এক বছর না কাটিতেই ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহু পুনরায় পার্লামেন্ট ভাঙিয়া দিয়া নির্বাচন ডাকিয়া দিলেন। নির্বাচন ডাকার কারণ, নেতানিয়াহু তাঁহার মনের মতো পার্শ্বচরদের লইয়া সরকার চালাইতে ব্যগ্র, বর্তমান মন্ত্রীদের সহিত তাঁহার বনিবনা হইতেছিল না। অবনিবনার কারণ: এক দিকে আর্থিক সংস্কার বিষয়ে নেতানিয়াহুর অবস্থান, অন্য দিকে প্যালেস্টিনীয়দের জমি গ্রাস, দখলীকৃত ওয়েস্ট ব্যাংক-এ ইহুদি পরিবারদের বসত করানো এবং গাজার অভিযানের পর শান্তিপ্রক্রিয়ায় অন্তর্ঘাত করার সরকারি নীতি সম্পর্কে মতান্তর। এই সব প্রশ্নেই নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টির সরকার চরম অবস্থান গ্রহণ করাতেই তাঁহার মন্ত্রিসভার সদস্যরা ক্ষুব্ধ। নেতানিয়াহুর মনে হইয়াছে, নূতন করিয়া পার্লামেন্ট নির্বাচন করিয়া পছন্দের রাজনীতিকদের লইয়া মন্ত্রিসভা সাজানোই সহজ সমাধান।
এই সমাধানসূত্র শেষ পর্যন্ত কতটা কার্যকর হইবে, সংশয় আছে। কারণ, নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই আইজ্যাক হার্জগের লেবার পার্টি এবং জিপি লিভ্নি-র বাম-ঘেঁষা, মধ্যপন্থী হাতনুয়া পার্টি যৌথ ভাবে নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়িয়া দিয়াছে। ইতিমধ্যেই যে-সব জনমত সমীক্ষা আয়োজিত, প্রতিটিই এই নবনির্মিত রাজনৈতিক জোটের সাফল্য এবং নেতানিয়াহুর পরাজয়ের আভাস দিতেছে। এমনকী অন্য যে সব ছোটখাটো দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিবে, তাহাদের সমর্থন লইয়াও লিকুদের পক্ষে এ বার সরকারে ফেরা কঠিন। কারণটি অনুমান করা কঠিন নয়। নেতানিয়াহু এই লইয়া চার বার ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু যত দিন গিয়াছে, ততই তাঁহার কট্টরপন্থা এক দিকে প্যালেস্টিনীয়দের নিজস্ব স্বদেশ হাসিলের স্বপ্নকে উত্তরোত্তর স্থগিত করিয়াছে, অন্য দিকে প্যালেস্টিনীয়দের উপর দমনপীড়ন বিশ্বমঞ্চে ইজরায়েলকে ক্রমশ নিঃসঙ্গ করিয়াছে। যে-ব্রিটেন জন্মলগ্ন হইতে ইজরায়েলের রাষ্ট্রীয় অধিকারকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়া আসিয়াছে, তাহার পার্লামেন্টেও তেল আবিবের বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দাপ্রস্তাব অনুমোদিত হইয়াছে। সুইডেন-সহ ইউরোপের কয়েকটি দেশও গাজার নিরস্ত্র প্যালেস্টিনীয়দের উপর ইজরায়েলি বোমারু হানাদারির বর্বরতায় ক্ষুব্ধ, কেহ কেহ এই রাষ্ট্রের সহিত সম্পর্ক না-রাখার প্রস্তাবও বিবেচনা করিতেছে।
অতীতে এ ধরনের যে-কোনও সমালোচনাকে ‘ইহুদি-বিদ্বেষ’-এর তক্মা দিয়া সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার যে অভিযান চালানো হইত, ইদানীং তাহাতে কাজ হইতেছে না। বরং গাজায় প্যালেস্টিনীয় শিশু-নারী-বৃদ্ধদের নির্বিচার হত্যার পর বিবেকী ইউরোপীয় জনমতও প্রশ্ন তুলিতে শুরু করিয়াছে, নাত্সি বর্বরতার তুলনায় এই বর্বরতা কম কীসে? প্যালেস্টিনীয়দের বাস্তু হইতে ক্রমাগত উচ্ছেদ করিয়া পূর্ব জেরুজালেম ও ওয়েস্ট ব্যাংক-এ যে-ভাবে ইহুদি পরিবারগুলিকে বসত করানো হইতেছে, তাহাদের ‘নিরাপত্তা’র অজুহাতে প্যালেস্টিনীয়দের কার্যত সুউচ্চ কংক্রিটের পাঁচিল ও পর্যায়ক্রমিক কাঁটাতারের বেড়ার ঘেরাওয়ে আটক রাখা হইয়াছে, তাহা বর্ণবিদ্বেষী দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুসৃত বর্ণবৈষম্য নীতির চেয়ে কোনও অংশেই কম অমানবিক নয়, এই আলোচনাও ইজরায়েলকে একঘরে করিতেছে। লেবার ও মধ্যপন্থী দলগুলিও নেতানিয়াহুর এই দমননীতির সহিত সহমত নহেন। প্যালেস্টিনীয় নিজস্ব রাষ্ট্র মঞ্জুর না হইলে যে সন্ত্রাসবাদের সমস্যারও মীমাংসা সম্ভব নয়, এ বিষয়ে তাঁহাদের দ্বিমত নাই। আশার কথা।