পায়ে পায়ে। আব্রাহাম-এর স্মারক সৌধ, একটু এগিয়ে নেবুচাদনেজার-এর তৈরি জিগেরাট। ইরাক, ২০০৩।
আইসিস-এর (ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া/লেভান্ত) সুন্নি জেহাদিরা ইতিমধ্যেই দখল করে নিয়েছে ইরাকের অনেকখানি। দখল করেছে মসুল যে শহরের নামেই ‘মসলিন’-এর নাম টাইগ্রিস নদীতীরবর্তী সেই নগরী, নিনেভে প্রদেশের রাজধানী, যা একদা ছিল আসিরীয় সভ্যতার পীঠস্থান। সেখানে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে সম্রাট অসুরবানিপল রাজত্ব করতেন। যে-জনপদ খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে উমায়েদ খলিফাদের অধীনে মেসোপটেমিয়ার রাজধানী হয় এবং ক্রুসেড-খ্যাত সালাদিন থেকে মঙ্গোল দিগ্বিজয়ী হুলাগু খান যাকে লণ্ডভণ্ড করেন।
আইসিস-এর জেহাদিরা সিরিয়া ও ইরাকে একটি যুক্ত ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপনের ব্রত নিয়ে এখন সেই ‘রাষ্ট্র’কে একটি খিলাফত বলেই ঘোষণা করেছে এবং তাদের নেতা আবু বকর আল-বাগদাদিকে নব্য খলিফা নিযুক্ত করেছে। তাদের লক্ষ্য বাগদাদ, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফারা যে-শহরের পত্তন করেছিলেন। সমগ্র মুসলিম বিশ্বের বৌদ্ধিক-সাংস্কৃতিক রাজধানী ছিল এই বাগদাদ, অন্তত ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিজ বংশধর হুলাগু খানের নৃশংস গণহত্যা ও পৈশাচিক ধ্বংসকাণ্ডের আগে পর্যন্ত। আব্বাসীয়রা উমায়েদ রাজবংশকে পরাস্ত করে এই বাগদাদের দখল নিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে খিলাফতকেও দামাস্কাস থেকে এখানে স্থানান্তরিত করেন। পরে অবশ্য তুর্কিরা, ইরানের সাফাবিদ রাজবংশ এবং মিশরের মামলুকরাও পর্যায়ক্রমে বাগদাদ দখল করেন। ১৫৩৩ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান পর্যন্ত বাগদাদ অটোমান শাসনে চলে যায়।
সুন্নি জেহাদিরা যদি শেষ পর্যন্ত শিয়া ইরাকের এই রাজধানীতে পৌঁছতে পারে, তবে আরও এক বার রক্তস্রোতে ভাসতে চলেছে এই মহানগর। অটোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসের আগে যা ছিল মেসোপটেমিয়া, ১৯১৭ সালে তা ব্রিটিশ অধিকারে আসে। জার্মানির পক্ষে যোগ দেওয়ার ‘অপরাধে’ অটোমান সাম্রাজ্যকে খণ্ড খণ্ড করার সময় লিগ অব নেশনস-এর ‘আদেশ’ নিয়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্স জারের রাশিয়ার সম্মতিতে মেসোপটেমিয়া ও সিরিয়ায় যে ‘বানরের পিঠে-ভাগ’ শুরু করে, সেই প্রক্রিয়ারই পরিণাম আজকের ইরাক, সম্পূর্ণ একতরফা ভাবে যার ভৌগোলিক সীমান্ত নির্ধারিত হয় বিভিন্ন জাতিসত্তা ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অভিপ্রায়কে উপেক্ষা করে। আর শিয়া-প্রধান সেই রূপান্তরিত মেসোপটেমিয়ার উপর ততটাই একতরফা ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয় হাশেমীয় সুন্নি রাজবংশকে। সংখ্যালঘু সুন্নি নেতৃত্বকে সমর্থনের পাশাপাশি বসরা প্রদেশ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় কুয়েতকে (যার উপর পরবর্তী কালে ইরাকের অধিকার দাবি করে সাদ্দাম হুসেন যুদ্ধ করেন, সিনিয়র জর্জ বুশ পাল্টা-যুদ্ধ)। ধাত্রী ব্রিটেনের হাতে ইরাকের জন্মের মধ্যেই উপ্ত হয়েছিল আজকের বিষবৃক্ষের বীজ।
ওই সংখ্যালঘু সুন্নি প্রাধান্যের নিরবচ্ছিন্নতাই ‘বাথ পার্টি’র তথাকথিত সমাজতন্ত্রী রাজনীতি ও আরব জাতীয়তাবাদের হাত ধরে সাদ্দাম হুসেনের ক্ষমতা দখল ও স্বৈরাচারের পথ প্রশস্ত করে, শিয়া-প্রধান প্রতিবেশী ইরানের সঙ্গে আট বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও সংঘটিত করে। মার্কিন আগ্রাসনে উচ্ছেদ সুন্নি সংখ্যালঘু নেতৃত্ব সাদ্দামকে হারালেও কোনও মতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের ক্ষমতারোহণ মানতে পারেনি। ইরাকের দখল ফিরে পেতে তারা জেহাদি গোষ্ঠীতে নাম লিখিয়েছে। এই গোষ্ঠীই আজ অন্যান্য ছোট জেহাদি গোষ্ঠীকে গ্রাস করে সিরিয়া ও ইরাকে তাদের দখলে থাকা ভূখণ্ডে নব্য খলিফাতন্ত্র কায়েমের কথা ঘোষণা করেছে। পশ্চিম এশিয়ার রণাঙ্গন এখন আর জায়নবাদ বনাম প্যালেস্টিনীয় আত্মশাসনের প্রতিদ্বন্দ্বে সীমাবদ্ধ নয়। এখন তা ইসলামের ধ্রুপদী বিভাজন শিয়া বনাম সুন্নির এলাকা দখলের দ্বৈরথে পর্যবসিত।
এই প্রসারিত রণাঙ্গনের দিকে এক নজর তাকালেই চোখে পড়ে, নজর কাড়ে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ সব নাম। গোটা মেসোপটেমিয়াই ছিল মানবসভ্যতার ঋদ্ধ সূতিকাগার। সুমের ও আক্কাদীয় সভ্যতার এই জন্মস্থান খ্রিস্টজন্মের আড়াই হাজার বছরের বেশি আগে থেকে ক্রমবিবর্তিত। সেই সভ্যতারই অন্যতম পথিকৃত্ উরুক সম্রাট মহামতি গিলগামেশ, যিনি পরে মহাকাব্যের নায়ক হয়ে ওঠেন এবং সুমেরীয় উপকথায় দেবতার মর্যাদা পেতে থাকেন। এই ভূখণ্ডেই যখন ব্যবিলনীয় সভ্যতার যাত্রা শুরু, তখন সুমেরীয় ও আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের ভূভাগ, সংস্কৃতি ও ভাষার সমন্বয় ঘটিয়ে ১৮৯৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হামুরাবি তাকে নতুন দিশা দিলেন আর মানবসভ্যতাকে দিলেন তার প্রথম লিখিত কোড বা আইনবিধি। বর্তমান ইরাক তথা মেসোপটেমিয়ার উত্তরাংশেই গড়ে উঠেছিল আসিরীয় সাম্রাজ্য অসুরবানিপল (যিনি নিনেভেতে বানিয়েছিলেন তখনকার বৃহত্তম গ্রন্থাগার) থেকে নেবুচাদনেজার (যিনি খ্যাত হয়ে আছেন ব্যবিলনের ‘শূন্যোদ্যান’ নির্মাণের জন্য)। মাঝেমধ্যেই মেসোপটেমিয়ার উপর হামলে পড়েছে পারসিক সম্রাটদের আক্রমণ সাইরাস দ্য গ্রেট, দারিয়ুস কিংবা জারেক্সেস-এর সেনাবাহিনী। কখনও ম্যাসিডোনিয়ার দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারের অশ্বারোহীরা। তৃতীয় শতক থেকে মেসোপটেমিয়ার দখল চলে যায় সাসানিদ বংশীয়দের হাতে, চলে ৬৩৮ সালে মুসলিম আব্বাসীয় বিজয়ের আগে পর্যন্ত।
ভেসে উঠছে বসরা-র নাম, যা শুধু গোলাপ বা মুক্তোর জন্যই প্রসিদ্ধ নয়, সুমেরীয় সভ্যতার অন্যতম এই পীঠ আরব্য রজনীর নাবিক সিন্দবাদ-এরও দেশ, বাগদাদ যেমন খলিফা হারুন-আল-রশিদ ও তাঁর নবপরিণীতা শেহরাজাদির প্রেমোপাখ্যানের। শুধু তা-ই বা কেন? এই বাগদাদেই তো খলিফা হারুন তৈরি করেছিলেন তাঁর জ্ঞানমন্দির ‘বায়াত-আল-হিকম’ যেখান থেকে মধ্যযুগীয় জ্ঞানবিজ্ঞান, গণিত-রসায়ন, দর্শন-ধর্মশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, কাব্যসাহিত্যের রচনা, আলোচনা, বিতর্কের ছটা এক দিকে দূর প্রাচ্য, অন্য দিকে ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এই প্রদেশেরই আনাচেকানাচে একসময় ঘুরে বেড়িয়েছেন ভূপর্যটক ইবন বতুতা। এখন সেখানে ‘খলিফা’ হতে চাওয়া আবু বকর আল-বাগদাদির হার্মাদরা সঙিন আস্ফালন করছে। তাঁর অনুগামী সুন্নি জেহাদিদের সঙ্গে কির্কুক শহরের তৈলক্ষেত্রের দখল নিয়েও সরকারের ধুন্ধুমার লেগেছে। সেই কির্কুক, যা একদা আসিরিয়ার প্রাচীন রাজধানী ছিল। দীর্ঘ কাল ধরে এই কির্কুক আসিরীয়, ব্যবিলনীয় ও মিদিও সভ্যতার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা সহ্য করেছে। তার পর সাসানিদ, সেলজুক তুর্কি, মঙ্গোল ও অটোমান তুর্কিরাও পালা করে শাসন করেছে এই জনপদ। তখনও খনিজ তেলের অফুরান ভাঁড়ার এর ভূগর্ভে আবিষ্কৃত হয়নি।
বিগত পাঁচ হাজার বছর ধরেই সুমের, মেসোপটেমিয়া, আসিরিয়া, ব্যবিলনের প্রান্তর রক্তস্নাত, বিধ্বস্ত হয়েছে। তার সর্বশেষ ধ্বংসলীলা সংসাধিত হয় ‘বুশ’ পদবিধারী মার্কিন পিতাপুত্রের হাতে, ইরাককে যাঁরা উপর্যুপরি বোমারু হামলায় পুরাপ্রস্তর যুগে পাঠিয়ে দেন। আজ সেই মার্কিন-পাশ্চাত্য প্রশাসনের বসানো পুতুলদের আধিপত্য ছুড়ে ফেলতে চাইছে সুন্নি জেহাদিরা। তাতে মেসোপটেমিয়ার হৃত গৌরব ফিরবে না। ইসলামি খিলাফতের বর্ণময় রৌদ্রচ্ছটাও কি ফিরবে? ‘পৃথিবীর এই গল্প বেঁচে রবে চির কাল’? তা কী করে হবে! ‘এশিরিয়া ধুলো আজ ব্যবিলন ছাই হয়ে আছে’।