নরেন্দ্র মোদী গাঁধীমূর্তিতে মাল্যদান করিয়াছেন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও হয়তো করিবেন। সেই মাল্যদানের মুহূর্তে তাঁহাদের কি মনে পড়িবে যে চশমা, লাঠি অথবা চরকাই গাঁধী নহেন, এই প্রতীকগুলির ঊর্ধ্বে যে মানুষটি, সেই মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর মূল গুরুত্ব তাঁহার (জীবন)দর্শনে? সেই দর্শনে হিংসার ঠিক কী প্রকার স্থান ছিল? গাঁধীর দর্শন কেন, সাধারণ উদারবাদী রাষ্ট্রিক দর্শনে বিশ্বাস করিলেও বলিতে হয়, কোনও পুলিশ কনস্টেবল গুলি চালাইয়া এক জন মানুষকে মারিয়া ফেলিলে সেই দায় শুধু সেই পুলিশকর্মী, অথবা পুলিশবিভাগের উপর বর্তায় না। রাজ্যের প্রশাসনের শীর্ষ অবধি সেই দায় প্রবাহিত হয়। অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার অনুগত প্রশাসন নিশ্চয় যুক্তি দিবেন, পুলিশের গুলিতে নিহত যুবকের স্ত্রীই যখন মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আস্থাজ্ঞাপন করিয়াছেন, তখন আর দায়ের প্রশ্ন আসে কী ভাবে? ঘটনা হইল, বিবেক তিওয়ারির স্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীকে ভরসা করিতেই পারেন। কেন, সেই কারণ সন্ধান নাগরিক সমাজের কাজ নহে। কিন্তু, প্রশ্নটি বিবেক তিওয়ারি নামক এক যুবকের পরিবারের কর্তব্য-অকর্তব্য ছাপাইয়া আরও বড় পরিসরের। প্রশ্নটি, রাষ্ট্রের বন্দুকের সহিত নাগরিকের সম্পর্কের। রাজ্যে এক জন সাধারণ নাগরিককে দুই পুলিশকর্মী নির্দ্বিধায় মারিয়া ফেলিতে পারিলে মুখ্যমন্ত্রীকে জবাবদিহি করিতে হইবে বইকি।
যোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধবাদীদের মুখে একটি প্রশ্ন শোনা যাইতেছে: বিবেক তিওয়ারি কি সন্ত্রাসবাদী ছিলেন যে তাঁহাকে এই ভাবে মারা হইবে? প্রশ্ন হইল, কোনও সন্ত্রাসবাদীকেও কি এই ভাবে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করিবার অধিকার পুলিশের রহিয়াছে? শাস্তিবিধান পুলিশের দায়িত্ব নহে, তাহার জন্য আদালত আছে। সন্ত্রাসবাদী হইলে তাহাকে মারিয়া ফেলা যায়, দুর্ভাগ্যক্রমে এমন একটি বিপজ্জনক অবস্থানকে সে রাজ্যের প্রশাসনই স্বীকৃতি দিয়াছে। প্রসঙ্গত, নিহত বিবেক তিওয়ারি যদি ধর্মে মুসলমান হইতেন, বা দলিত পরিচিতির মানুষ, তবে যোগী প্রশাসন তাঁহাকে ইসলামি জঙ্গি অথবা মাওবাদী ছাপ দিয়া হত্যাকাণ্ডটিকে বৈধ প্রতিপন্ন করিতে সচেষ্ট হইত কি না, সেই প্রশ্নও আজ ভিত্তিহীন নহে। পুলিশকর্তারা গোড়ায় কনস্টেবলের আত্মরক্ষার তত্ত্ব খাড়া করিতে চাহিয়াছিলেন। পরে মানিয়া লইয়াছেন, বীরপুঙ্গবদ্বয় এক্তিয়ারের সীমা অতিক্রম করিয়াছিল। তাহাদের চাকুরি গিয়াছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হইলে তাহারা হয়তো জেলও খাটিবে। কিন্তু, তাহাদের শাস্তির ব্যবস্থা করিলেই কি দায় ফুরাইয়া যায়? কোন প্রশাসন তাহাদের মনে এমন অধিকারবোধ তৈরি করে যে রাতবিরেতে গাড়ি থামিতে অস্বীকার করিলে তাহারা গুলি চালাইয়া দিতে দ্বিধা করে না? উত্তরপ্রদেশে সাজানো এনকাউন্টারে যোগী আদিত্যনাথের আমলে নিহতের সংখ্যা লইয়া ইতিমধ্যেই শোরগোল উঠিয়াছে। পূর্বতন প্রশাসনে অপরাধীদের যথেষ্ট পরিমাণ দমন করা হইত না, এই যুক্তিতে যোগী প্রশাসন যে ভাবে বন্দুকের যথেচ্ছ ব্যবহার করিতেছে, তাহা দেশব্যাপী সমালোচনার লক্ষ্য। কিন্তু সমালোচনায় যোগী প্রশাসনের হেলদোল থাকিবার কথা নহে। গোরক্ষা হইতে সাধারণ আইনশৃঙ্খলা, সকল ক্ষেত্রেই তাঁহাদের বন্দুকের অপার অধিকার উত্তমরূপে প্রতিষ্ঠিত। ইত্যবসরে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ মহাত্মা গাঁধীর জন্মোৎসব পালন করিতেছেন।