সম্পাদকীয় ২

আইন নয়, সংবেদনা

যে কোনও সামাজিক সমস্যা দেখা দিলেই নূতন একটি আইন করিয়া তাহা সমাধানের প্রয়াস দেশের আইনপ্রণেতা তথা রাজনীতিকদের একটি সহজ সমাধান। অথচ ঠান্ডা মাথায় বিচার করিলে দেখা যাইবে, নূতন আইনের বাস্তবিক কোনও প্রয়োজনই নাই, প্রচলিত দণ্ডবিধিতেই সুরাহার সংস্থান রহিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

যে কোনও সামাজিক সমস্যা দেখা দিলেই নূতন একটি আইন করিয়া তাহা সমাধানের প্রয়াস দেশের আইনপ্রণেতা তথা রাজনীতিকদের একটি সহজ সমাধান। অথচ ঠান্ডা মাথায় বিচার করিলে দেখা যাইবে, নূতন আইনের বাস্তবিক কোনও প্রয়োজনই নাই, প্রচলিত দণ্ডবিধিতেই সুরাহার সংস্থান রহিয়াছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের জনজাতীয় মানুষরা উচ্চশিক্ষা বা কার্যব্যপদেশে অবশিষ্ট ভারতের বিভিন্ন স্থানে ডেরা বাঁধিতেছেন। গণতন্ত্রে ইহা একটি স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর প্রবণতা, যাহা বহুভাষিক, বহুধর্মীয় ও বহুজাতিক ভারতীয় ঐতিহ্যকে পরিপুষ্টই করে। কিন্তু প্রধানত মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠীর এই জনজাতিগুলির বাহ্যিক চেহারা, লৌকিক আচার-আচরণ, ধর্মীয় সংস্কৃতি ‘ভিন্ন’ হওয়ায় প্রায়শ তাঁহাদের উপর আক্রমণ নামিয়া আসিতেছে। কখনও স্রেফ টিটকারি বা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, কখনও শ্লীলতাহানি কিংবা প্রহার, আবার কখনও একেবারে খুন করিয়া ফেলার ঘটনাও বিরল নয়। ঘটনাগুলি উদ্বেগজনক। কিন্তু তাহার মোকাবিলায় নূতন করিয়া আইন বানাইবার আবশ্যকতা নাই। ফৌজদারি দণ্ডবিধিতেই এমন অপকর্ম নিয়ন্ত্রণের বিধান আছে।

Advertisement

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ সম্পর্কে অবশিষ্ট ভারতের, বিশেষত উত্তর ভারতের সমাজের সংশয়, অবিশ্বাস, এমনকী বিদ্বেষ প্রায়শ প্রকট। রাজধানী দিল্লিতেই এ-ধরনের অসহিষ্ণুতার পৌনঃপুনিক প্রকাশ ঘটিলেও বেঙ্গালুরুর মতো শহরেও ইদানীং এই প্রবণতা দেখা যাইতেছে। দিল্লিতে অরুণাচল প্রদেশের এক ছাত্রকে পিটাইয়া মারা অবধি হইয়াছে। এই প্রবণতা কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার, দোষীদের কড়া সাজাও প্রাপ্য। কিন্তু সে জন্য নূতন আইন বানাইয়া জনজাতিদের মঙ্গলের জন্য প্রয়োজনীয় যাহা কিছু করিয়া দিলাম, এই আত্মতুষ্টি প্রশাসন ও রাজনীতিকে পাইয়া বসে। অথচ যে-মানসিকতা ‘অন্য রকম’ মানুষ, লোকাচার ও সংস্কৃতির অনন্যতাকে ঘৃণা কিংবা সন্দেহ করে, তাহা ঘুচাইবার লক্ষ্যে বেজবরুয়া কমিটির সুপারিশগুলি বরং প্রণিধানযোগ্য। স্কুলকলেজের পাঠক্রমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিবাসী ও জনজীবন সম্পর্কে সম্যক ধারণা সৃষ্টি করা, স্বাধীনতা সংগ্রামে জনজাতিদের অবদানের দৃষ্টান্ত তুলিয়া ধরা, অবশিষ্ট দেশের সহিত ওই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ও বিনিময় নিয়মিত করা পারস্পরিক শ্রদ্ধা গড়িয়া তুলিতে পারে। তাহা আইনের কাজ নহে।

জাতি-পরিচয় তুলিয়া মানুষকে অপমান করা কিংবা তাহার প্রতি বৈষম্য ও পীড়ন চালানোর মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনি ব্যবস্থা যথেষ্ট কঠোর। সুষ্ঠুভাবে সেই আইন প্রয়োগ করিলে, পক্ষপাতমুক্ত হইয়া এবং জনজাতীয়দের প্রতি সহমর্মিতা ও সংবেদনশীলতা লইয়া তাহাদের নির্যাতনকারীদের বিচার করিলে প্রয়োজনীয় বার্তা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের কাছেই পৌঁছাইবে। তাহার পরিবর্তে পৃথক আইন করিয়া নিগ্রহকারীদের শায়েস্তা করিতে গেলে বরং জনজাতীয়দের স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়সর্বস্ব পার্থক্য উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী জনতার কাছে আরও সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতে পারে। যেখানে বিভাজন হ্রাসই লক্ষ্য, ভিন্নতা ও পার্থক্যের উপর জোর দেওয়ার পরিবর্তে ঐক্য, সংহতি ও সমতার উপর জোর দেওয়াই দরকার, সেখানে উত্তর-পূর্বের জনজাতীয়দের রক্ষায় পৃথক আইন তাহাদের পৃথগন্নই করিয়া রাখিবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement