সম্পাদকীয় ১

অসন্তোষের কারণ

তৃণমূলের অভ্যন্তর হইতেও যে যাদবপুর প্রসঙ্গে একটি যুক্তিসঙ্গত ভিন্ন সুর উঠিয়া আসিতে পারে, রাজ্যবাসী সম্ভবত অনুমান করেন নাই। ছাত্রছাত্রীদের বয়কট-প্রতিবাদের নৈতিকতার প্রশ্নটি উত্থাপন করিয়া সুব্রত মুখোপাধ্যায় তর্কের সুরটিকে তাঁহার দলের রাজনীতির ঊর্ধ্বে, একটি উচ্চতর স্তরে বাঁধিয়া দিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share:

তৃণমূলের অভ্যন্তর হইতেও যে যাদবপুর প্রসঙ্গে একটি যুক্তিসঙ্গত ভিন্ন সুর উঠিয়া আসিতে পারে, রাজ্যবাসী সম্ভবত অনুমান করেন নাই। ছাত্রছাত্রীদের বয়কট-প্রতিবাদের নৈতিকতার প্রশ্নটি উত্থাপন করিয়া সুব্রত মুখোপাধ্যায় তর্কের সুরটিকে তাঁহার দলের রাজনীতির ঊর্ধ্বে, একটি উচ্চতর স্তরে বাঁধিয়া দিলেন। তিনি বলিয়াছেন, ছাত্র রাজনীতির অধুনা-প্রচলিত হিংসার পথে না হাঁটিয়া ছাত্রছাত্রীরা অহিংস ভাবে সক্রিয় প্রতিবাদের নজির গড়িলেন। মন্ত্রীর বক্তব্যের সুর যে পর্দাটি ছুঁইবেই, সেখানে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর অধিষ্ঠান। অহিংস অসহযোগকে কী ভাবে প্রবলতম রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করা যায়, বিশ্ব তাঁহার নিকট শিখিয়াছিল। গাঁধীর অসহযোগের অবিচ্ছেদ্য শর্ত ছিল প্রতিপক্ষের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন। প্রশ্ন উঠিতে পারে, সমাবর্তনের মঞ্চে আচার্যকে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে প্রতিবাদী ছাত্ররা সেই শর্তটি লঙ্ঘন করিলেন কি না। মোট ছাত্রছাত্রীর অতি সামান্য অংশ হইলেও শতাধিক জন তাঁহাদের শংসাপত্র লইতে অস্বীকার করিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম তাঁহাদের মনে যে সুতীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়াছে, সেই ক্ষোভ তাঁহাদের সমাবর্তনের আনন্দে যোগ দিতে বাধা দিতেই পারে। কিন্তু, যোগদানে সম্মতি জানাইয়া অনুষ্ঠানমঞ্চে আচার্যকে প্রত্যাখ্যান করাই সত্যাগ্রহের পথ কি না, প্রশ্নটি উড়াইয়া দেওয়ার নহে। তবে, বঙ্গীয় রাজনীতির ঘোলা জলেও যে এই প্রশ্নগুলির ঢেউ উঠিতে পারে, তাহা ছাত্রদের প্রতিবাদ ব্যতীত জানা যাইত না। প্রশ্নগুলিকে খুলিয়া দেওয়ার জন্য সুব্রত মুখোপাধ্যায়েরও কৃতিত্ব প্রাপ্য। তাঁহার দলনেত্রী অবশ্য দলের সুর গাহিবার দায়িত্ব নিকটতর জনের হস্তে সমর্পণ করিয়াছেন।

Advertisement

তর্কের খাতিরে ধরিয়া লওয়া যাউক, ছাত্ররা অহিংস অসহযোগের শর্তভঙ্গ করিয়াছেন। যৌবনের ধর্মের দোহাই দিয়া তবুও তাঁহাদের মার্জনা করা চলে। অভিজিত্‌ চক্রবর্তী আত্মপক্ষ সমর্থনে কোনও যুক্তিই খাড়া করিতে পারিবেন না। তিনি পলিতকেশ। অনুমান, অভিজ্ঞও বটে। সর্বোপরি, বঙ্গেশ্বরীর ইচ্ছায় তিনিই এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির প্রধান। গত সাড়ে তিন মাসের কোনও একটি মুহূর্তেও তাঁহার আচরণ তাঁহার শিক্ষকসত্তা বা পদমর্যাদার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় নাই। গণভোটকে মাপকাঠি মানিলে বলিতে হয়, ছাত্ররা দ্ব্যর্থহীন ভাবে তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। তবুও তিনি নিজের অবস্থান হইতে এক চুল নড়েন নাই। তিনি লৌহমুষ্টিতে শাসন করিবার সংকল্প করিয়াছেন। তাঁহার শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রসঙ্গ আপাতত উহ্য থাকুক। কিন্তু, মানুষ হিসাবেও যে তিনি এই পদটির যোগ্য, অভিজিত্‌ চক্রবর্তী তাহা প্রমাণ করিতে পারেন নাই। আবু ঘ্রাইব চালাইবার মানসিকতায় বিশ্ববিদ্যালয় চালানো যায় না। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা-ভবিষ্যত্‌ সম্বন্ধে তাঁহার বিন্দুমাত্র চিন্তা থাকিলে তিনি বহু পূর্বেই পদত্যাগ করিতেন। প্রতিষ্ঠানটি যে তাঁহার কুর্সির তুলনায় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, উপাচার্যের এই বোধের অভাবই সমস্যার মূল কারণ।

পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকরা শিক্ষার গুরুত্ব বুঝিবেন, এমন দুরাশা কাহারও নাই। তাঁহারা দল বোঝেন। পদাধিকারবলে যিনি প্রতিষ্ঠানটির আচার্য, তাঁহার নিকট স্বভাবত কোনও প্রত্যাশা থাকিবার কথা নহে, কারণ তিনি অলংকারমাত্র। কিন্তু তিনি স্বেচ্ছায় মধ্যস্থতা করিতে উদ্যোগী হইয়াছিলেন। তাঁহার নিকট চৌকিদারের শাসন প্রত্যাশিত ছিল না। আশা ছিল অভিভাবকের শাসনের তিনি ছাত্রদের ক্ষোভকে তাহার প্রাপ্য সম্মান দিয়া সমাধানসূত্র খুঁজিয়া দিবেন। রাজ্যপাল হতাশ করিয়াছেন। কেহ সমাবর্তন বয়কট করিলে তাহার শংসাপত্রে দাগ মারিয়া দেওয়ার হুমকি হইতে সমাবর্তনের মঞ্চে তাঁহার ভূমিকা, কোনওটিই অভিভাবকসুলভ নহে। লৌহমুষ্টি যে যাদবপুরের অচলাবস্থা ভাঙিতে পারিবে না, তাহা এক্ষণে স্পষ্ট। ছাত্রদের দাবিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়া সমাধানসূত্র সন্ধানের প্রক্রিয়াটির সূচনার জন্য আরও কত কুনাট্যের অগ্নিপরীক্ষা দিতে হইবে?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement