ছবি: সুমন চৌধুরী।
আমরা মুগ্ধ, অভিভূত। দেশের ‘দরিদ্র’ জনসাধারণের দুর্দশা নিরসনকল্পে এ বার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এক যুগান্তকারী উল্লম্ফন। গ্রামে গ্রামে গরিবদের এ বার জুটবে পাকা বাড়ি। অবশ্য এটা ঠিক পরিষ্কার নয় যে, গ্রামের মানুষের ঠিক কত শতাংশ জানিয়েছেন, নিজেদের বাড়ি পুকুর উঠোনের বদলে পাকা বাড়িই তাঁদের প্রথম ও প্রধান দাবি। রাজশেখর বসুর লেখা দু’লাইন পদ্য মনে পড়ে: ‘ভাগ্যিস আছিল নদী জগত্সংসারে/ তাই তো লোকে যেতে পারে পয়সা দিয়ে ও পারে।’ দারিদ্রের নৌকায় চড়ে এ দেশের ভাগ্যবিধাতা কান্ডারি সেই স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত কত উন্নয়ন-দরিয়া যে পাড়ি দিলেন! স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাঁর সর্বোত্তম সদিচ্ছা থেকে মনস্থ করেছিলেন ভারতের প্রতিটি গ্রামে নিরাপদ পানীয় জল পৌঁছে দেবেন। স্পষ্টতই, সেই নিরাপদ ছিল তাঁর হ্যারো, ইটন, তিনমূর্তি ভবনের হিসেবে স্থিরীকৃত। তার আগেকার ভারতে গ্রামের সব লোক যে কলেরা হয়ে মারা যাননি, তাঁদেরও নিজেদের স্থানীয় ভিত্তিতে নিরাপত্তা ও বিশুদ্ধতার হিসেব ছিল, সে কথা হয়তো তাঁর মন্ত্রিসভায় কেউই নির্দেশ করেননি। তাঁর নির্দেশিত সেই মহত্ উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টায় নানা দেশের দানে আমাদের গ্রামগুলো আধভাঙা টিউবওয়েলের জাদুঘর, পানীয় জলের পুকুরগুলি ক্রমে ক্রমে ইহলীলা সংবরণ করেছেন। ‘বহতা পানি নির্মলা’ আপ্তবাক্য খ্যাত ছোটনদীরা অন্তর্হিত। ‘নিরাপদ জল’ সেবার দায়িত্বে গ্রামের পর গ্রামে আর্সেনিক ও ফ্লোরাইড বিনি পয়সায় পাওয়া যাচ্ছে। অন্তত পাঁচ হাজার বছর বয়েসি কৃষিসভ্যতার বাহকদের অজ্ঞানতা ও দারিদ্রের কারণে নিজের নিজের অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শস্যবীজ হারিয়ে, রাসায়নিক-নির্ভর কৃষি উত্পাদনের লক্ষ লক্ষ মেট্রিক টন রফতানি করতে করতে আজ এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাড়া খাওয়া জিএম শস্যের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ার জন্য টলমল করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীতে অর্থনীতির মহত্তম আবিষ্কার যদি ‘দারিদ্র’ হয়, তা হলে তার বৃহত্তম প্রয়োগক্ষেত্র হিসেবে ভারতের অবদানও ‘উন্নত’ দেশগুলোর কাছে অপরিসীম।
চাল-জলের ব্যবস্থা হওয়ার পরে দরিদ্র দেশবাসীর দুঃখে কাতর সরকার এ বার মন দিয়েছেন ‘সবার জন্য পাকা বাড়ি’ গড়ে দেওয়ার দিকে। পরিকল্পনাটির বিশেষ অসাধারণত্ব জানা গেল, শহরে ও গ্রামে সর্বত্র একই রকম বাসগৃহ নির্মিত হবে। এ-যাবত্ পৃথিবীর সর্বত্রই স্থানীয় অধিবাসীরা আবহাওয়া, ভূমিরূপ, নিজের পরিবার ও জীবিকার প্রয়োজন অনুযায়ী, নিজেদের অভিজ্ঞতা ও কুশল প্রযুক্তির সাহায্যে আশপাশের সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন রকম বাসগৃহ তৈরি করতেন। অসমে উত্তর বাংলায় কাঠের, গাড়োয়াল কুমায়ুনে চ্যাপ্টা পাথরের টুকরোর ফাটলে মাটি আর ঘাসফুল ঠেসে দিয়ে, গাঙ্গেয় সমভূমিতে পোড়ামাটি, কাদা, বাঁশ, খড়, সুন্দরবনে বাঁখারি ও গোলপাতা, বাঁকুড়া বীরভূম পুরুলিয়ায় শতবর্ষস্থায়ী কাঁকুড়ে মাটির দোতলা বাড়ি শুধু ব্যবহৃত উপাদানের ভিন্নতা নয়, গঠনশৈলী থেকে ব্যবহারবিধি, প্রতিটি ক্ষেত্রেই থেকেছে বসবাসকারী সমাজের প্রয়োজনানুগ ভিন্নতা। এবং সর্বত্রই এই ভিন্নতার একটি প্রধান নির্ণায়ক স্থানীয় ভাবে প্রাপ্ত উপাদানের বৈচিত্র। এই ভিন্নতাগুলি তৈরি হয়েছে বহু কাল ধরে, অল্পে অল্পে। ক্রমে ক্রমে তা সেই সমাজ সংস্কৃতির জরুরি এবং অত্যাগসহন অংশ হয়ে উঠেছে। যাকে পরিবার বলে, যা সাধারণ ভাবে মানুষের জীবনধারণের আধার, তা এই বাসগৃহগুলিতেই স্থিত থাকে। নিজস্ব গৃহ থেকে বিচ্যুত জনসমষ্টি তার সুস্থ, ব্যবস্থিত অস্তিত্বের অত্যন্ত জরুরি একটি অংশ হারিয়ে ফেলে। ক্রমশ ‘আসন থেকে বড়ো, নবতর সিংহাসনে’ যেতে উত্সুক নাগরিক জনগোষ্ঠীর কাছে হয়তো গ্রাম বা আদিবাসী অঞ্চলের জীবনযাপন সংস্কৃতি বোঝা একটু কঠিন হতে পারে।
গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে এক ব্রিটিশ স্থপতি এ দেশে এসে এক বৃদ্ধ দার্শনিককে বলেছিলেন, ‘আমি আপনার আন্দোলনে যোগ দিতে চাই।’ বৃদ্ধ, তাঁর নাম মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, সেই স্থপতিকে বলেন, ‘আপনি যে কাজটি জানেন, সেটিই মন দিয়ে করুন।’ আর তা-ই করেছিলেন লরি বেকার। কেরলে, মধ্যপ্রদেশে, অন্ধ্রপ্রদেশে স্থানীয় উপাদান দিয়ে, স্থানীয় জীবনযাপনের উপযোগী এমন সব বাড়ি তৈরি করেছিলেন, যার উপযোগিতা আর সৌন্দর্যের কথা লোকের আজও আলাদা করে মনে আছে।
এই পৃথিবীতে, প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি জিনিসই ভিন্ন ভিন্ন রকম, এমনকী এক জাতের হলেও। প্রতিটি নিমগাছ একে অন্যের থেকে আলাদা, প্রত্যেক বাঘের গায়ের ডোরা পর্যন্ত ভিন্ন। মানুষ যখন শিশু থাকে, নিজের পরিপার্শ্ব সম্পর্কে তাদের প্রত্যেকের আগ্রহ ও বোঝার ধরন আলাদা। এই ভিন্নতা বা বৈচিত্র শুধু স্বাভাবিক নয়, এতেই একটি প্রজাতির প্রাকৃতিক সুরক্ষা। কোনও একটি বিশেষ ধরনের পোকা বা ছত্রাকের আক্রমণে প্রাকৃতিক জঙ্গল কখনও ধ্বংস হয়ে যায় না। একটি কোনও বিশেষ সংক্রমণে অরণ্যের সমস্ত পশু মারা যাওয়ার খবরও শোনা যায়নি। স্বাভাবিক বৈচিত্রেই প্রকৃতির সুরক্ষা। এবং সুস্থিতিও। সেই নিয়মকে অগ্রাহ্য করে এই সারা দেশে এক রকম ইউনিফর্ম-পরা বাড়ির, গরিব লোকের বাড়ির পরিকল্পনাটি নানা দিক থেকেই অসাধারণ, সন্দেহ নেই। সুন্দরবনের এক পাগলা ডাক্তারের কথা মনে পড়ল। সুন্দরবনের পরিবেশ সমস্যা ইত্যাদি বিষয়ের এক সভায় তিনি বিরক্ত ভাবে বলেছিলেন, ‘পরিবেশের কী যে আপনারা করবেন, জানি না। অন্তত এখানকার লোকগুলোকে ওই এক ইটের দেওয়াল আর করোগেটেড ছাদওয়ালা পাকাবাড়ি থেকে যদি রক্ষা করতে পারেন! তাঁর ক্ষোভের কারণ ছিল। সুন্দরবনের নোনা জলমাটি, গুমোট আর তীব্র রোদ মিলে ওই ‘আধুনিক শহুরে’ পাকা বাড়ির বাসিন্দারা আবালবনিতা গ্রীষ্মের শুরু থেকে প্রবল ঘামাচিতে ভোগেন। অপরিষ্কার হাতে সেগুলো চুলকানোর ফলে সংক্রমণ হয়ে বিশ্রী ঘা হয়ে যায়, সেগুলো গ্রীষ্ম ও বর্ষার দীর্ঘ কাল ধরে দস্তুরমত এক স্বাস্থ্যসমস্যা তৈরি করে রাখে। জানাই কথা যে দেশব্যাপী গরিবদের বাড়ি মোটামুটি সে-রকমই হবে, যেমন এত দিন আমরা নানা রকমের ‘পুনর্বাসন’ বা ‘আবাস যোজনা’র বাড়ি দেখে এসেছি।
সব বৃহত্ পরিকল্পনাই তো গরিব লোকদের ‘উন্নয়ন’-এর জন্য গৃহীত হয়। কিন্তু সেই ‘লোক’রা, যাঁরা এই বিশাল দেশের পাহাড়চূড়ায় ছোট ছোট পশুপালক গ্রামে, মরুভূমির গভীরে, ঘন জঙ্গলের ধারে কিংবা ফসলখেত ঘেঁসে বাস করেন, তাঁদের মতামত কি সত্যি কখনও নেওয়া হয় যত্ন করে? শ্রদ্ধার সঙ্গে? নদীতে বন্যা হয় বলে নদীদের জন্য যে-সব সুবিধেজনক জল জমানোর ভাঁড়ার তৈরি হয়েছিল, যে-সব বাঁধের জন্য আজ দেশময় নদীগুলো মৃত্যুপথযাত্রী, সেই পরিকল্পনা নেওয়ার সময় কি কখনও জানতে চাওয়া হয়েছিল, প্রকৃতই যাঁদের জীবনযাপন নদীর সঙ্গে সম্পর্কিত, নদীর ধারে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের মতামত? আজ যে ভাবে অর্ধসত্য ও মিথ্যা মিলিয়ে-মিশিয়ে সভা ডেকে ‘জনসম্মতি’ নেওয়া হয়, সে ভাবে নয়, বাস্তবে? না কি, সদিচ্ছা থাকে উন্নতি করে দেওয়ার, কিন্তু যাদের উন্নয়ন হবে তাদের প্রয়োজন জেনে নিয়ে নয়, ‘আমি যা ভাল মনে করি সেটাতেই তোমার উন্নতি’ এই চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক এক ক্ষমতাকাঠামো আসলে কনস্ট্রাকশন লবি, মাইনিং লবি ছাড়া অন্য ‘লোক’দের ‘ভাল’ বিষয়ে বাস্তবে কোনও ধারণাই রাখে না? নদী জোড়া থেকে বাড়ি গড়া, সব পরিকল্পনাই তাই এ-রকম অদ্ভুত, অসম্ভাব্য, উদ্ভট হয়ে দাঁড়ায়? আর সেই সব পরিকল্পনার পিছনে ছোটে যে ‘উন্নয়ন’, তা ডেকে নিয়ে আসে ধ্বংসের পরম্পরা? ইতিমধ্যেই টিহরির বাঁধের কাছে ধস নেমে প্রাণহানি হয়েছে, কোশি নদীর উজানে নেপালের সিন্ধুপারচক-এ আকস্মিক প্লাবনে একশোর কাছাকাছি মৃত, পুণের কাছে অ্যাম্বি ভ্যালিতেও ধসে মৃত্যুর খবর এসেছে। এই ‘উন্নয়ন’কে কি সিরিয়াল কিলার বলা যায়?
হিসাবে বলা হয়েছে, দেশময় দু’কোটি পঁচিশ লক্ষ পাকা বাড়ির উন্নয়ন ছড়িয়ে পড়বে। অনেকে বলছেন, এটা হবে না। কিন্তু আমরা অবিশ্বাসী নই। এই পরিকল্পনায় এক অনন্ত সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। ওই সব ‘এক রকম পাকা বাড়ি’ নির্মাণের জন্য যে পাথর সিমেন্ট লোহা লাগবে, তার জন্য অবশিষ্ট পাহাড় ও জঙ্গল কেটে খনি তৈরি করতেই হবে, বিদ্যুত্ তৈরির জন্য তৈরি করতে হবে পরমাণু চুল্লি, জল জোগাবার জন্য পাতালের শেষ জলভাণ্ডারও তুলে ফেলা হবে, আর তার ফলে তৈরি হতে থাকবে আরও কোটি কোটি নিরাশ্রয় জীবিকাহীন গরিব। তাদের জন্যও লাগবে আরও পাকা বাড়ি, আরও নির্মাণ, আরও সিমেন্ট, আরও খনি। জয় হোক শিল্পোন্নত নবভারতের।