প্রবন্ধ ১

উপাচার্যের কী লাভ হল, জানি না

এ আন্দোলন সারা রাজ্যের ছাত্রদের আন্দোলন হয়ে উঠল। গণতান্ত্রিক সব মানুষ এর পাশে দাঁড়াবেন। অভিজিত্‌বাবু নিজ হাতে তার ভিত গড়ে দিলেন। লিখছেন অসীম চট্টোপাধ্যায়।যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসেব করে রাতের অন্ধকারে আলো নিভিয়ে যে ভাবে পুলিশ দিয়ে ছাত্র পেটানো হল, ছাত্রীদের হেনস্থা করা হল, তাতে রাজ্যবাসী হতবাক। গ্রেফতার হয়েছেন ৩৫ জন ছাত্র, আহত ৭ জন, ২ জনের আঘাত গুরুতর। আমার মনে পড়ছে ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ঘটনা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share:

গণ আন্দোলন। কলকাতার রাজপথে। ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসেব করে রাতের অন্ধকারে আলো নিভিয়ে যে ভাবে পুলিশ দিয়ে ছাত্র পেটানো হল, ছাত্রীদের হেনস্থা করা হল, তাতে রাজ্যবাসী হতবাক। গ্রেফতার হয়েছেন ৩৫ জন ছাত্র, আহত ৭ জন, ২ জনের আঘাত গুরুতর। আমার মনে পড়ছে ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ঘটনা। সেখানেও অধ্যক্ষকে ঘেরাও মুক্ত করার জন্য পুলিশ নামে। গ্রেফতার হন ৩৯ জন। পুলিশি হামলা প্রতিরোধ করতে গিয়ে আহত হন ২ জন ইউনিয়ন সম্পাদক অমল সান্যাল এবং বিমান বসু। তবে সেখানে এত প্যাঁচপয়জার ছিল না। অধ্যক্ষ প্রাণসংশয়ের দাবি করেননি, আলো নিভিয়ে দেওয়ার গল্প ছিল না, ছাত্ররাই পুলিশকে মেরেছে, এমন অবাস্তব দাবি ছিল না। তবে এই ঘটনার জেরে প্রেসিডেন্সি বন্ধ থাকে তিন মাস, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা রাজ্যের সব কলেজ বন্ধ থাকে দেড় মাস। পুলিশ দিয়ে ছাত্র পেটানো রাজ্যের ছাত্রসমাজ, এমনকী রাজ্যবাসীও বরদাস্ত করেন না।

Advertisement

উপাচার্য অভিজিত্‌বাবু তাঁর প্রাণসংশয়ের কথা বলেছেন। তালাবন্ধ দুটো গেটের নিরাপদ দূরত্বে থেকে কী ভাবে যে তাঁর প্রাণসংশয় হতে পারে, তা বোঝা দায়। তাঁর দাবি হল, তিনি ছাত্রদের পুলিশকে লাঠিপেটা করতে দেখেছেন, আলো ভাঙতে দেখেছেন, ছাত্রদের ইট-পাথর ছুড়তে দেখেছেন। অথচ, সতত অতন্দ্র মিডিয়ার চোখে এ সব কিছুই ধরা পড়েনি। স্পষ্টতই, অভিজিত্‌বাবুর আচরণ উপাচার্যসুলভ, শিক্ষাবিদসুলভ নয়, তিনি নিষ্ঠাবান দলীয় কর্মীর ভূমিকা নিয়েছেন। তিনি ছাত্রদের তো বটেই, নিজের সহকর্মীদের চোখেও সম্মান হারিয়েছেন। ঘটনা হল, নিজের কর্তৃত্ব আরোপ করার তাগিদে তিনি ছাত্রদের ‘সবক’ শেখাবার জন্য পুলিশকে কাজে লাগিয়েছেন।

আমাদের শিক্ষাবিদদের মুশকিল এখানেই। শিক্ষায়তনে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করাকে তাঁরা অনেকেই আবশ্যিক ভাবেন। অথচ প্রতিষ্ঠিত সত্য হল, ‘ক্যাম্পাস ডিসিপ্লিন’ দাবি করে ‘ক্যাম্পাস ডেমোক্র্যাসি’। আমাদের ছাত্ররা আবেগপ্রবণ, আবেগের বশে অনেক সময় দায়িত্বহীন কাজ তাঁরা করে বসেন। কিন্তু তাঁরা স্বভাবগত ভাবে সরল। তাই ধৈর্য ধরে বোঝালে তাঁরা শেষে সহজ সত্য গ্রহণ করেন, বলপ্রয়োগে বিপরীত ফল হয়। স্পষ্টত, অভিজিত্‌বাবু এই চিন্তার শরিক নন। তাই পুলিশি বলপ্রয়োগ দিয়ে তিনি ছাত্রদের ‘শিক্ষা’ দেওয়ার পথ নিয়েছেন।

Advertisement

এর কোনও প্রয়োজন ছিল না। ছাত্রদের দাবি ছিল ছাত্রীনিগ্রহের নিরপেক্ষ তদন্তের, হাত-ধরা লোক দিয়ে লোক-দেখানো তদন্তের বদলে সত্য উন্মোচনের জন্য প্রয়োজনীয় তদন্তের। তাঁরা ছাত্রদের দিয়ে তদন্ত করানোর দাবি তোলেননি। তাঁদের দাবি ছিল, নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে এক জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, এক জন মানবাধিকার কর্মী ও যেহেতু এটা শ্লীলতাহানির অভিযোগ, তাই এক জন ‘জেন্ডার অ্যাক্টিভিস্ট’কে তদন্ত কমিটিতে যুক্ত করার। যে কোনও দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক মানুষই এই দাবি মেনে নিতেন। অথচ এটাকেই ‘সম্মানের প্রশ্ন’ করে অভিজিত্‌বাবু ছাত্রদের ‘শিক্ষা’ দিতে নেমে পড়লেন!

এতে তাঁর যে কী লাভ হল, আমার জানা নেই। পুলিশি নিগ্রহের ফলে এই আন্দোলন আর শুধু যাদবপুরের ছাত্রদের আন্দোলন থাকল না, বরং তা সারা রাজ্যের ছাত্রদের আন্দোলন হয়ে উঠল। এবং রাজ্যের গণতান্ত্রিক সকল মানুষজনই এর পাশে এসে দাঁড়াবেন। সেই ভিত্তি অভিজিত্‌বাবু নিজ হাতে গড়ে দিলেন।

ঘটনার দিন এই ঘটনাকে আমি রাজ্যে বর্তমান জমানার ‘শেষের শুরু’ বলায় অনেকে ‘আগ বাড়িয়ে বলা’র দোষে অভিযুক্ত করেছেন। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষায় এই বক্তব্য মোটেও অতিকথন দোষ দুষ্ট বলা যাবে না। ১৯৬৬ সালে যে প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাত্র আন্দোলনের কথা বলেছি, পরবর্তী কালে তত্‌কালীন কংগ্রেস সরকারের পতনের ও নতুন সরকার পত্তনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। সে দিক দিয়ে সে আন্দোলন ছিল তত্‌কালীন কংগ্রেস জমানার শেষের শুরু। শাসকের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে যাদবপুরের ছাত্ররা যে বিদ্রোহ করেছেন এবং যার ফলে সমাজের সর্বস্তরে ‘অবাধ্যতার ঢেউ’ ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন, তাতে যাদবপুর-কাণ্ডকে পালাবদলের অগ্রদূত ভাবা অযৌক্তিক নয়। তবে শেষ কথা বলবে ইতিহাসই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement