ইউ পি এ’র দ্বিতীয় দফায় অর্থনীতির হাল নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। আলোচনার প্রথম এবং প্রধান বিষয় স্বভাবতই আয়বৃদ্ধি। প্রথম ইউ পি এ সরকার কাজ শুরু করার ঠিক আগে, ২০০৩-০৪ সালে ভারতে প্রকৃত জিডিপি’র বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল ৮ শতাংশ। ২০০৫-০৬ থেকে ২০০৭-০৮, এই তিন বছরে সেই হার ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এখন, ২০১৩-১৪ সালে আয়বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৪.৯ শতাংশ। ইউ পি এ’র চালক ও সমর্থকরা সব সময় দশ বছরের পরিসংখ্যান একসঙ্গে দেখান। তার ফলে এই কথাটা ঢাকা পড়ে যায় যে, প্রথম ইউ পি এ সরকার গোড়ায় তার পূর্ববর্তী এন ডি এ জমানার ভাল কাজের সুফল কুড়িয়েছিল। তার পর এই শাসকগোষ্ঠী নীতি নির্ধারণে ও তার রূপায়ণে ভুলভাল করতে থাকে এবং তার ফলে আয়বৃদ্ধি ধাক্কা খায়।
ইউ পি এ’র যুক্তি হল, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সমস্যা এই ধাক্কার একটা বড় কারণ। এই যুক্তি নিয়ে কতকগুলো সমস্যা আছে। এক, ২০১২-১৩ থেকে আয়বৃদ্ধি গতিভঙ্গের জন্য যদি বিশ্ব অর্থনীতি দায়ী হয় এবং সরকারের কোনও দায় না থাকে, তবে ২০০৫-০৬ থেকে ২০০৭-০৮’র ভাল আয়বৃদ্ধির কৃতিত্বও সেই সময়ের বিশ্ব অর্থনীতিকেই দেওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্কটের পরেও ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১’য় ভারতে আয়বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৮.৫ এবং ৯ শতাংশ। ব্যর্থতার দায়টা সুবিধে মতো বিশ্ব অর্থনীতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া তো ঠিক নয়। তৃতীয়ত, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্কটের কথা নিশ্চয়ই সরকারি কর্তাদের অজানা ছিল না, তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান, অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মণ্ডলীর চেয়ারম্যান, সবাই আয়বৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি অনুমান করতে এমন ভুল করলেন কেন?
আয়বৃদ্ধি মার খেয়েছে, তার আসল কারণ হল, সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের হার কমেছে। ২০০৪-০৫ সালে বিনিয়োগ ছিল জিডিপি’র ৩৩ শতাংশ, ২০০৭-০৮’এ সেটা দাঁড়ায় ৩৮ শতাংশ। ২০১৩-১৪ সালে অনুপাতটা নেমে এসেছে ৩৫ শতাংশে। এর প্রধান কারণ হল, দ্বিতীয় দফায় ইউ পি এ সরকার দেশের বিনিয়োগের পরিবেশ নষ্ট করে দিয়েছে। কথাটা এখন বহুচর্চিত, পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতাও কমেছে। ২০০৭-০৮’এর হিসেব নিলে দেখা যাবে, বিনিয়োগ এবং উৎপাদনের অনুপাত ছিল ৪.০৯। অর্থাৎ, মোটামুটি (জিডিপি’র অনুপাতে) ৪ শতাংশ বিনিয়োগের জন্য এক শতাংশ আয়বৃদ্ধি ঘটেছিল। এই হার বজায় থাকলে ২০১৩-১৪’য় ৩৫ শতাংশ বিনিয়োগ থেকেও ৮.৬ শতাংশ আয়বৃদ্ধি হওয়ার কথা। হয়েছে ৪.৯ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী চিদম্বরম তাঁর অন্তর্বর্তী বাজেট ভাষণে অঙ্কটা বলেননি, কিন্তু কার্যত এই সত্যটি মেনে নিয়েছেন। বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা, দুইই সরকারের অকর্মণ্যতার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকার অনেক বার বড় মুখ করে বলেছে যে, যে সব প্রকল্প আটকে আছে সেগুলি সচল করতে মন্ত্রিসভার বিনিয়োগ বিষয়ক কমিটি তৎপর হবে। কিছুই হয়নি। এর ফলে ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের বোঝাও বেড়েছে, সেটাও লগ্নির ক্ষতি করেছে। এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে যে পরিমাণ সম্পদ সরকারি কোষাগার থেকে দিতে হবে, সেটা জাতীয় আয়ের প্রায় ২ শতাংশের সমান।
আয়বৃদ্ধি নিছক একটা সংখ্যা নয়। আয়বৃদ্ধি দ্রুত হলে কর্মসংস্থান বাড়ে, দারিদ্র কমে। ‘কর্মসংস্থান’ এবং ‘বেকারত্ব’-এর সংজ্ঞা নিয়ে তর্ক আছে। কিন্তু সে তর্কে না গিয়ে একটা সহজ হিসেব দেখা যেতে পারে। ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৪-০৫ পর্যন্ত ভারতে বছরে গড়পড়তা ৭৮ লাখ নতুন কাজ তৈরি হয়েছিল, আর ২০০৫-০৬ থেকে ২০১১-১২ পর্যন্ত বছরে তৈরি হয়েছে গড়ে ২৬ লাখ কাজ, তিন ভাগের এক ভাগ। শিল্প উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়লে কর্মসংস্থান হবে কোথা থেকে? মনে রাখতে হবে, এ দেশে এখন বছরে অন্তত এক কোটি কুড়ি লাখ কাজ তৈরি হওয়া জরুরি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও ইউ পি এ ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৪-০৫ সালে ভোগ্যপণ্যের বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৩.৯ শতাংশ, ২০১৩-১৪ সালে সে হার দাঁড়িয়েছে ৯.৬ শতাংশ। এটা ঠিকই যে, বাজারদর নিয়ন্ত্রণে আনার কোনও চটজলদি সমাধান নেই। ঋণ বা টাকার জোগান কমিয়ে কিংবা সুদের হার বাড়িয়ে সহজে কিছু করা যায় না, সেটা তো দেখাই গেছে। কিন্তু এখানে তিনটে কথা বলা দরকার। এক, অনেক অভিজ্ঞতা নিয়েও ইউ পি এ সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছু করতে পারেনি। দুই, আয়বৃদ্ধির মতোই মূল্যস্ফীতির ব্যাপারেও সরকারি পূর্বাভাস একের পর এক ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ সরকার এ ক্ষেত্রেও অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বুঝতে পারেনি। তিন, সুদের হার বাড়িয়ে এবং টাকার জোগান কমিয়ে যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তা হলে সে পথে হাঁটার যুক্তি কী?
দারিদ্র কমানোর সাফল্য নিয়ে ইউ পি এ বিস্তর গর্ব করেছে। তেন্ডুলকর কমিটির সূত্র অনুসারে ২০০৪-০৫ সালে দেশের ৩৭.২ শতাংশ মানুষের আয় দারিদ্র সীমার নীচে ছিল, ২০০৯-১০ সালে অনুপাতটি পৌঁছয় ২৯.৮ শতাংশে, ২০১১-১২ সালে সেই অনুপাত নেমে দাঁড়ায় ২১.৯ শতাংশ। এখানে তিনটে প্রশ্ন আছে। এক, মাত্র দু’বছরের মধ্যে দারিদ্রের মাত্রা এতটা কমে যাওয়ার রহস্য কী, সেটা কেউ ব্যাখ্যা করেনি, যোজনা কমিশনও না। দুই, বিহার বা উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে, যেখানে রোজগার গ্যারান্টি প্রকল্প ভাল কাজ করেনি, সেখানে দারিদ্রের অনুপাত কী করে অনেকটা কমল, সরকার তার কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি। তিন, কর্মসংস্থান প্রকল্পের চেয়ে আয়বৃদ্ধিই যদি দারিদ্র দূরীকরণের প্রধান হাতিয়ার হয়ে থাকে, তা হলে ভাবা দরকার, আয়বৃদ্ধির গতি এমন ভাবে কমে না গেলে, বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন এতটা শ্লথ না হলে দারিদ্র আরো কতটা কমতে পারত। ইউ পি এ সেই সুযোগ নষ্ট করেছে।
শেষ করছি একটি বিষয়ের আলোচনা দিয়ে, দারিদ্রের মোকাবিলায় ইউ পি এ’র ব্যর্থতার মাত্রা বুঝতে যা বিশেষ সাহায্য করবে। ২০০৯ জুনে দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকার তৈরি হওয়ার পরে সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদ থেকে কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করছি: “বিলো পভার্টি লাইন (বি পি এল) বা দারিদ্র সীমার নীচে থাকার পাইকারি ধারণাটির বদলে (দরিদ্রকে) চিহ্নিত করার জন্য নির্দিষ্ট কার্ড প্রচলিত হবে। জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনের (এন আর ই জি এ) জন্য একটি জব কার্ড-এর ব্যবস্থা আছে। প্রস্তাবিত খাদ্য নিরাপত্তা আইনেও একটি নতুন কার্ড চালু হবে। অন্যান্য প্রকল্পের আওতায় থাকা মানুষদের চিহ্নিত করার জন্য এখন পাইকারি বি পি এল তালিকাটিই অনুসরণ করা হয়, সে সব ক্ষেত্রেও উপযুক্ত প্রাপকদের নির্দিষ্ট করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা হবে। এই সব ক্ষেত্রেই একটি মৌলিক নীতি অনুসৃত হবে— গ্রামসভা এবং শহরের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রাপকদের চিহ্নিত করা হবে এবং তাঁদের নামের তালিকা প্রকাশ্য পরিসরে রাখা হবে, যাতে যে কোনও নাগরিক সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন।”
উদ্ধৃতিটি গুরুত্বপূর্ণ। কেবল রাষ্ট্রপতির ভাষণে উল্লেখিত হয়েছিল বলে নয়, নতুন সরকার যে কাজগুলি একশো দিনের মধ্যে সম্পন্ন করবে বলেছিল, এটি তাদের অন্যতম। একশো দিন তো দূরে থাকুক, পাঁচ বছরেও প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হয়নি। আধার প্রকল্প কার্যত বিশ বাঁও জলে। অথচ এল পি জি এবং অন্য কিছু ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়ার জন্য আধার কার্ডের ব্যবহার প্রচলন করতে গিয়ে সরকার অনর্থক জটিলতা সৃষ্টি করেছে, হয়রান হয়েছেন সাধারণ নাগরিক। ইউ আই ডি আবশ্যিক না আবশ্যিক নয়, সেই প্রশ্নই এখনও ঝুলে আছে।
একশো দিনের মধ্যে আরও নানা কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ইউ পি এ সরকার। যেমন, ‘পশ্চাৎপদ অঞ্চলের জন্য অনুদান তহবিল (বি আর জি এফ) অন্যান্য উন্নয়নী বিনিয়োগের সঙ্গে অংশত মিলে যায়, এই তহবিল পুনর্গঠন করা হবে, যাতে বিকেন্দ্রীকরণ প্রসারিত হয় এবং নির্বাচিত পঞ্চায়েত প্রতিনিধির সামর্থ্য বৃদ্ধি পায়।’ কিংবা, ‘বিচারব্যবস্থার সংস্কারের একটা পরিকল্পনা ছ’মাসের মধ্যে তৈরি করা হবে এবং সময় বেঁধে দিয়ে সেই পরিকল্পনা রূপায়িত হবে।’ কোথায় কী?
দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ