরিয়ে তাঁরা অবশেষে সিকি শতাব্দী বাদে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করতে পারলেন। মুক্তিযুদ্ধের মুহূর্তেও কিন্তু তাঁদের এই দ্বৈত মনোভাব দূর হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ভারতীয় বাঙালি হিন্দুদের সম্পর্কে এই দ্বৈত মানসিকতা অব্যাহত। ভারত সরকার শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামি লিগ এবং পরিবারের প্রতি বরাবর গভীরতর অনুরাগ প্রদর্শন করায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি (বিএনপি) গভীর অসুখী। বিএনপি-র পক্ষ থেকে অনবরত বলা হয় যে, আওয়ামি লিগ ভারত ও হিন্দু-ঘেঁষা। জনসাধারণের বেশ কিছু অংশ এই প্রচারে প্রভাবিত হন। বিভিন্ন সংবেদনশীল সমস্যায় এই বিদ্বেষ ছায়া ফেলে। ফরাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর গঙ্গার জল ভাগাভাগি নিয়ে বিতর্কেও এই অবিশ্বাসের প্রভাব পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্য সরকার তিস্তা নদীর জল ছাড়ার ব্যাপারে কোনও বোঝাপড়ায় আসতে অসম্মত হওয়ায় ভারতবিদ্বেষীদের প্রচারের সুযোগ বর্ধমান।

সন্দেহ ও অনুযোগের পাশাপাশি আছে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্তদের সম্পর্কে এক ধরনের অবজ্ঞা সম্পৃক্ত উন্নাসিকতাও শত চেষ্টা করেও আপনারা আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারেননি। আমরা লড়াই করে পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত করেছি, স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করেছি, আর আপনারা ওই খোট্টাদের চিরকালের গোলাম বনে গেছেন। আপনাদের কলকাতা এখন কেমন পাড়াগেঁয়ে-পাড়াগেঁয়ে ঠেকে। আমাদের ঢাকা দশ গুণ বড়, মস্ত বড় অট্টালিকা-রাজপথে সমাকীর্ণ। কলকাতা বিমানবন্দর টিমটিম করে, ঢাকার বিমানবন্দরে নিরন্তর তিরিশ-চল্লিশটি বিদেশি বিমান সংস্থার বিমান নামাওঠা করছে। আর বাংলা ভাষা তো আমরাই বাংলাদেশে টিকিয়ে রেখেছি, মাতৃভাষার জন্মসূত্র ব্যাকরণ ইত্যাদি নিয়ে যে নিরন্তর গবেষণা আমাদের এখানে চলছে, আপনাদের পশ্চিম বাংলায় তা অকল্পনীয়। রবীন্দ্রনাথকে আমরাই তো আপন করে নিয়েছি, তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আমাদের বাংলাদেশে যে আকুলতা-ব্যাকুলতা, পশ্চিম বাংলায় তার ছিটেফোঁটাও নেই।

এই গোছের মানসিকতা বাংলাদেশে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন দিল্লির রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক ঘেঁষা সরকার, সেই সঙ্গে পশ্চিম বাংলার রাজ্য সরকার কী ভাবে আগামী ভবিষ্যতে নিজেদের পরিচালনা করে, এই মানসিকতা কোন দিকে মোড় নেয়, তার উপর তা অনেকটা নির্ভরশীল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement