অর্থনীতির চশমায় দুনিয়া দেখেছিলেন

বাঙালি বামপন্থার শ্যামল তরুছায়ায় বড় হয়ে, গবেষণার ছাত্র হিসেবে আমেরিকার পূর্ব-উপকুলের উদারপন্থী ভাবধারার সঙ্গে হালকা আলাপ পরিচয়ের পরে, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের উগ্র মুক্ত-বাজারপন্থী অর্থনীতি বিভাগে অনুজ অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়ে মনে হল, এ কোন গ্রহে এসে পড়েছি!

Advertisement

মৈত্রীশ ঘটক

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৪ ০০:১০
Share:

বাঙালি বামপন্থার শ্যামল তরুছায়ায় বড় হয়ে, গবেষণার ছাত্র হিসেবে আমেরিকার পূর্ব-উপকুলের উদারপন্থী ভাবধারার সঙ্গে হালকা আলাপ পরিচয়ের পরে, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের উগ্র মুক্ত-বাজারপন্থী অর্থনীতি বিভাগে অনুজ অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়ে মনে হল, এ কোন গ্রহে এসে পড়েছি! এক সহকর্মী প্রশ্ন তুললেন, কেউ স্বেচ্ছায় ক্রীতদাস হিসেবে নিজেকে বিক্রয় করতে চাইলে, তাকে আটকাবার আমাদের কী অধিকার আছে? আবার কেউ বললেন, ঘুষ অতি উত্তম জিনিস। সরকারি নিয়মকানুনই হল যত সমস্যার মূলে, আর বাজার যেমন মূল্যের ওঠাপড়া দিয়ে সম্পদের দক্ষ বণ্টন করে, ঘুষও তাই করে। আর এক জন বললেন যে মাদকদ্রব্য, বন্দুক, মানুষের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (যেমন কিডনি) এগুলো অবাধে কেনাবেচা আইনি করে দেওয়া উচিত। বন্দুক অবাধে কেনাবেচা হলে নাকি অপরাধ এবং খুনজখম কমবে, কারণ সাধারণ নাগরিকরাও পকেটে বা ব্যাগে বন্দুক নিয়ে ঘুরবেন, অপরাধীরা বেশি সুবিধা করতে পারবে না!

Advertisement

এই ধরনের অনেক চিন্তা এবং যুক্তির ঠিকানা খুঁজলে রাস্তা এসে শেষ হবে যাঁর অফিসের দোরগোড়ায়, তিনি হলেন অর্থনীতির শিকাগো ঘরানার এক প্রবাদপুরুষ, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ গ্যারি বেকার। গত ৩ মে ৮৩ বছর বয়েসে তিনি মারা গেলেন।

বর্ণবৈষম্য, আত্মহত্যা, নেশা, অপরাধ, এবং দুর্নীতি, এই সব সামাজিক সমস্যা কি মূলধারার অর্থনৈতিক চর্চার বিষয় হতে পারে? বিবাহ, পরিবার পরিকল্পনা, সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্ক এই সব বিষয়ে অর্থনীতির কি কিছু বলার থাকতে পারে? অর্থনীতির দুনিয়ায় এখানেই গ্যারি বেকারের অপরিসীম গুরুত্ব। অনেক সমালোচনা ও উপহাস উপেক্ষা করে তিনি একের পর এক অর্থনীতির সঙ্গে আপাত-সংযোগহীন বিষয়কে টেনে এনেছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের কাঠামোর মধ্যে।

Advertisement

কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হবে, অর্থনীতির তত্ত্বের আলোয় বিশেষ কোনও অন্তদৃষ্টি লাভ হল না। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মনে হবে দস্যু মোহনের গল্পের মত, ‘কোথা হইতে কি হইয়া গেল, মোহনের হাতে পিস্তল’— শেষ পর্যন্ত মুক্ত বাজারই জয়ী। বেকারের কাজে বাজার অর্থনীতির প্রতি এই ধরনের একটা পক্ষপাত অবশ্যই আছে। কিন্তু সে সব সত্ত্বেও মূলধারার অর্থনীতির যুক্তির সূক্ষ্ম এবং সৃষ্টিশীল প্রয়োগে বেকার অতুলনীয়। ব্যক্তিগত মতামত ছেড়ে অর্থনীতির গবেষণার জগতে যেটাকে বিষয়ের ওপর প্রভাবের নৈর্ব্যক্তিক মাপকাঠি বলে ধরা হয়, অর্থাৎ অন্য গবেষকদের লেখায় উল্লেখের সংখ্যা, সেই মাপকাঠি বলবে, বেকারের সর্বাধিক উল্লিখিত গবেষণা হল মানবিক মূলধন (human capital) নিয়ে ১৯৬৪ সালে লেখা তাঁর বই। গুগল স্কলারে এর উল্লেখ প্রায় ২৪,০০০। আধুনিক মূলধারার অর্থনীতির দিকপাল জন মেনার্ড কেইন্স, পল সামুয়েলসেন, কেনেথ অ্যারো, বা মিলটন ফ্রিডম্যান এঁদের কারও কোনও একক বই বা গবেষণাপত্রের এত উল্লেখ নেই।

অর্থনীতি-শাস্ত্রের মূল তিনটি যুক্তিকে বিভিন্ন ও বিচিত্র অর্থনৈতিক-সামাজিক ঘটনার বিশ্লেষণ করতে ব্যবহার করেছেন বেকার। প্রথমত, মানুষ খামখেয়ালি নয়, সে যে কোনও পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয় কোনও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, যেমন ব্যবসায়ীর লক্ষ্য হল সর্বাধিক লাভ অর্জন করা। দ্বিতীয়ত, এই সিদ্ধান্তগুলো বিভিন্ন জিনিসের দাম, মানুষের আয় ও সম্পদের ওপর নির্ভর করে। তৃতীয়ত, ট্রাফিক লাইট যেমন যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করে, সে রকম বাজারের শক্তি অজস্র মানুষের অগণিত সিদ্ধান্তের মধ্যে ভারসাম্য আনে দামের ও নানা পেশায় আয়ের ওঠা-নামার মাধ্যমে। এই কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে বেকারের অর্থনীতির প্রথাগত সীমানা পেরিয়ে অভিযানের কতগুলো উদাহরণ দিই।

১৯৫৫ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে বেকার যে বিষয় নিয়ে তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রি করেন, তা হল বৈষম্যের অর্থনীতি। সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি সমস্ত ক্ষেত্রে আমেরিকায় তখন কৃষ্ণাঙ্গরা আক্ষরিক অর্থে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, নানান বাধা-নিষেধ এবং বৈষম্যের শিকার। বেকার প্রশ্ন তুললেন অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বৈষম্য কী? ধরুন, একটা চাকরির জন্য দু’জন প্রার্থীর যোগ্যতা একেবারে এক। কিন্তু, আপনি কোনও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে এক জনকে নিলেন না, অন্য জনকে নিলেন। চাকরির বাজারে যদি প্রার্থীর অভাব না থাকে, তবে চাকরিদাতার কোনও সমস্যা নেই, ব্যক্তিগত অপছন্দের ভিত্তিতে কাউকে না নিলেও তাঁর চলবে। কিন্তু, বাজারে কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা যদি সীমিত হয়? সেই অবস্থাতেও কেউ চাইলে বৈষম্য করতেই পারেন, কিন্তু নিখরচায় নয়। এই ‘বিলাসিতা’ করতে গেলে লাভ কমে যাওয়া মেনে নিতে হবে, কারণ তিনি গায়ের রং বা ধর্ম বা (চাকরির ক্ষেত্রে) অন্য কোনও অপ্রাসঙ্গিক কারণে যাঁকে নিলেন না, তার জায়গায় তুলনায় অল্প যোগ্যতার কাউকে নিয়োগ করলেন। বেকারের যুক্তি হল, বাজারে অন্য যে নিয়োগকর্তারা শুধুই লাভ-লোকসান দেখেন, তাঁরা এই যোগ্য কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের কম মজুরিতে নিয়োগ করবেন এবং এঁদের প্রতিযোগিতার চাপে শেষে বৈষম্যকারী নিয়োগকর্তাদেরই বাজার ছেড়ে চলে যেতে হবে। যে দোকানদাররা কৃষ্ণাঙ্গদের পণ্য বেচতে অস্বীকার করেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও ঠিক এই ঘটনাটাই ঘটবে। মানতেই হবে বৈষম্য বিষয়টির অনেক দিক, অনেক জটিলতা আছে, এবং বেকারের গল্পটি খানিকটা অতিসরলীকৃত। কিন্তু আর্থিক ভাবে কুশলী নয়, এমন যে কোনও অভ্যাস বা সামাজিক রীতিকে (তা সে ভাল হোক বা মন্দ) বাজারের শক্তি কী ভাবে ক্ষইয়ে দিতে পারে, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোই এই তত্ত্বের বৃহত্তম অবদান।

বৈষম্যের ক্ষেত্রে যদি অর্থনীতির যুক্তি প্রয়োগ করা যায়, বিয়ের বাজারেই বা নয় কেন? ধরা যাক বিবাহযোগ্য সমস্ত ছেলে এবং মেয়েকে তাদের মেধা, শিক্ষা, সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থান, সৌন্দর্য ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে ফেলা হল। বেকার বলেছেন, মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাই হল বিপরীত লিঙ্গের সবচেয়ে আকর্ষক মানুষটিকে বিয়ে করতে চাওয়া। কিন্তু চাইলেই তো আর হয় না, এই প্রতিযোগিতায় সাধারণত সমানে সমানেই বিয়ে হয়। পরিভাষায় একে বলে অ্যাসর্টেটিভ ম্যাচিং বা সমতুল্য সমন্বয়। ফলে, পরিবার তৈরি হওয়ার সময়েই এক পরিবারের সঙ্গে অন্য পরিবারের বৈষম্যও তৈরি হয়ে যায়। বংশগতির প্রভাব যদি বাদও দিই, মা-বাবা উচ্চশিক্ষিত হলে সন্তানও শিক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা যে বেশি, সেটা অস্বীকার করবে কে? উচ্চশিক্ষিত সন্তান পরে বিয়ের বাজারে গেলে তার সমযোগ্য সঙ্গীই পাবে এবং পরবর্তী প্রজন্মও তার সুফল পাবে। বেকার বলেছেন, এ এমনই এক অনিবার্য অসাম্য, বিত্তের বা আয়ের কোনও পুনর্বণ্টনেই যাকে দূর করার জো নেই।

শুধু গবেষণা নয়, বেকার নিয়মিত সংবাদপত্রে প্রবন্ধও লিখতেন। মুক্ত বাজারের প্রতি ঝোঁক অবধি ঠিক ছিল, কিন্তু চিলের একনায়ক পিনোশে-র বাজারমুখী সংস্কারের সমর্থনে এবং তাতে শিকাগো ঘরানার অর্থনীতিবিদদের ভূমিকা নিয়ে ওঁর একটি লেখা পড়ে মনে আছে বেশ হতাশ হয়েছিলাম। প্রশ্ন জেগেছিল, প্রকৃত উদারবাদী হলে রাষ্ট্রের দমনপীড়ন সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন কী করে থাকা যায়? তবে, উদ্দেশ্য মনোমত হলে যে কোনও পন্থাই সমর্থনীয়, এই মনোভাব বাজারপন্থীদের একচেটিয়া নয়, বাম বা দক্ষিণ দুই তরফেই তার উদাহরণ প্রচুর।

অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক মতাদর্শকে শেষ বিচারে আলাদা করা যায় না। মুক্ত বাজারের যুক্তির অবাধ প্রয়োগ তো শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনাসভায় বুদ্ধিচর্চায় সীমিত থাকে না। মতাদর্শ হিসেবে বাস্তব পৃথিবীতে তার পরিণামের কথা ভুলে গেলে চলবে না। সেই বিতর্ক আবশ্যক। কিন্তু রাজনৈতিক বা মতাদর্শগত বিরোধ সরিয়ে রেখে চিন্তার জগতে উৎকর্ষের কদর করা শুধু সৌজন্যের খাতিরে নয়, প্রতিপক্ষের শ্রেষ্ঠ যুক্তিগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করে নিজের চিন্তার বিকাশের জন্যেও প্রয়োজনীয়। তাই রাজনৈতিক মত নির্বিশেষে নিখাদ অর্থনীতির যুক্তির অভিনব প্রয়োগে বেকারের সৃষ্টিশীল কাজ থেকে অর্থনীতিবিদদের অনেক কিছু শেখার আছে বলে মনে হয়। এই সৃষ্টিশীলতার একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। কোনও এক দিন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের ফলে অর্থনৈতিক অনটনের সমস্যার যদি সমাধান হয়ে যায়, সেই ‘সব পেয়েছির দেশ’-এ কি কোনও অভাব থাকবে না? অর্থশাস্ত্র অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে? গ্যারি বেকার বলেছেন, সবচেয়ে মহার্ঘ বস্তু হল সময়, আর সব পেয়েছির দেশেও, দিনের মধ্যে ২৪ ঘণ্টাই থাকবে, আর আমরা নশ্বরই থাকব। তার ওপর প্রাচুর্যের কারণে আমাদের সামনে এত বিকল্প থাকবে, যে সময়ের দাম আকাশছোঁয়া হবে। অর্থাৎ, মানুষের অস্তিত্বের মধ্যেই নিহিত আছে এই মৌলিক দ্বন্দ্ব! এই উপলব্ধির মধ্যে কোথাও যেন দর্শন বা একটু কবিতারও ছোঁঁয়া আছে। অর্থনীতি শাস্ত্রকে আয়-ব্যয়-সঞ্চয় মুদ্রা-মূল্য-মন্দা এ সবের পরিচিত গণ্ডি ছাড়িয়ে সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার করে নতুন নতুন দিগন্তে বিস্তার করে দেবার জন্যে তাই গ্যারি বেকারের অবদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অর্থনীতিবিদেরা ভুলতে পারবেন না, যতই মহার্ঘ হোক তাঁদের সময়।

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস-এ অর্থনীতির শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement