গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কথায় আছে, পৃথিবীর চাকা ঘোরে, তবে খুব আস্তে আস্তে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা আচরণ, ভাবনা, কথার পিঠে চাপিয়ে দেওয়া কথা এসবেরও পরিবর্তন আসে। আজ না হোক কাল। এবারে এসেছে বিশ্বজোড়া তুমুল হইচইয়ের মাঝখানে। বর্ণবৈষম্য যখন আজ সবচেয়ে বড় জ্বলন্ত ইস্যু সারা পৃথিবীতে। তার জেরেই তবে অন্তত এটুকু হোক।
যে খবরটা পড়ে সহসা বেশ পুলকিত হওয়া গেল সেটা এই— ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি নামের ক্রিমটির জনকেরা হঠাৎ জেগে উঠেছেন, মহোদয়দের খেয়াল হয়েছে প্রোডাক্টের গায়ে ‘ফেয়ার’ শব্দটি নেহাতই রাজনৈতিক ভাবে বেঠিক হয়ে গেছে। এই মাল্টি মিলিয়ন ইন্ডাস্ট্রিটির চেতনা হয়েছে, বর্ণবিদ্বেষ বহাল রাখার পক্ষে এই ‘ফেয়ার’ শব্দটি জ্বল জ্বল করে সওয়াল করেছে গত কয়েক দশক ধরে। কোটি টাকার মুনাফার পর বিশাল আত্মোপলব্ধি। জর্জ ফ্লয়েড আমেরিকায় মরিয়া প্রমাণ করিলেন যে, বর্ণবিদ্বেষ মরে নাই। আমেরিকার বুক থেকে এই সমাজ কাঠামোয় বদ্ধমূল ভাবে চেপে বসে যাওয়া বিষটি আজও সমূলে উৎপাটন করা যায়নি। এতদিন ধরে অসংখ্য নিপীড়ন অত্যাচার ও মৃত্যুর সারি তা বলে দিচ্ছিল কিন্তু সবাই উদাসীন ছিলেন। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুকালীন কাতরোক্তি "আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না"— পথচারীদের ভিডিওতে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ার পর বিপুলভাবে নাড়া দিয়ে গেল সর্বত্র। দেশ জুড়ে আগুন, অন্যান্য দেশেও আন্দোলন। ব্রিটেনে ছুড়ে ফেলা হল তথাকথিত বিখ্যাতের মূর্তি, যিনি আফ্রিকা থেকে দাসদের এনে কেনাবেচা করে ধনী হয়েছিলেন। আমাদের অন্তত এইটুকু প্রাপ্তি, যে, বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপনে আর প্রডাক্টের নামে, কটকট করে চেয়ে থাকা ফর্সা প্রীতি আর কালো চামড়ার প্রতি বিদ্বেষ এক্ষণে একটু কমতির দিকে যাবে। অন্তত, চোখে তো লাগবে না!
কালো রং কে ‘ময়লা রং’ বলা যবে থেকে শুরু, আর কালো মেয়ের বিয়ে না হওয়ার গল্পগুলো যবে থেকে সমাজে আছে, যেদিন থেকে সমস্ত কাগজে ‘পাত্রী চাই’-এর বিজ্ঞাপনে ‘ফর্সা সুন্দরী গৃহকর্মনিপুণা’দের চাহিদা, সেদিন থেকেই আমাদের সমাজ কালোকে অচ্ছুৎ, অপবিত্র বা অপরিচ্ছন্নের দিকে রেখেছে, আর এইসব ক্রিম বিক্রেতারা তো শুধু সেটার সুযোগ নিয়েছেন, ব্যবহার করেছেন এই মানসিকতাকে। গাত্রবর্ণ দিয়ে মানুষের মূল্য নির্ধারণ আর বিশেষ করে বিবাহযোগ্য কন্যাদের ক্ষেত্রে, এইটেই মেয়েদের পণ্য মনে করার বড় প্রমাণ হয়ে রয়ে গিয়েছে। আর ক্রমশ বিজ্ঞাপনের সর্বগ্রাসী ছোঁ থেকে যেহেতু কেউ বাঁচি না, যুগের পর যুগ বহাল কুৎসিৎ শ্বেতাঙ্গ প্রীতিটাই আধুনিক যুগের পহেচান হয়ে রয়ে গেছে।
ছবি: সংগৃহীত।
আমার দক্ষিণ ভারতীয় বান্ধবী বলেছিল, দক্ষিণ ভারতে প্রায় সবার রঙ চাপা, কৃষ্ণত্ব সেখানে নতুন নয়। তবু সেই সমাজও চূড়ান্ত বর্ণবিদ্বেষী, সেই সমাজেও মেয়েদের হীনম্মন্যতার কারণ তাদের গায়ের রং। সেখানেও ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির বিক্রি খুব... আহা , ভাবা যায় এমন একটা কোম্পানি খোলার কথা, যা বেঁচেই আছে বর্ণবিদ্বেষের ওপরে?
আরও পড়ুন: লাদাখে সেনা কমাচ্ছে চিন, কিন্তু সরাচ্ছে না ছাউনি, বলছে দিল্লি
আমার মনে পড়ে যাচ্ছে, ১৯৯২-৯৩... সদ্য কবিতা লিখতে এসেছি, আর পত্রিকার পাতায় মেয়েদের ত্বক নিয়ে মাতামাতি দেখতে দেখতে, খুব প্রেমসে লিখে ফেলেছি, "বিশেষ ত্বক সংখ্যা" নামে একটি কবিতা। "ত্বকের বিশেষ কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই। দ্রুত উন্নত ত্বকের জন্য প্রয়োগ করুন স্নিগ্ধ কল্পভাষা : দি অরিজিনাল।" সেই কবিতার একটি লাইন লিখে কলার তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছি, "ত্বক মানে বর্ণগুচ্ছ, শেড কার্ড" ... চারিপাশে দেওয়ালের রং অর্থাৎ ডিস্টেম্পার কালারের বিজ্ঞাপনে শেড কার্ড দেখার অভিজ্ঞতা থেকে, লাইনটি এনেছি ত্বকের ক্ষেত্রেও। ভেবেছি কী স্মার্ট লাইন। ও মা, কদিন পরেই দেখি এক ত্বক ফর্সা করার ক্রিমের বিজ্ঞাপন মেয়ে পত্রিকার পাতায়। চামড়ার শেড কার্ড ও বাজারে এসে গিয়েছে। মিলিয়ে নিন আপনার রং, সেটা গমরঙা না চকোলেট বাদামি নাকি অতিশ্বেত বা অতিবাদামি... ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজের গালের পাশে শেড কার্ড রেখে নিজেই বেছে নিন সঠিক রঞ্জক। না কোন অতিরঞ্জন না। ত্বক এখনো আমাদের অনেক কিছুকেই নির্ধারণ করে চলেছে।
আরও পড়ুন: চিনা চ্যালেঞ্জ সামলাতে এশিয়ায় সেনা বাড়াচ্ছে আমেরিকা
এটা বলতেই হবে, আজ যদি ‘ফেয়ার’ শব্দটি প্যাকেটের গা থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয় তাহলেও ‘লাভলি’ শব্দের পরতে পরতে মানুষের সামাজিক মনটার ভেতরকার সেই ফর্সা সুন্দর -টাই থেকে যাবে। কালো মানেই, ‘সুন্দর নয়’, এমন সরলীকরণ থেকে যাবে। যেমনস কালো ইজ ইকুয়াল টু খারাপ, এটাও থেকে গেছে। প্রতিবাদী ডিপি কালো করি আমরা। ব্ল্যাক শিপ আর অন্ধকার মন— সেই কালো -খারাপের সমীকরণ এতদিন সবার জানা। ‘ফেয়ার’ শব্দটার আরো ধার, ফেয়ার হতে হবে— এই বাধ্যতা তার সঙ্গে মিশে আছে। বিশেষত মেয়েদের! নইলে পাত্র পাবে না যে।
ছবি: সংগৃহীত।
বাইরে শব্দটা উঠিয়ে দেওয়া হল, একে দু’হাত বাড়িয়ে গ্রহণ অবশ্যই করব।কিন্তু সেইদিন খুশি হব সত্যি যেদিন বিবাহের বিজ্ঞাপন থেকে শব্দটা যাবে, মানুষের মন থেকে যাবে। নইলে এটা ত নিছক লিপ সার্ভিস। কোটি টাকার ব্যবসাটি খোয়াবেন না ত, কেউ। তা সে ইউনিলিভার হোক বা অন্যরা (অনুরূপ প্রোডাক্ট আরও অনেকের আছে বইকি)... সুস্থ ত্বককে প্রমোট করার বদলে কেমিক্যাল দিয়ে পালিশ করা ত্বকের এহেন বিজ্ঞাপন— তার থেকে শরীরের ক্ষতির পরিমাণ আমরা না জেনে থাকতেই পারি, জানতেই পারি না কতটা রাসায়নিক এভাবে নিয়মিত ব্যবহার করলে থেকে যায় ত্বকের গুরুতর রোগ এমনকি ক্যানসারেরও সম্ভাবনা। আর মনের ক্ষতি তো হয়েই চলেছে। এমনকি ভাল চাকরি পেতেও ‘পরিষ্কার রং’ থাকার প্রয়োজন, এ কথাও এঁদের বিজ্ঞাপনে অকপটে বলা চলছে। সেখানে একটি শব্দ নয়, পরিবর্তন চাই মৌলিকভাবে, ভেতর থেকে। সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ বোধ হয়।