প্রবন্ধ ১

ক’জন মিতার জন্য ন্যায় চাইব তবে

এ হল মেয়ে হয়ে জন্মানোর জরিমানা। নইলে আর কী ভুল হয়েছিল তার? কী না করেছে সে? গরিব ঘরের মেয়ে, টিউশন করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share:

এ হল মেয়ে হয়ে জন্মানোর জরিমানা। নইলে আর কী ভুল হয়েছিল তার? কী না করেছে সে? গরিব ঘরের মেয়ে, টিউশন করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। বিয়েবাড়িতে প্রেমে পড়েও দু’বাড়ি থেকে সম্মতি নিয়ে বিয়ে করেছে। অল্পশিক্ষিত, অল্প-রোজগারের পাত্র, সাধারণ সংসার বেছে নিয়েছিল সে। তা-ও কয়েক মাস না যেতে থেঁতলানো মুখ, রক্তাক্ত দেহ। মিতা মণ্ডল এখন কেস নম্বর।

Advertisement

এখন রব উঠেছে, ‘জাস্টিস ফর মিতা।’ ক’টা মিতার জন্য ন্যায় চাইব? ভারতে প্রতি ঘণ্টায় একজন মেয়ে মরে পণ দিতে না-পেরে। এ-ও স্রেফ পুলিশের খাতার হিসেব। ‘দুর্ঘটনা’ বলে যা লেখা হয় পুলিশের খাতায়, তার কতগুলো খুন কে দেখছে? মনিপালে এক গবেষক দেখেছিলেন, যে সব কেস পুলিশের খাতায় ‘স্টোভ ফেটে মৃত্যু,’ সে সব বাড়ির ২৯ শতাংশে কেরোসিন স্টোভই নেই। রান্না হয় গ্যাসে। বেঙ্গালুরুতে একটি সংস্থার খোঁজখবরের ভিত্তিতে একশোরও বেশি ‘দুর্ঘটনা’-কে ‘বধূহত্যা’ বলে ফের তদন্ত শুরু করতে বাধ্য হয় পুলিশ। মুম্বইয়ের তিনটি হাসপাতালে ১৫ জন দগ্ধ মেয়ের সঙ্গে কথা বলে একটি সংস্থা দেখেছে, পুলিশকে ‘দুর্ঘটনা’ বললেও তাদের সাত জন নির্যাতনের জেরে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করেও পুলিশকে এড়াতে চায় মেয়েরা।

কিন্তু মৃত্যু এড়াতে পারে না। প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে পুরুষদের চাইতে মেয়েদের জন্য বেশি বেড রাখা থাকে বার্ন ওয়ার্ডে। ভারতে ১৫-৩৪ বছর বয়সিদের মধ্যে যত পুরুষ মারা যায় আগুনে, মেয়েরা মরে তার তিনগুণ। তার পর হিসেব করুন গলায় দড়ি, ফলিডল আর অ্যাসিড খাওয়া মেয়েদের। তারও অধিকাংশ স্রেফ ‘আত্মহত্যা’ বলে লেখা হয়।

Advertisement

আর এই যে পুজোর মধ্যে মারা গেল মিতা, আর তার মতো নানা জেলার আরও পাঁচটা মেয়ে, এ-ও কিন্তু ছকে বাঁধা। বেঙ্গালুরুর ‘বিমোচনা’ সংস্থা দেখেছিল, সেখানে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের বার্ন ওয়ার্ডে প্রতিদিন গড়ে সাতটি মেয়ে আসে, আর পুজো-উৎসবের মরসুমে আসে দিনে দশটা। খোঁজ করে জেনেছিল, ওই সময়ে মেয়েরা বাপের বাড়ি আসে। তখনই বাড়তি টাকার চাহিদাটা বলে পাঠানো হয়। খালি হাতে ফিরলেই স্টোভ, সিলিন্ডার ফাটে। কর্নাটকের তিনটি গ্রামে গবেষকরা সমীক্ষা করে দেখেছেন, শ্বশুরবাড়ির রেস্ত যত বেশি, তত বেশি নির্যাতিত হয় বধূ। আরও বেশি টাকা আদায়ের তাগিদ থেকে। তাঁদের গবেষণাপত্রের নাম, ‘টেরর অ্যাজ আ বার্গেনিং ইনসট্রুমেন্ট।’ সন্ত্রাস দিয়ে দরাদরি। পণপ্রথা হল আদি ও অকৃত্রিম সন্ত্রাস।

এ সবই জানা কথা। তবু মিতার মৃত্যু নড়িয়ে দিয়েছে শহুরে মধ্যবিত্তকে। ‘লিবারাল, এডুকেটেড, এমপাওয়ারড’ মুখোশখানা খসে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে নির্লজ্জ লোভের দাঁত-বার করা চেহারাটা। এরাই লেকচার দেয়, মেয়েদের পড়াশোনা করতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সে কথায় ভরসা রেখে গরিব মায়েরা উদয়াস্ত খেটেও মেয়েকে স্কুল-কলেজে পাঠিয়েছে। বাবা-দাদারা আগলে পৌঁছে দিয়ে এসেছে, নিয়ে এসেছে। কিন্তু বিয়ের সময় বোঝা যাচ্ছে, কোনও বিনিয়োগ যথেষ্ট নয়। পরীক্ষার মার্কশিট, কম্পিউটার দক্ষতা, ভাল চাকরি, কিচ্ছুটি না। এমনকী দু-পাঁচ বছরের প্রেম করাও জলে যাবে, যদি মেয়ে হওয়ার জরিমানাটি না দিতে পারে। পড়াশোনা করে লাভ কী হল তবে? এ প্রশ্ন শুনে একটি জেলার পুলিশ কর্তা (এসপি) বলছিলেন, ‘এত ডাউরি ডেথ কেন জানেন? শিক্ষিত মেয়েরা একটু ইমোশনাল হয়।’ তিনি যত পণমৃত্যু দেখছেন, বেশির ভাগই আত্মহত্যা। ইস্কুলে গিয়ে মুখ বুজে লাথি-ঝ্যাঁটা খেতে ভুলে যাচ্ছে মেয়েরা।

‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও,’ স্লোগানটা যে সরকারি রসিকতা, বাপ-মা সেটা হয়তো আন্দাজ করেন। ১৯৮১ থেকে ২০১১ সাল জনগণনার সঙ্গে জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য মিলিয়ে গবেষকরা বলছেন, যে সব রাজ্যে পণমৃত্যু দিনে একটার কম, শিশুকন্যার অনুপাত সেখানে বেড়েছে। যেমন পঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল, তামিলনাড়ু, গুজরাত। যেখানে মৃত্যু তার বেশি, সেখানে কমেছে কন্যারা। যেমন উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ। যত না-জন্মানো মেয়ে, তাদের হিসেবটা ধরলে কোথায় দাঁড়ায় পণের বলি? কোনও যুদ্ধ, মহামারী এত প্রাণ নেয়নি, যা নিচ্ছে ভারতে পুরুষের পণের খাঁই।

বেঁচে আছে যে মেয়েরা, সক্ষমতা আর অসহায়তার দোলাচলে কী ভাবে দিন কাটায় তারা? তার সূত্র জোগাতে পারত সাহিত্য, নাটক, সিনেমা। সেখানে পণ নিয়ে আশ্চর্য নীরবতা। কত নতুন নতুন বিষয় নিয়ে লেখা হয়। নিজের দেহ, যৌনতার উপর মেয়েদের অধিকার নিয়ে কত না সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু নিজের উত্তরাধিকার, নিজের রোজগারের উপর মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তার ছিটেফোঁটাও শোনা যাচ্ছে না। পণ যেন ঠিক ভদ্র বিষয় নয়। বড্ড বোরিং। আনসেক্সি। মিডিয়াতেও পণ-নির্যাতন দু-চার ইঞ্চি জায়গা পায়। অথচ কথাবার্তার দরকার ছিল। একদিন লজ্জায় মেয়েরা ধর্ষণ-হয়রানি লুকোত, এখন থানায় রিপোর্ট লেখায়, গ্রামের রাস্তায় মিছিল করে। পণের জন্য চড়-চাপড় খেয়ে আজও চেপে যেতে চায় লজ্জায়।

অথচ যে চিত্রনাট্য লেখা হচ্ছে ঘরে ঘরে, তার সংঘাতের তীব্রতা কি কম? একটি জেলা শহরের মহিলা কনস্টেবলের কথাই ধরা যাক। প্রোমোটার স্বামী ব্যবসার জন্য টাকা চেয়ে মারধর চালাচ্ছিল। এক দিন মেয়েটির দগ্ধ দেহ পাওয়া গেল। স্বামী পালিয়ে বেড়াল, গোপনে বাপের বাড়ির সঙ্গে কথা চলল। শেষে নিজের থানাতেই কেস লেখা হল পুলিশ মেয়ের। দুর্ঘটনায় মৃত্যু।

পণের কথা তুললে বরং বিরক্ত হয় সবাই। সম্প্রতি একটি ওয়েবসাইটে একজন প্রশ্ন করে, এখন আইএএস পাত্রের পণ কত? তাতে কিছু লোক ক্ষোভ দেখালে আর একজন লিখল, পণে যার আপত্তি তার আইএএস হওয়াই উচিত নয়, কারণ সে ভারতের কিছুই বোঝে না। সত্যিই তো, পণ ছাড়া ভারতীয় সমাজ ভাবা যায় না। একটা ওয়েবসাইটের নাম ‘ডাউরি ক্যালকুলেটর।’ সেখানে পাত্রের জাত, ডিগ্রি, মাইনে আর বাবার পেশা ভরে দিলেই বলা হবে, পণ কত পাবে। আইআইটি-আইআইএম, ব্রাহ্মণ, মাসে দু’লক্ষ টাকা মাইনে আর বাপ সরকারি চাকুরে হলে ৬৫ লক্ষ টাকা। পাত্র সাংবাদিক, বাপ শিক্ষক হলেও মন্দ না, ৩৫ লক্ষ টাকা। এ নাকি ‘স্যাটায়ার।’ কিন্তু এর কতটা বিদ্রুপ? কাকে বিদ্রুপ? মেয়েদের কালো রং নিয়ে মশকরা হয় কমেডি শো-তে। পণের দাবি নিয়ে ঠাট্টা শুনেছেন?

অবশ্য পণ আদায়ের পদ্ধতি এখন অনেক ‘রিফাইন্ড,’ বলছিলেন হাইকোর্টের এক আইনজীবী। বিয়ের আগে বলা হয়, মেয়েকে কী দেবেন আপনাদের ব্যাপার। বিয়ের পর মেয়ের সামনে আলোচনা হয়, ‘বাবু যাবে অমুক জায়গায়, ট্রেনে তো আর যেতে পারে না।’ কিংবা, ‘লোনের অ্যাপ্লিকেশনটা এ বার করে দে বাবু।’ মেয়ে বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে এলে প্রশ্ন, ‘বাবা কিছু বলল?’ মানে ফ্লাইট টিকিট, লোনের গ্যারান্টি শ্বশুর দেবে কি? টাকা চাইছি অথচ চাইছি না, চাইলে তোমাদের জন্যই তো চাইছি, এই হল কায়দা। না পেলে নানা ছুতোয় দুর্ব্যবহার শুরু। জোরে টিভি চালিয়ে, হাতে তোয়ালে পেঁচিয়ে মার।

যোগ্যতার বিচারে যত এগোচ্ছে মেয়েরা, পণ যেন ততই নগ্ন হয়ে উঠছে। মেয়েরা পড়ছে, চাকরির বাজারে লড়ছে। গৃহবধূও যে উৎপাদনশীল কর্মী, সে সত্যটা তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। পঞ্চায়েত-পুরসভা, এনজিও-স্বনির্ভর গোষ্ঠী, সবেতে মেয়েদের নেতৃত্ব স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। তাই ধর্ম, ঐতিহ্য, আর্থিক নিরাপত্তা, কোনও কিছু দিয়েই পণকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। এখন স্পষ্ট, পণ মানে‌ তোলাবাজি। খাতির করে যাকে বলা হয় ‘পুরুষতন্ত্র’ তা স্রেফ বর জোগানোর সিন্ডিকেট। যা মেয়েদের অবমানব করেছে, ছেলেদেরও অমানুষ করে রাখছে। টাকার জন্য যাকে নিজের প্রেমিকা, নিজের সন্তানের মায়ের উপর হিংস্র হয়ে উঠতে হয় প্রতিদিন, তার চাইতে গরিব হতভাগা আর কে আছে?

ধর্মপুত্র মহাভারতে বলেছিলেন, ধর্ম মানে অনৃশংসতা। পণ নৃশংসতা, অসহায়ের প্রতি হিংসায় বাধ্য করে। পণপ্রথা অধর্ম। মিতার জন্য ন্যায় কেবল অভিযুক্তের শাস্তিতে নয়। বরপণের বিরোধিতায়। ন্যায় চাইলে সেই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement