সল্ট লেকের সেক্টর ফাইভ হইতে হাওড়া ময়দান অবধি বিস্তৃত ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ গত দুই বছর ধরিয়া রুদ্ধ। কারণ পশ্চিমবঙ্গ সরকার বা কলিকাতা পুরসভা বউবাজার-ডালহৌসি অঞ্চলে নির্মেয় দুইটি মেট্রো স্টেশনের জন্য জরুরি মাত্র তিন একর জমি নির্মাতাদের হাতে তুলিয়া দিতেছে না। ইহা এক বিচিত্র পরিস্থিতি। ক্ষমতাসীন সরকারের তরফে রাজ্যের রাজধানীর উন্নয়নে বাধা সৃষ্টির এক অনন্য নজিরও বটে। আবেদন-নিবেদনে কাজ না-হওয়ায় নির্মাণকারী সংস্থা কলিকাতা হাইকোর্টেরও দ্বারস্থ হইয়াছিল। হাইকোর্ট রাজ্যকে নির্মাণের কাজে সাহায্য করার নির্দেশও দেয়। কিন্তু এখন রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী বলিতেছেন, তাঁহারা প্রকল্প হইতে হাত ধুইয়া ফেলিয়াছেন, জমি অধিগ্রহণ করিয়া নির্মাতাদের হাতে তুলিয়া দিবার কোনও দায় তাঁহাদের নাই। রাজনীতি আসিয়া উন্নয়নকে আর কোথায় লইয়া যাইতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে তাহাই দেখিবার।
এমন একটি সুবৃহৎ জনকল্যাণ প্রকল্পে রাজনীতির কোনও গন্ধই থাকা উচিত নয়। অথচ রাজ্যের শাসক দল এখানেও সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি অনুশীলন করিতেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পটি রেল-এর অধীনেই ছিল। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হইলে প্রকল্পটিতে রাজ্যের অংশীদারিত্ব ও উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার ছাড়িয়া দিলে রাজ্য সরকারও প্রকল্পটির দ্রুত রূপায়ণের উৎসাহ হারাইয়া ফেলে। তদবধি প্রকল্প সম্পূর্ণ করা কেন্দ্রের মাথাব্যথা, রাজ্যের নয়, এমন একটি বার্তা রটাইয়া দেওয়া হয়। উপরন্তু মূল নক্শার বদল ঘটাইয়া সেন্ট্রাল স্টেশনকে দুইটি পাতাল রেলের সংযোগবিন্দু হিসাবে গড়ার জন্য প্রস্তাবিত পথের পুনর্বিন্যাসের দাবি করা হয়। অজুহাত হিসাবে মূল নক্শায় থাকা বউবাজার স্টেশন গড়ার জন্য ৯০ জন দোকানদার-হকার উচ্ছেদ করার অসুবিধার কথা তোলা হয়। কলিকাতা হাইকোর্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানায়, কিছু লোকের অসুবিধার জন্য লক্ষ-কোটি নিত্যযাত্রীর সুবিধা জলাঞ্জলি দেওয়ার প্রশ্ন নাই এবং মূল নক্শা অনুসরণ করিয়াই ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো গড়িতে হইবে। এ জন্য রাজ্যকে জমি অধিগ্রহণ করিয়া মেট্রো কর্তৃপক্ষের হাতে তুলিয়া দিতেও বলা হয়। কিন্তু পুরমন্ত্রীর সাম্প্রতিকতম উক্তি বলিতেছে, রাজ্য সরকার মর্যাদার লড়াইয়ে নামিয়াছে। তাহাতে রাজ্যের ক্ষতি হইলে, হউক।
একই প্রবণতা দেখা যাইতেছে রাজ্যের জাতীয় সড়কগুলির ক্ষেত্রেও। সড়কগুলির দুরবস্থার জন্য রাজ্য সরকার কেন্দ্রকে দায়ী করে। কিন্তু কেন্দ্র যখন সড়ককে চার বা ছয় লেনে পরিণত করিতে রাস্তার ধারের জমি অধিগ্রহণ করিতে বলে, তখনই অধিগ্রহণ-বিরোধী নীতির দোহাই দিয়া রাজ্য সরকার হাত গুটাইয়া লয়। ফলে সড়কগুলির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতির কাজ বন্ধ, নিয়মিত দুর্ঘটনা লাগিয়াই আছে। উন্নয়ন লইয়া এই সংকীর্ণ রাজনীতি ক্ষতি করিতেছে রাজ্যেরই। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর দ্রুত রূপায়ণে রাজ্যের নগরোন্নয়ন মন্ত্রীর বাধা দান, রকমারি অজুহাতে ক্রমাগত বিঘ্ন সৃষ্টির ঘটনা রাজ্যবাসীর নজর এড়াইতেছে না, ঠিক যেমন জাতীয় সড়কগুলির উন্নয়নে জমি না-দিতে সরকারের অন্যায় জেদ সড়ক ব্যবহারকারী জনসাধারণের গোচরে রহিয়াছে। কেন্দ্রের সহিত রাজনৈতিক দাবার চাল চালিতে গিয়া রাজ্যের উন্নয়নের সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা আত্মঘাতী। কিন্তু, একই সঙ্গে রাজ্যের ভবিষ্যৎও মারা যাইতেছে, তাহাই পরিতাপের।