অর্জুন পাখির চোখ দেখিয়াছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখেন রাজনীতি। অসমের মর্মান্তিক গণহত্যার পরেও তিনি সেই রাজনীতিই দেখিয়াছেন। বড়ো হামলার পর যে মানুষগুলি সন্ত্রস্ত হইয়া পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁহাদের স্থায়ী বসবাসের অধিকার দেওয়ার আশ্বাস দিয়াছেন। কথাটি ভাবিয়া বলিয়াছেন কি না, সংশয় হয়। ভাবিয়া মুখ খোলা তাঁহার ধর্ম নহে। কিন্তু, অবিবেচক মন্তব্যই বক্তার ভিতরটাকে দেখাইয়া দেয়। যেমন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিতরে নিজের একটি রাজনৈতিক ভাবমূর্তি রহিয়াছে তিনি গরিবের, অত্যাচারিতের, অসহায়ের মসিহা। চোলাই মদ খাইয়া মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দেওয়া অথবা সারদায় ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফিরাইয়া দেওয়ার আস্ফালন, সবই সেই ভাবমূর্তির পায়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য। বস্তুত, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারি ভাবে যে অবস্থান গ্রহণ করিয়াছে, তাহার সংখ্যালঘু ভোটের ভজনাটি বাদ দিলে মূল চালিকাশক্তি এই অবিবেচনা। প্রশ্ন উঠিতে পারে, সম্পূর্ণ কাণ্ডজ্ঞানবিবর্জিত এই পদক্ষেপগুলিকে কি আদৌ ‘রাজনীতি’র গোত্রে ফেলা চলে? আপাতদৃষ্টিতে না। কিন্তু, বঙ্গেশ্বরীর যেহেতু ইহাই সম্বল, কাজেই অবস্থাগতিকে এমন বিচিত্র কাণ্ডকলাপকেও রাজনীতি বলিতে হইতেছে।
এই রাজনীতির তাড়না প্রবল। সেই তাড়নায় মুখ্যমন্ত্রী বারংবার নিজের এক্তিয়ার গুলাইয়া ফেলেন। বর্তমান ক্ষেত্রেও ফেলিয়াছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। অসম দেশের অন্য একটি রাজ্য। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্য। সেই রাজ্যে কোনও বিপর্যয় ঘটিলে প্রতিবেশীসুলভ কর্তব্যবোধেই তাহার পার্শ্বে দাঁড়ানো পশ্চিমবঙ্গের কর্তব্য। শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয় দেওয়াও সেই কর্তব্যের একটি অংশ হইতে পারে। কিন্তু, তাঁহাদের পশ্চিমবঙ্গে থাকিয়া যাওয়ার উদার আহ্বান জানাইবার মধ্যে বিচক্ষণতার ঘোরতর অভাব রহিয়াছে। রাজ্যের একটি জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা অসম সরকারের কর্তব্য এবং অধিকার। সেই অধিকারে হস্তক্ষেপ করা নিতান্ত অনুচিত। বিশেষত, অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ শরণার্থীদের ফিরাইয়া লইতে তত্পর হইয়াছেন। এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীর হঠকারী মন্তব্য যে বার্তা প্রেরণ করিতেছে, তাহাতে অসমের ক্ষুব্ধ হওয়া অস্বাভাবিক নহে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অসমের সম্পর্ক যে সর্বদা মসৃণ থাকে নাই, এই কথাটি মুখ্যমন্ত্রী না জানিলে তাঁহার জানিয়া লওয়া প্রয়োজন। সেই অতীতের পটভূমিকায় সাবধানে পা ফেলা বিধেয় ছিল। কিন্তু অবিবেচনার কোনও দায় নাই। ফলে, অধিকারের সীমা বা ঔচিত্যবোধের পরোয়া না করিয়াই মুখ্যমন্ত্রী কথা বলিয়া চলিয়াছেন।
শুধু যে অসমের অধিকারে হস্তক্ষেপ করিয়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নিজ এক্তিয়ার লঙ্ঘন করিলেন, তাহা নহে। রাজ্যের ভৌগোলিক সীমার মধ্যেও মুখ্যমন্ত্রীর এক্তিয়ার অসীম হইতে পারে না। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বা অসমের শরণার্থী, যে কোনও জনগোষ্ঠীকে পশ্চিমবঙ্গে ঢালাও আমন্ত্রণ জানাইবার অধিকার তাঁহার নাই। কোন কাজটি তাঁহার সামর্থ্যে কুলাইবে আর কোনটি তাঁহার আওতার বাহিরে, সেই বিবেচনা না থাকাই তাঁহাকে এক্তিয়ারের বাহিরে লইয়া যায়। সারদাকাণ্ডে যেমন তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, সব আমানতকারীর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করিবেন। পরে সিবিআই-এর ঘাড়ে দোষ চাপাইবার শত চেষ্টাতেও তাঁহার অমোঘ ব্যর্থতা ঢাকা পড়ে নাই। এখন তিনি অসমের শরণার্থীদের জমি, বাড়ি হইতে কালো গরুর দুধ, সব কিছুরই আশ্বাস দিতেছেন। অনুমান করা চলে, তাঁহার অন্য অনেক প্রতিশ্রুতির ন্যায় ইহাও হাওয়ায় মিলাইয়া যাইবে। তখন এই শরণার্থীরা যাইবেন কোথায়? গরিবের পার্শ্বে দাঁড়াইবার রাজনৈতিক তাড়নায় তিনি গরিবের কী বিপুল ক্ষতি করিতেছেন, মুখ্যমন্ত্রী ভাবিয়া দেখিতে পারেন।