ধ্রু পদী সংগীতের নামজাদা শিল্পী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নাকি জানিতে চাহিয়াছিলেন, ওস্তাদ শুনিলাম ভাল গান করেন, কিন্তু থামেন তো? বাঙালির দুর্গোৎসব দেখিলে তিনি চমৎকৃত হইতেন। বস্তুত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সম্বন্ধে লিখিতে বসিয়া তিনি যে কথাটি বলিয়াছিলেন, এই উৎসব বিষয়ে তাহা ভিন্ন অর্থে সত্য। তিনি লিখিয়াছিলেন, আমরা বাঙালিরা আরম্ভ করি, শেষ করি না। অর্থাৎ আমরা কাজ অসমাপ্ত রাখিয়া দিই। শতাব্দী পালটাইয়াছে, বাঙালির সেই অভ্যাস ঘুচে নাই। কিন্তু তাহার শারদোৎসব অন্য অর্থে শেষ হয় না, উৎসবের নির্ধারিত কাল সমাপ্ত হইবার পরেও তাহা চলিতেই থাকে। অবশ্য মানিতেই হইবে, একটি বিষয়ে অতীতের তুলনায় এ কালে তাহার আচরণে উন্নতি ঘটিয়াছে। প্রতিমা বিসর্জন না দিয়া দিনের পর দিন মণ্ডপে সাজাইয়া রাখিবার রীতি অধুনা অপ্রচলিত, নিরঞ্জনের আয়োজনে শৃঙ্খলা আসিয়াছে। কিন্তু উৎসবের রেশ টানিয়া চলিবার মানসিকতা দূর হইয়াছে, এমন কথা বলিবার কোনও উপায় নাই। ছুটি ফুরাইলেও বাঙালি কাজে ফিরিতে চাহে না, ফিরিলেও কাজে মন দিতে চাহে না, উৎসবের মরসুম যত দিন টানিয়া টানিয়া বাড়ানো যায়, ততই তাহার আহ্লাদ।
মধ্যবিত্ত নাগরিক বাঙালির কাজে ফিরিবার উৎসাহ কম, তাহার েকটি বড় কারণ সম্ভবত ইহাই যে, সে কাজ ভালবাসে না। করিতে হয়, করে, কিন্তু কাজ হইতে তাহার আনন্দ নাই। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু তাহা ব্যতিক্রম। এই স্বভাবের পিছনে কোনও প্রাকৃতিক কারণ খুঁজিবার প্রয়োজন নাই, যুক্তিও নাই, ইহা ইতিহাসের দান। মধ্যবিত্ত বাঙালি ঐতিহাসিক ভাবে চাকুরিজীবী, এবং সেই চাকুরি চরিত্রে করণিকের। সেই কাজ স্বভাবত পরনির্ভরশীল, সেখানে কাজের উৎসাহকে পুরস্কার দিবার কোনও পদ্ধতিগত ব্যবস্থা নাই, আবার কাজে ফাঁকি দিলেও শাস্তির ভয় নাই। কিন্তু গভীরতর সত্য হইল, সেই কাজে কর্মীর নিজস্ব কোনও সক্রিয় ভূমিকা নাই, সে এক বিশাল এবং বহুস্তরীয় যন্ত্রের নাটবল্টুমাত্র। বিশেষত, ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্রে সেই কাজের উদ্ভব ও দীর্ঘ বিকাশ, ফলে বাঙালি ভদ্রলোক প্রজন্ম হইতে প্রজন্মান্তরে স্বক্ষমতা-রহিত কাজের ঘানি টানিতে অভ্যস্ত হইয়াছে। নিজস্ব উদ্যোগে কিছু করিবার রীতি বঙ্গীয় নাগরিক সমাজে বিরল।
ইতিহাস দাঁড়াইয়া থাকে না। কালচক্রে করণিকবৃত্তির মহিমা গিয়াছে, ক্রমে বৃত্তিটিই বিলীয়মান। তরুণ প্রজন্মের বঙ্গসন্তান অন্য নানা ধরনের কাজে ব্রতী হইয়াছে, না দিয়া তাহার উপায় নাই। কিন্তু সেই কাজও সচরাচর নিজের কাজ নয়, অন্য কাহারও না কাহারও নির্দেশে তাহা সম্পাদন করিতে হয়। সেই কাজের চাপ প্রবল, কেবলমাত্র টিকিয়া থাকিবার জন্য তাহাকে প্রভূত পরিশ্রম করিতে হয়। এই নব্য বাঙালি অবশ্যই তাহার পূর্বপ্রজন্মের মতো অবকাশরঞ্জনে কালহরণ করিতে পারে না, সেই বিলাসিতার সুযোগ তাহার নাই। কিন্তু কাজের আনন্দে কাজ করিবার সৌভাগ্য তাহারও নাই, সে-ও নিজের মতো করিয়া ঘানি টানিতেছে। রবীন্দ্রনাথ প্রতি দিনের কাজে যে উৎসব পালনের কথা বলিতেন, তাহার সুযোগ এই দুনিয়ায় নাই। তাহার একটি ফল হইয়াছে ইহাই যে, উৎসবও আপন সুস্থ স্বাভাবিক সংযত রূপটি বহুলাংশে হারাইয়াছে। বাঙালির উৎসবে আনন্দ কম, উল্লাস বেশি। ফলে উৎসব শেষে নূতন প্রাণে উজ্জীবিত না হইয়া নাগরিক এখন ক্লান্ত। উৎসব-ক্লান্ত।