নিগ্রহ তো জন্ম-ট্যাগ হয়ে সেঁটে থাকে মেয়েদের চামড়ায়। গ্লোবাল ব্যাপার সেটা। নরম, গরম, চরম। এই দেখুন না, কখনও মেয়েদের মারকিউরিক ক্লোরাইড খাইয়ে দেয়া হল লস্যি ও শসা-সহকারে, আদর করে। আবার, হাত-পা মুড়ে, কখনও বা ডিজাইনার ড্রেসের সঙ্গে জন্মের শোধ দেয়াল-আলমারিতে তুলে রাখা হল। কিংবা, ‘আজ আর তন্দুরি-চিকেন নয়, তন্দুরি-বিবি লাগাও টেবিলে’, এই অভীপ্সায় পুরে দেওয়া হল জ্বলন্ত আভেনে। এত দিনে গ্যাসে, স্টোভে, কেরোসিনে পুড়িয়ে মারার ‘তরিকা’ ম্লান হতে চলেছে প্রায়। প্রজন্ম নির্মম হয়। হাই-টেক হয়। আরও শিকড়হীন হয়। দেশি-বিদেশি সিনেমার ভয়ংকর সব ভায়োলেন্সের পাকা রং ধরে যায় মনে। ধর্ষণ করেও ক্ষান্ত থাকে না পুরুষ। বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খুবলে, বাইরে বের করে এনে বীভত্স উল্কি এঁকে, চিরতরে চুপ করিয়ে দেয় ধর্ষিতা নারীকে। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের কথা আর আলাদা ভাবে এখানে না-ই তুললাম।
অ্যাসিড। ল্যাবে নয়। গবেষণার কাজেও নয়, প্রযুক্তিতে নয়। কীটনাশক, জীবণুনাশক, তার এই ধ্বংসাত্মক ধর্মকে চমত্কার ভাবে কাজে লাগিয়ে মেয়েদের ধমকানো হয়, ‘না’ বলার অপরাধে, পৌরুষের অঙ্গে কালি ছিটোনোর অপরাধে। খুব মৃদু নয় এই ধমক। মেয়েজীবন, ওলটপালট করে, সম্পূর্ণ বিস্রস্ত বিপর্যস্ত করে দিয়ে যায় একেবারে। ‘মেয়েজীবন’ শব্দটি উল্লেখ করলাম খুব হিসেব কষেই। কখনও কি দেখেছেন, দাঙ্গাহাঙ্গামায় পুরুষ পুরুষের দিকে অ্যাসিড ছুড়ে মারছে? জাতশত্রুরা পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লাঠি, বল্লম, পাইপগান, এ কে ৪৭, পথে-মাইন পাতা, ইত্যাদি সব রকমের মৃত্যুবাণ নিয়ে লড়াই চালায়। জন্ম নেয় হাতকাটা বিশু, খোঁড়া দিলীপ, একচোখ বিনোদ। কিন্তু, অ্যাসিড? এই সব যুদ্ধবিগ্রহে তো অ্যাসিড ছোড়াছুড়ি, গায়ে ঢেলে দেওয়ার সিন শুনিনি কিংবা পড়িনি কখনও। বড় বিস্ময় লাগে। মানে, লাগত। বিয়েতে রাজি না হওয়া, প্রায়-কিশোরী মেয়েকে অ্যাসিড ছুড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় এক যুবক। ওই মুখ নিয়ে আর বাড়ির বাইরে পা বাড়াতে পারে না সেই মেয়ে। এনসিসি-র কৃতী ক্যাডেট অষ্টাদশীকে অ্যাসিড ছুড়ে মারে তাঁরই পাড়ার তিন যুবক। প্রাণে বাঁচলেও জীবন নষ্ট হয়ে গেছে তাঁর। পরিসংখ্যান অসংখ্য। এবং বিরাম নেই সেই সংখ্যা-মিছিলের। এই তো সে দিন আবার এক মহিলাকে অ্যাসিড ছুড়ে মারল এক যুবক, কুপ্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ার পরাজয়ে, রাগে। মহিলা অংশত দৃষ্টিহীন হয়ে বেঁচে রইলেন। লাগাতার এই খবরগুলো পড়ি। শুনি, দেশের বিভিন্ন অংশে মহিলাদের উপরে অ্যাসিড হানার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয় সুপ্রিম কোর্ট। অ্যাসিড বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেয়।
বৈদ্যুতিন মাধ্যমে এই অ্যাসিড-কথা নিয়ে টক-শো চলছিল। শুনছিলাম। আর, মনের মধ্যে এই ভাবনাটাই নাড়াচাড়া করছিলাম, মেয়েদের তাক-করা ছাড়া অন্যান্য হিংস্রতায় অ্যাসিড নিষ্ক্রিয় কেন? হঠাত্ কানে এল, এক ভদ্রমহিলা বলছেন, ‘কতখানি বিকৃতমনস্ক হতে পারে এক জন পুরুষ! যা আমি নিজে ভোগ করতে পারব না, তা অন্যকেও ভোগ করতে দেব না, ভেবে অ্যাসিড ছুড়ে মারল মেয়েটাকে।’ বিদ্যুত্চমকের মতো মাথায় আলো হয়ে নেমে এল একটা সূত্র। আমরা যখন বাজার করতে নামি, কেউ কি জেনেবুঝে কানা বেগুন কিংবা পোকাধরা ফুলকপি কিনব? মেয়েরা তো ঠিক সে-রকমই, এ বাজারে ভোগ্যপণ্য বই তো আর কিছু নয়। যতই মেরু-অভিযান করুন না কেন, শৃঙ্গ-বিজয়িনী হোন না কেন, পুরুষের মূলধন যেমন পৌরুষ, মেয়েদেরও মূলধন একটিই। সৌন্দর্য। তাকে নষ্ট করে দিলে, সেই মেয়ে তো চিরকালের মতো বাজারে অচল। পুরুষকে খুঁতো করে দেওয়ার মধ্যে কোনও প্রতিহিংসার নিবৃত্তি ঘটে না, কারণ কুত্সিতদর্শন পুরুষের মাচো ইমেজে একটুও টোল পড়ে না তাতে। কিন্তু মুখচুম্বন করতে না দেওয়ার দোষে মুখ পুড়িয়ে দেওয়া হল যে মেয়ের, তার দিকে তো আর ফিরেও তাকাবে না কেউ। সৌন্দর্য চলে গেলে জীবনে কী-ই রইল তার, এই ভেবে ‘হায়! হায়!’ করে উঠবে সমাজ, সংসার।
তাই, পৌরুষে ঘা-খাওয়া পুরুষ, চাঁদ চাইলেও তাকে পেড়ে এনে দেওয়া হবে এই দর্শনে পুষ্ট-হওয়া পুরুষ, তাকে প্রত্যাখ্যান করার চরম অপরাধে অপরাধিনী মেয়েটিকে কী করে? তার যে ইউএসপি যুগে যুগে লালন করে এসেছে শিল্প-সংস্কৃতি-ইতিহাস-সমাজ, সেই সৌন্দর্যকে হানে চরমতম লাঞ্ছনা। আজ যদি বলি, অ্যাসিড আসলে পুরুষতন্ত্রেরই অকৃত্রিম আয়ুধ, খুব কি ভুল কথা বলা হবে?