অপারেশন সানশাইন গত শতাব্দীর অতীত। বিস্মৃত অতীত। ফুটপাথ পথিকের, না হকারের, সেই প্রশ্নের মীমাংসা কলিকাতা পুরসভা বহু কাল আগেই করিয়া ফেলিয়াছে। ফুটপাথ ছাপাইয়া পথও এখন আর কলিকাতায় যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত নয়, সেখানেও হকার তথা জবরদখলকারীদের দাপট। পথচারীরা যদি গাড়ি চলাচলের রাস্তায় আসিয়া পড়েন, এমনকী গাড়ি চাপাও পড়েন, তাহাতে পুরকর্তাদের কিছু যায় আসে না। পথচারী অসংগঠিত, সুতরাং রাজনীতির ময়দানে দুর্বল; হকাররা সংগঠিত, সুতরাং সবল। বামফ্রন্ট জমানায় তাঁহাদের সাংগঠনিক শক্তির বিকাশ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্বে তাহার নূতন স্ফূর্তি। পরিবর্তন হয় নাই, তাহা বলা চলিবে না। হকাররা আগে কমরেড ছিলেন, এখন ভাইবোন হইয়াছেন। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং ‘হকার ভাইবোনদের’ সভা ডাকিতেছেন। এবং সেই সভায় হকারদের আইনি স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছেন, তৎসহ বিমাদি নানাবিধ সুযোগসুবিধাও। পুর বোর্ড ইতিপূর্বেই তাঁহাদের ‘চলমান হকার’ আখ্যা দিয়া এক ধরনের বৈধতা দিয়া রাখিয়াছিলেন। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করিলেন, কাঁচা রসিদ পাকা লাইসেন্সে রূপান্তরিত হইবে।
এই সিলমোহরের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। কলিকাতা পুরসভার নির্বাচন আসন্ন। কলিকাতা শহরে কয়েক লক্ষ হকার। ভোটের হিসাব সহজ সরল। সেই হিসাব কেবল হকারের সংখ্যা দ্বারা নির্ণীত নহে, গরিবদরদি ভাবমূর্তি তাহার একটি বড় উপকরণ। নিউ মার্কেটের দোকানদাররা তিন দিন হরতাল করিয়া যতই হকার-তোষণের প্রতিবাদ জানান না কেন, ‘গরিব’ হকার ভাইবোনদের পাশে তাঁহাদের দিদি আছেন এবং থাকিবেন, এই প্রচার ভোটের বাজারে উচ্চফলনশীল, দিদি তাহা বিলক্ষণ জানেন। কেবল পুরভোট নহে, আগামী বছরে বিধানসভা নির্বাচনের মুখ চাহিয়াও এই দরদের প্রদর্শনী। এই কারণেই ইতিপূর্বে আইনভঙ্গকারী ট্যাক্সি-চালকদের জরিমানা ও শাস্তি লাঘব করিবার সিদ্ধান্তটিও হইয়াছিল। যে ভঙ্গিতে তিনি এই ভাবমূর্তি রচনার কাজটি করিয়া থাকেন, তাহা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। এই সকল ঘোষণার পিছনে কোনও তাত্ত্বিক কাঠামো খুঁজিয়া লাভ নাই, কোনও আলোচনা বা বিতর্কেরও লেশমাত্র নাই, জনতোষণের মন্ত্রগুলি দৈববাণীর ন্যায় বর্ষিত হয়, হরির লুটের বাতাসা ছড়াইয়া পড়ে কৃপাপ্রার্থীর অঞ্জলিতে, তাঁহারা বোঝেন এবং বলেন: সকলই তাঁহারই ইচ্ছা।
কিন্তু জনতোষণের এই নির্লজ্জ এবং অনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি কেন নাগরিকদের ক্ষোভ উৎপাদন করে না? ট্যাক্সিচালক বা হকার বা অন্যান্য বিবিধ গোষ্ঠী শেষ বিচারে গোষ্ঠীমাত্র। তাঁহাদের একটি অংশকে সন্তুষ্ট করিতে গিয়া সরকার এবং পুরকর্তারা যখন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন, তখন বৃহত্তর জনসমাজ কেন প্রতিবাদ করে না? নাগরিক সমাজ কেন তাহার আইনি অধিকার দাবি করে না? অগণিত পথচারী কেন বলেন না, ‘হকার সরাইয়া আমার চলিবার পথ ফিরাইয়া দিন’? অগণিত যাত্রী কেন বলেন না, ‘ট্যাক্সি ভাড়া করিয়া আমার গন্তব্যে পৌঁছনোর অধিকার পূরণ করুন’? তাহার একটি কারণ অবশ্যই এই যে, তাঁহারা অসংগঠিত। কিন্তু তাহার গভীরতর কারণ আছে। কলিকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকরা সাধারণ ভাবে একটি যথার্থ নাগরিক পরিবেশ এবং পরিকাঠামোর অধিকারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন না। সেই অধিকার ক্ষুণ্ণ হইলে সরকার তথা পুরসভার চালকদের ভোটে বিমুখ করিয়া শাস্তি ও শিক্ষা দেওয়া উচিত, এই প্রাথমিক সত্যে তাঁহাদের যথেষ্ট আস্থা নাই। দলীয় আনুগত্য তাঁহাদের নিকট নাগরিক পরিষেবা অপেক্ষা অধিক মূল্যবান। হয়তো বা ‘দরিদ্র-দরদ’-এর প্রচলিত ধারণা তাঁহাদেরও আবিষ্ট করিয়া রাখিয়াছে। বামফ্রন্ট হইতে তৃণমূল, নায়কনায়িকারা তাহার ফসল তুলিতেছেন। বিষবৃক্ষের ফসল।