মন্ত্রীরা সাফ কথা বলিলে দেশের দশের ভাল। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সাফ কথা বলিয়াছেন। তাঁহার বক্তব্য: জমি অধিগ্রহণ অর্ডিনান্সের বিধান প্রয়োগে যে সব রাজ্যের শাসক দলের আপত্তি আছে, তাহারা এই অর্ডিনান্সের সুযোগ না-ই লইতে পারেন, কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পক্ষে সেই সিদ্ধান্তের পরিণাম কী, তাহা ইতিহাসই বলিয়া দিবে। অর্থাত্, যে রাজ্য এই নববিধানের সুযোগ লইয়া প্রয়োজনমাফিক জমি অধিগ্রহণের পথে চলিবে, তাহারা উন্নয়নের পথে অগ্রসর হইবে এবং যাহারা সে পথে চলিবে না তাহারা পশ্চাতে পড়িয়া থাকিবে। ইহাই সত্য। অর্ডিনান্সের মূল লক্ষ্য দুইটি: এক, গুরুত্বপূর্ণ শিল্প, পরিকাঠামো এবং সামাজিক পরিষেবার প্রয়োজনে জমি সংগ্রহের পথ সহজ করিয়া দেওয়া; দুই, অধিগৃহীত জমির জন্য যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিপূরণ দেওয়া। ক্ষতিপূরণের পরিধি এবং পরিমাণ লইয়া সর্বদাই বিতর্ক চলিতে পারে, কিন্তু মূল লক্ষ্য দুইটি লইয়া আপত্তির কোনও সংগত কারণ নাই। তবু আপত্তি উঠিয়াছে। কংগ্রেস বা তৃণমূল কংগ্রেসের মতো বিরোধীরা আপত্তি তুলিয়াছে। কংগ্রেসের আপত্তির পিছনে এক দিকে ‘ঝোলাওয়ালা’ গোষ্ঠীর প্রভাব, অন্য দিকে জমি সংগ্রহের প্রশ্নে ইউপিএ সরকারের দীর্ঘ ব্যর্থতার ইতিহাস আমরা যাহা পারি নাই তোমরা তাহা পারিবে কেন, এই মনোভাব ভারতীয় রাজনীতিতে সুপরিচিত। আর তৃণমূল কংগ্রেসের আপত্তির পিছনে তাহার সর্বাধিনায়িকার জুরাসিক যুগের উপযোগী মানসিকতা এবং সম্পূর্ণ অবিচল জেদ— জোর করিয়া জমি লওয়া চলিবে না।
এই জেদ আত্মঘাতী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ‘জমি লওয়া চলিবে না’ রাজনীতির পিঠে সওয়ার হইয়া ক্ষমতায় আসিয়াছেন বলিয়াই তাঁহার বিশেষ করিয়া জানা উচিত, ইহা রাজ্যের উন্নয়নের পক্ষে ক্ষতিকর একটি অবস্থান। তাঁহার রাজনৈতিক সাফল্যের মূল্য কেবল বামফ্রন্ট সরকারকে গনিতে হয় নাই, আরও অনেক বড় মূল্য দিতে হইয়াছে পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটিকে: ন্যানো কারখানার সিঙ্গুর হইতে সানন্দ গমন সেই ক্ষতির প্রতীক। গত তিন বছরে রাজ্য শাসনের সুবাদে তিনি ক্রমশ বুঝিয়াছেন যে, জেদ আঁকড়াইয়া বসিয়া থাকিলে তাঁহার রাজ্যে শিল্প আসিবে না। শিল্পোদ্যোগীরা তাহা জানাইয়াও দিয়াছেন, আদি গোদরেজের মতো কেহ কেহ রীতিমত সুস্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছেন। মুখ্যমন্ত্রী কিছু কিছু ক্ষেত্রে নানাবিধ জটিল পথে জমি সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু তাহাতে লাভ হয় নাই। হইবারও নহে, চালাকির দ্বারা শিল্পায়ন হয় না। তাঁহাকে জেদ ছাড়িতে হইবে, স্পষ্ট কথা স্পষ্ট ভাবে বলিতে হইবে: উন্নয়নের প্রয়োজনে জোর করিয়া জমি লইতে হইলে জোর করিব। কেন্দ্রীয় অর্ডিনান্স এই অবস্থান গ্রহণের পথ পরিষ্কার করিয়া দিয়াছে। ইহা রাজ্যের সুযোগ।
যুক্তরাষ্ট্রীয় সুযোগ। নেহরু প্রবর্তিত রাষ্ট্রবাদী উন্নয়নের যুগে বিভিন্ন রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকার এবং তাহার অধুনালুপ্ত মহাশক্তিমান যোজনা কমিশনের নিকট দরবার করিয়া আপন সম্পদের ভাগ বাড়াইবার চেষ্টা করিত, যাহারা পারিত না তাহারা ‘কেন্দ্রীয় বঞ্চনা’র সত্য ও অতিরঞ্জিত অভিযোগে ময়দান কাঁপাইয়া ভোট সংগ্রহের চেষ্টা চালাইত। নব্বইয়ের দশকে আর্থিক সংস্কারের তাড়নায় সেই ছবি বদলাইয়া যায়, রাজ্যগুলি বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রতিযোগিতায় নামিতে বাধ্য হয়। জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নটি সেই প্রতিযোগিতারই অঙ্গ। যে রাজ্য যত দক্ষ ভাবে এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারিবে, সেখানে শিল্প এবং পরিকাঠামোর উন্নয়ন তত দ্রুত হইবে, যে রাজ্যে একটি বিদ্যুত্ কেন্দ্রের সাব-স্টেশন বসাইতে বা এক ফালি হাইওয়ে চওড়া করিতেও প্রয়োজনীয় জমি লইতে গেলে প্রবল বাধা আসে, সেখানে উন্নয়নের কথা ভাবিয়া লাভ কী?