যদি আপনাকে হঠাৎ করেই কেউ প্রশ্ন করে বসে যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি কী? তখন নিশ্চয়ই মনের মধ্যে হাজারো শব্দ এসে ভিড় করবে। ভাবনায় আসতে পারে— হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, কনফুসি ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার একটু এগিয়ে থাকা মানুষের মনে হতে পারে— না না, এগুলি তো জাতি নয়, বরং ধর্ম। তা হলে? ভারতীয় বা জার্মানি বা ইংরেজ—বলতে পারেন। জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে এ রকম বহু নাম আসবে জানি। কিন্তু কখনও কী মনের মধ্যে এই ভাবনা বিকশিত হয়েছে যে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি হল মায়েদের জাতি অর্থাৎ নারীজাতি?
তথাকথিত পুরুষসমাজের অনেকেই নাক শিটকোবেন হয়তো— এ আবার কী কথা! কিন্তু আজ নারীদের জন্য অর্পিত দিবসের প্রাক্কালে সত্য কথাটা সত্য দিয়ে বিচার করার সময় এসেছে। আমরা যতই মুখে বলি না কেন, নারী পুরুষ সমান সমান বা সংবিধানে যতই নারী পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত হোক না কেন, কোথাও না কোথাও আজও নারীদের চূড়ান্ত অবহেলিত ও অমর্যাদাকর জীবনযাপনই করে যেতে হয়। প্রাচীন কালে ঠিক যে সময় থেকে সমাজে নারী পুরুষ বিভাজন এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব ঘটেছে, তখন থেকেই নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য কায়েম হয়েছে। এই প্রসঙ্গে অগস্ট বেবেলের লেখা নারী: অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গ্রন্থটির কথা মনে পড়ছে। নারী কী ভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অধীন হল, তার ব্যাখ্যা এখানে পাওয়া যায়।
কিন্তু যে পুরুষ নারীকে তাঁর অধিনস্ত বা ভোগ্য হিসেবে ভাবছেন, তিনি কি এক বারও ভেবে দেখেছেন যে, নারী গর্ভেই তাঁর জন্ম, নারী না থাকলে এই পৃথিবীতে তাঁর আসাই হত না। জায়া-কন্যা-মাতা এই ত্রিলক্ষীরূপিনী নারীশক্তির কথা ভুলে গিয়ে বর্তমান সমাজব্যবস্থায় নারীকে শুধুমাত্র ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যে নারীশক্তি দ্বারা জগৎ ও সংসার চলমান সেই নারীশক্তি কে পণ্যে রূপান্তরিত করে নারী অহমিকায় আঘাত হেনে নারীকে অবমাননা করার মধ্যে দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেন কোথাও না কোথাও যুদ্ধ জয়ের শৌর্য লাভ করে। তাই তো সমাজ-সংসার জুড়ে সর্বত্রই নারীদের পুরুষের হাতের ক্রীড়নক করে রাখার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। তাই তো রজঃশলা দ্রৌপদীকে দ্যুতপণে বিক্রি করা হয়, সীতাকে তাই অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়। আর শবরীমালায় প্রবেশের জন্য তাই আজও নারীকে লড়াই করতে হয়।
নারীর অধিকার আদায়ের জন্য এই লড়াই চলতেই থাকবে। যত দিন না নারীরা নিজেরাই নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারবে। নারী ভোগ্যপণ্য, পুরুষের সমকক্ষ সে কখনওই নয়— পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মনে চেপে বসা ভাবনার এই জগদ্দল পাথর যত দিন না সরে যাবে, তত দিন এই লড়াইটা চলতেই থাকবে।
কিন্তু নারী হিসেবে আমরা সেই লড়াইটা কতটা করছি বা আদৌ করতে পারছি কি না, সেটাও সামনে আসা দরকার। শ্রীমতি ক্লারা জেটকিন রাশিয়ায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে যে লড়াইটা শুরু করেছিলেন, সেই লড়াইয়ে আদৌ সমাজের সর্বস্তরের মেয়েরা অংশগ্রহণ করতে পারছেন কি না বা পারলেও সদিচ্ছা কতটুকু সেটাও নজরে রাখা প্রয়োজন। কারণ, আমরা মেয়েরা অনেক সময় পুরুষের অধিনস্ত থেকেও আত্মপ্রসাদ লাভ করি। পুরুষের ঠিক-ভুল সিদ্ধান্তে তাল মিলিয়ে পথ চলে আত্মসন্তুষ্টির ঘটনাও আকছার লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময় মানুষ নয়— নারী হিসেবে নিজেকে ভাবতে ভালবেসে পুরুষের আঙ্গুলি হেলনে নড়াচড়া করার মধ্যেও অনেকে মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পান। তা সে ন্যায় হোক বা অন্যায়।
পুরুষের কাছে নারীর এই দেওলেপনা ভাবমূর্তি গড়ে ওঠার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা অবহেলিত ও অবদমিত হন। তবে নারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্যে কোনও দুর্বলতা নেই, আছে নারী-পুরুষের সমকক্ষ নয়— এই ভাবনা গড়ে তোলার মধ্যে। যুগে যুগে নারীরা যে পুরুষের সমকক্ষ হতে পারেন, তার প্রমাণ স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত রয়েছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। মৈত্রেয়ী, অপালা, বিশ্ববারা থেকে রাজিয়া সুলতান, রানি লক্ষ্মীবাই, ইন্দিরা গাঁধী, কল্পনা চাওলারা প্রমাণ করেছেন মেয়েরা পুরুষের সমকক্ষ তো বটেই, এমনকী, পুরুষকে ছাপিয়েও তাঁরা অর্ধেক আকাশের পতাকাকে আকাশছোঁয়া উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারেন। কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠে রয়েছে অগণিত সাধারণ খেটেখাওয়া বঞ্চিত, নিপীড়িত সংখ্যাধিক্য মহিলা সমাজ। তাঁরা আজ বিশ্ব নারী দিবসে কেমন রয়েছেন, সেই খোঁজটাও নিয়ে রাখা দরকার।
আধুনিক সমাজের সর্বস্তরেও আজ নারীরা অবমাননার শিকার। মানবতাবোধ কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে পুরো সমাজটারই। তাই মেয়েরাই আজ সবচেয়ে অবজ্ঞার পাত্র। নারীশরীর আজ পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে— সিনেমা, টিভির পর্দায় ছোখ রাখলেই প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করতে পারি। পণ্য থেকে প্রসাধনী, পানশালা থেকে পাথর খাদান— সর্বত্রই নারীদের যান্ত্রিক ভাবে ব্যবহারের প্রবণতা দিন দিন যে ভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে শঙ্কিত হতে হচ্ছে। তসলিমা নাসরিনের কথায়—‘‘নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সামান্য সচেতন হলে মেয়েরা নিশ্চয়ই বুঝত যে জগতে যত নির্যাতন আছে মেয়েদের বিরুদ্ধে সব চেয়ে বড় নির্যাতন হল মেয়েদেরকে সুন্দরী হওয়ার জন্য লেলিয়ে দেওয়া।’’
নারী ধর্ষণের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা প্রতিনিয়ত যে ভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে বোঝা যায় পুরুষের কাছে নারীর মূল্যায়ন কোথায় সীমাবদ্ধ। শিশু থেকে সন্ন্যাসিনী, আট থেকে আশি— সকলেই যেখানে নারী দেহ হিসেবে ভাবিত ও চিহ্নিত হচ্ছেন, তখন শঙ্কার মাত্রা বহু গুণ বেড়ে যায় বইকী। ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নারীবাদী আন্দোলনকারীরা নারীদের প্রতি অবমাননাকর আচরণের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গঠনের চেষ্টা করে চলেছেন নিরন্তর। ইউনাইটেড নেশনস ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ পালনের মধ্যে দিয়ে নারী জাতিকে সম্মাননা জানিয়েছিলেন। প্রতি বছর ৮ মার্চ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ ঘটা করে নারীদিবস পালন করে। কোনও একটি বিশেষ দিনকে নারীসমাজের উদ্দেশ্যে নিবেদন করে, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপক্ষে নানা আলোচনা ও কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে পালন না করে বছরের প্রতিটি দিনই যদি নারীর মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হতে না দেওয়ার শপথ গ্রহণ করা যায়, তবে সেটাই হবে নারীদিবসের প্রকৃত সার্থকতা।
সেই শপথ কি আমরা গ্রহণ করতে পারি না? প্রশ্ন রইল নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র সমাজের কাছে।
সীতানগর হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক