দাঙ্গার পরে। মুজফ্ফরনগর, উত্তরপ্রদেশ, সেপ্টেম্বর ’১৩। ছবি: প্রেম সিংহ।
এক দিকে সাম্প্রদায়িক আবেগ, আর অন্য দিকে উন্নয়নের স্বপ্ন। এই আশ্চর্য মিশেল দিয়ে কী ভাবে ভারতীয় জনতা পার্টি এবং সঙ্ঘ পরিবার গত জাতীয় নির্বাচনে সাফল্য ছিনিয়ে আনল, সেটা আমরা সকলেই দেখেছি। এও দেখেছি যে, উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে জাত-রাজনীতির ভিতটা কী ভাবে পুরো ধসে গেল এই মিশেল-অস্ত্রের চোটে। ওঁরা ঠিকই বুঝেছিলেন, সাধারণ মানুষের মনে উন্নয়নের রঙিন ছবিটাকে উশকে দিতে না পারলে সম্প্রদায়-রাজনীতি ব্যাপারটা ভাল করে কাজ করবে না, হিন্দুত্ব হোঁচট খেয়ে পড়বে। তাই এই অসাধারণ স্ট্র্যাটেজি, যা দিয়ে সব জাত সব সম্প্রদায়ের লোককে চট করে ভোটের মাঠে কাছে টেনে নেওয়া যায়। হ্যাঁ, এমনকী মুসলিমদেরও।
কিন্তু এর পর কী হবে? উন্নয়নের স্বপ্ন যদি বাস্তবায়িত না হয়? ‘আচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতি যদি শেষে মরীচিকাই থেকে যায়? হতাশা ছড়াবে সন্দেহ নেই। বিজেপি-র সাম্প্রদায়িক আবেগ উশকানির নিরন্তর প্রচেষ্টাতেও সঙ্গে সঙ্গে ভাটা পড়বে। ঠিক যেমন হয়েছিল মুজফ্ফরনগর ও মোরাদাবাদে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর সময়ে।
বিজেপি একা নয়। বহুজন সমাজ পার্টির মতো জাত-রাজনীতির একনিষ্ঠ পূজারি দলও প্রায় একই রকম জটিল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে এই মুহূর্তে। ভারতীয় রাজনীতির সাম্প্রতিক ইতিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, জাত-রাজনীতি সাফল্যের স্বাদ পেয়েছে তখনই, যখন বিভিন্ন জাতপাতের প্রশ্নের সঙ্গে সেই সব জাত বা গোষ্ঠীকে সরাসরি ক্ষমতার ভাগাভাগির স্বপ্নর দেখানো গিয়েছে। ক্ষমতার ভাগাভাগি বা পুনর্বণ্টন নানা পথে নানা ভাবে হতে পারে: সরকারি চাকরির সুবিধা, সামাজিক প্রতিষ্ঠার নিশ্চিতি, কিংবা দারিদ্র-বন্ধন থেকে মুক্তি। এও দেখা গিয়েছে, যখন অতীব পশ্চাদ্পর বা মহা-দলিত গোষ্ঠীরা দেখেছেন যে এই বর্ধিত ক্ষমতার অধিকাংশটাই যাচ্ছে তাদের থেকে উন্নততর দলিত গোষ্ঠীগুলির কুক্ষিতে, তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এবং তখনই উন্নততর দলিত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ অতীব পশ্চাদ্পর গোষ্ঠীগুলিকে চট করে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মধ্যে টেনে আনা সম্ভব হয়েছে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঠিক এটাই ঘটেছে উত্তরের এই রাজ্যগুলিতে।
বিজেপি-র স্ট্র্যাটেজির সাফল্য মনে রাখলে বলতে হবে, বলটা তা হলে এ বার মায়াবতী, মুলায়ম সিংহ, নীতীশ কুমার, লালু যাদবদের মতো নেতাদের কোর্টে। উত্তর ও পূর্ব ভারতে এঁরাই জাত-রাজনীতির ধারক-বাহক। ২০১৫ সালে বিহারে ও ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে তাঁদের পরবর্তী যুদ্ধ।
পরবর্তী পর্বের যুদ্ধে এই সব রাজ্যে তা হলে জাতপাতের রাজনীতিই হয়ে উঠবে প্রধান নায়ক। ধর্মের নামে রাজনীতি ঠেকানোর প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়াবে জাতপাতের রাজনীতি। বিহারের দিকে তাকানো যাক। নীতীশ কুমার ইতিমধ্যেই লালু প্রসাদের সঙ্গে তাঁর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিহাস পাশে সরিয়ে রেখে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, যাতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফাঁসটা জাত-রাজনীতির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ দিয়ে কাটান দেওয়া যায়। এই ফরমুলা মনে রেখেই লালু প্রসাদের স্লোগান ‘মণ্ডল দিয়ে কমণ্ডলু প্রতিরোধ’। বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে দলিত-মহাদলিত, উপজাতীয় ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য ৬০ শতাংশ সংরক্ষণের যে দাবি তোলা হয়েছে, সেও এই দিকে চোখ রেখেই।
নীতীশ কুমারও ঠিক ভাবে ধরতে পেরেছেন বিহারের এই চরম প্রত্যন্ত গোষ্ঠীগুলির আবেগ। আর তাই মহাদলিতদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে তিনি অতি পশ্চাদ্পর মুশাহার গোষ্ঠীর নেতা জিতেন মাঝিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করেছেন। তবে, তুলনায় উচ্চতর যে গোষ্ঠীগুলি আগে বিজেপি-জেডিইউ আঁতাতের সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, জিতেন মাঝির সরকারেও কিন্তু তারা এখনও যথেষ্ট প্রভাবশালী, বড় সরকারি আসনগুলি এখনও তাদের জন্য বাঁধা। নীতীশ কুমারকে এই দিকটাতেও এ বার মন দিতে হবে। যাদব ও ভূমিহারদের সঙ্গে তাঁর পুরনো সম্পর্ক ইতিমধ্যেই তিনি নতুন করে ঝালাই করতে শুরু করেছেন। এ বার দেখা যাক, মহাদলিত ও সর্বাধিক অনগ্রসর গোষ্ঠীগুলিকে নিয়ে নীতীশ কুমারের নিজের যে নির্বাচনী মণ্ডল, তাঁরা কী ভাবে এই নতুন সম্পর্কটিকে গ্রহণ করেন!
উত্তরপ্রদেশে ছবিটা অন্য রকম। সেখানে মায়াবতী ও মুলায়ম সিংহের একত্র হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। বিজেপি-কে ঠেকানোর জন্য সেখানেও যদি মায়াবতী-মুলায়ম এক হতে পারতেন, নিজেদের মধ্যে শক্তপোক্ত বোঝাপড়া তৈরি করতে পারতেন, রাজ্যের সামাজিক মানচিত্রটাই পাল্টে যেতে পারত, উত্তর ভারতেরও। এখনও কিন্তু মায়াবতী কাঁসিরামের লাইন ধরেই চলার কথা ভাবছেন। দলিত, অতি অনগ্রসর গোষ্ঠী ও মুসলিমদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া তৈরি করতে চাইছেন। তবে, তাঁর সামনে একটা বড় বাধা রয়েছে। তাঁর নিজের সবচেয়ে পুরনো ভোট-ব্যাঙ্ক, বিশেষত অতি অনগ্রসর জাতিগুলি সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষিতে অনেকটা বিজেপি-র দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে তাঁর নিশ্চয়ই সন্দেহ হচ্ছে হিন্দু দলিত ভোটার ও মুসলিমদের মধ্যে সত্যিই কতটা সেতু গড়া শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে।
এ দিকে শাসক সমাজবাদী পার্টি মুজফ্ফরনগরে দাঙ্গার সময়ে যে ভুল করেছে, আর দ্বিতীয় বার তারা তা করবে না। তাই সম্প্রতি মোরাদাবাদে যখন হিংসার আগুল জ্বলল, প্রশাসন বেশ কড়া রকমের পদক্ষেপ নিল, এবং সীমিত পরিমাণে হলেও বিজেপি-র পালের হাওয়া কেড়ে নিতে পারল। উল্টো দিকে, বিজেপি এখন মায়াবতী ও নীতীশ কুমারের দলিত-সমর্থনের মেরুদণ্ডটা ভাঙার চেষ্টা করছে। জগজীবন রাম, অম্বেডকর, সুহেলদেব পাসি, দীনা ভাদ্রি মুশাহার প্রমুখ জাত-রাজনীতির নেতাদের অনুষঙ্গ যে ভাবে বিজেপির রাজনৈতিক এজেন্ডায় ঢোকানো শুরু হয়েছে, তার থেকেই ঘটনাটা পরিষ্কার।
সুতরাং দেখা যাক, উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে আগামী নির্বাচনের সময়ে বিজেপি-র উন্নয়ন এবং সাম্প্রদায়িকতার দ্বৈত এজেন্ডা কতখানি কাজ দেয়। এও দেখতে হবে, উন্নয়নের স্বর্ণালি স্বপ্নে সামিল হওয়ার ইচ্ছা আর সাম্প্রদায়িক আবেগের মিশেল শেষ পর্যন্ত জাত-পরিচয়ের বিষয়টাকে গৌণ করে দিতে পারে কি না, আর করতে পারলে কী ভাবে, কতখানি পারে। না কি বিজেপির স্বপ্নের বেলুন চুপসে দিয়ে মণ্ডল রাজনীতিই আরও এক বার উত্তর ভারতে কমণ্ডলু রাজনীতির রথ থামিয়ে দিতে পারবে? ঠিক যেমন হয়েছিল সেই আশি-নব্বইয়ের দশকে?
ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে জি বি পন্থ সোশ্যাল সায়েন্স ইনস্টিটিউটে ইতিহাসের শিক্ষক