প্রতীকী ছবি।
হায়দরাবাদের নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড দেশ জুড়িয়া বিপুল ক্রোধের সৃষ্টি করিয়াছে। সমাজের এবং সমাজমাধ্যমের শব্দব্রহ্মাণ্ডে দাবি উঠিয়াছে: ধর্ষকদের কঠোরতম শাস্তি চাই এবং অবিলম্বে। সংসদে ও সংসদের বাহিরে বিভিন্ন দলের জনপ্রতিনিধিরা প্রচণ্ড গর্জনে নানা বিধান দিয়াছেন, যথা— এমন ঘৃণ্য অপরাধে অপরাধীদের মানুষ বলিয়া গণ্য করিবার কোনও প্রশ্ন নাই, তাহাদের গণপ্রহারে হত্যা করা বিধেয়, কাহারও মতে এমন ঘটনায় নাগরিকদের নিজের হাতে আইন তুলিয়া লওয়াই সঙ্গত। উপরাষ্ট্রপতি প্রশ্ন তুলিয়াছেন, যে নাবালক এমন অপরাধ করিতে পারে তাহাকে নাবালক বলিয়া আদৌ গণ্য করা হইবে কেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া: জনপ্রতিনিধিরা চাহিলে ধর্ষণ দমনে আরও কঠোর আইন করিতে তাঁহারা প্রস্তুত। ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় কার্যত ঐকমত্য ঘোষিত হইতেছে। ক্রোধ অত্যন্ত স্বাভাবিক। পৈশাচিক অপরাধের প্রতিক্রিয়ায় পবিত্র ক্রোধ অত্যন্ত জরুরিও বটে। তাহা জানাইয়া দেয়, সমাজ এখনও সম্পূর্ণ মৃত নহে।
সমবেত ক্রোধ দেখিয়াও কিন্তু একটি প্রশ্ন বড় জ্বালাতন করিতে থাকে। ক্রোধ ভাল, কিন্তু তাহাতে কি অপরাধের মাত্রা কমিবে? মেয়েদের নিরাপত্তা বাড়িবে? ২০১২ হইতে ২০১৯— সাত বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হইতে আবহাওয়া বার্তার মতোই নিয়মিত মিলিয়াছে ধর্ষণ বার্তা। হায়দরাবাদের ঘটনার পরেও, দেশব্যাপী প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, মোমবাতি মিছিলের মধ্যেই রাজস্থান হইতে কোয়েম্বত্তূরে, বডোদরা হইতে ঝাড়খণ্ডে এবং, অবশ্যই রাজধানীতে শিশুকন্যা হইতে শুরু করিয়া বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা পিশাচদের শিকার হইয়াছেন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো-র সমীক্ষাও জানাইতেছে, ২০১৬ হইতে ২০১৭ সালে মেয়েদের বিরুদ্ধে (নথিভুক্ত) অপরাধের সংখ্যা ৬ শতাংশ বাড়িয়াছে। লক্ষণীয়, নির্ভয়া কাণ্ডের পরে আইন সংশোধন করিয়া ধর্ষণের শাস্তি কঠোরতর করা হইয়াছে, কিন্তু ধর্ষণের মামলায় দণ্ডদানের হার এখনও অত্যন্ত কম। এবং, চার্জশিট দিবার অনুপাত কমিয়াছে! অর্থাৎ পবিত্র ক্রোধের পর্দাটি সরাইলেই প্রগাঢ় অপবিত্র অন্ধকার। এই অবস্থার সুরাহা কি ক্রোধ দিয়া হইবার আশা আছে?
সম্ভবত নাই। অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতি চতুর্দিক হইতে মেয়েদের প্রতি বিরূপ, বিকৃত মানসিকতায় ইন্ধন জোগাইতেছে। মেয়েদের প্রতি প্রাচীন আধিপত্য এবং আধুনিক বিদ্বেষের বিষাক্ত পাঁচন বর্ষিত হইতেছে, মাঝে মাঝেই সেই বিষ ‘মুখ ফস্কাইয়া’ নির্গত হইতেছে। ধর্ষণ সেই গরলের একটি রূপ, একমাত্র নহে। এই গরলের প্রধান দায় কিন্তু রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের দায়িত্ব— সামগ্রিক, সার্বিক। তাহার বিচারব্যবস্থা দীর্ঘসূত্রী। পুলিশ নির্যাতিত মেয়েদের বিষয়ে প্রায়শ উদাসীন, এমনকি প্রতিকূল। প্রশাসক ও রাজনীতিকরা তথৈবচ। বিস্তর কমিটি, সুপারিশ, আইন সংশোধন ও আদালতের নির্দেশের পরেও ফাস্ট ট্র্যাক আদালতের ঘাটতি বিপুল। প্রয়োজনীয় পুলিশি টহল অকিঞ্চিৎকর। বিপন্ন মেয়েদের পাশে দাঁড়াইবার তৎপরতায় ভয়াবহ ঘাটতি— কলিকাতাতেও আপৎকালীন ফোন করিয়া নাগরিক বিফল হন, কর্তারা ব্যাখ্যা দেন: ‘প্রযুক্তিগত সমস্যা’ আছে! মূল সমস্যা প্রযুক্তিতে নাই, আছে কর্তা ও কর্ত্রীদের মস্তিষ্কে। সেই মস্তিষ্ক সাধারণ নাগরিকদের তথা সাধারণ মেয়েদের যথেষ্ট ‘মানুষ’ বলিয়া গণ্য করে না। করিলে, রাজ্যে রাজ্যে— শ্রীযুক্তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গেও— নারী সুরক্ষার জন্য নির্দিষ্ট ‘নির্ভয়া তহবিল’-এর অধিকাংশ টাকা পড়িয়া থাকিত না। তাই, সন্দেহ হয়, ধর্ষণের লাগাতার মিছিল হইতে মাঝে মাঝে এক একটি কাহিনি লইয়া সমাজ ও রাষ্ট্র থাকিয়া থাকিয়া মাতিয়া উঠিবে, শোরগোল করিবে, বিস্তর ক্রোধ এবং বিস্তরতর আবেগ নিঃসৃত হইবে, ইতস্তত কিছু প্রসাধনী সংস্কার ঘটিবে। মোমবাতি অচিরেই নিবিবে।